বাঙলা তার নিজের সংকীর্ণ জগতে গুটিয়ে থাকবে নাকি জাতীয় মঞ্চে আসীন হয়ে তার মনীষীদের চেতনার আলোকে উদ্ভাসিত হবে ?

1894 সালের মার্চ মাসের তৃতীয় দিন। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর মাদ্রাজী বন্ধু কিডিকে লিখছেন :তোমাকে পূর্বেই লিখেছি ও বলেছি, আমার স্থির বিশ্বাস-মাদ্রাজীদের দ্বারাই ভারতের উদ্ধার হবে।তাই বলছি, হে মাদ্রাজী যুবকবৃন্দ,তোমাদের মধ্যে গোটাকতক লোক এই নূতন ভগবান রামকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে এই নূতনভাবে একবার মেতে উঠতে পারো কি ? …(পত্রাবলী, স্বামী বিবেকানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়)

উত্তর কলকাতার শিমুলিয়ার বাসিন্দা নরেন্দ্রনাথ দত্ত, যিনি পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ রূপে পরিচিত হলেন ,তিনি কেন কলকাতার মানুষকে ভরসা না করে মাদ্রাজী যুবকদের উদ্ধারকর্তা বলে ভাবতে বসলেন ? কেন রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের, বিশেষতঃ দক্ষিন ভারত থেকে যোগদানকারী সন্ন্যাসীদের নিয়োগ করা হয়েছিল ? না না, এই প্রশ্ন সামাজিক বা সামগ্রিক স্তরে কেউ তোলেন নি। সৌভাগ্য বলতেই হবে যে কোন সামাজিক বিচারে প্রভাবশালী ব্যক্তি বলে ওঠেন নি যে স্বামী বিবেকানন্দ অথবা তাঁর প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশন বহিরাগতদের আমদানি করছেন এই বাঙলার মাটিতে।

বহিরাগত কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি স্থানীয় ঐতিহ্য আর কৃষ্টি-সংস্কৃতির বিলোপ ঘটিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য চাপিয়ে দিত চায়, তবে তা আশঙ্কার কারন বটে। যদি কেউ এসে বলে যে রবীন্দ্রনাথ এর লেখা পড়ে লাভ নেই , তার বদলে কোন গুজরাটি বা হিন্দি সাহিত্য পড়তে হবে, তবে সত্যিই তা ভয়াবহ।যদি কেউ বলে যে বঙ্কিমচন্দ্রের রচনার চর্চা কোনোরকম জাতীয়তাবোধের জন্ম দিতে অক্ষম, তাই এসব বাতিলের দলে ঠেলে দেওয়া উচিত,তবে সত্যি সত্যিই সেই বহিরাগত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আমাদের জন্য মঙ্গলময় হতে পারে না।

কিন্তু যদি দেখা যায় যে বহিরাগত কেউ, ধরুন কোন গুজরাটি , বঙ্কিমচন্দ্রকে অধ্যয়ন করছেন এবং বিশ্বাসের সাথে উচ্চারন করছেন যে বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা আধুনিক ভারতের কাছেও নতুন অনুপ্রেরণাস্বরূপ, তাকে কি বহিরাগত বলব না সাদরে গ্রহন করব ? আমাদের সাহিত্যসম্রাট সুমহান কীর্তি যদি জাতীয় জীবনে নূতন করে জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয়, আমরা গর্ব অনুভব করব নাকি ‘ বহিরাগত বহিরাগত ‘ বলে ঘরের কোনে মুখ লুকোতে চাইব ? তথাকথিত বহিরাগত কোন মানুষ বা গোষ্ঠী যদি বৌদ্ধিক এবং রাজনৈতিক স্তরে সুস্পষ্ট বার্তা প্রদান করেন যে এই বাঙলার স্বামী বিবেকানন্দ এবং ঋষি অরবিন্দ ভারতের জাতীয় চেতনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তখনও কি আমরা বলব যে না আমাদের বাঙলায় এইসব বহিরাগতদের কোন জায়গা নেই ? আমাদের চিন্তা কি হবে , বাঙলা তার নিজের সংকীর্ণ জগতে গুটিয়ে থাকবে নাকি জাতীয় মঞ্চে আসীন হয়ে তার মনীষীদের চেতনার আলোকে উদ্ভাসিত হবে ?

মিস মার্গারেট নোবল আক্ষরিক অর্থে বহিরাগতই তো ছিলেন।কেউ কি বহিরাগত বলে তাকে ‘ ভগিনী নিবেদিতা ‘ হতে বাধা দিয়েছিল। যদি দিয়েও থাকে, তবে তাদের স্থান আজ ইতিহাসের আস্তাকুড়ে।

সুমন দেব রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.