“যাহাদের দোলনার মুখে আজ হরিণেরা ম’রে যায়/ হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এলো যাহাদের ডিশে/  তাহারাও তোমার মতন;/ ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদেরো হৃদয়/ কথা ভেবে-কথা ভেবে ভেবে।/ এই ব্যথা—এই প্রেম সব দিকে র’য়ে গেছে—

… বসন্তের জ্যোৎস্নায় ওই মৃত মৃগদের মতো/ আমরা সবাই।”

জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’। এটা ঠিক যে ‘ঝরাপালক’ কাব্যগ্রন্থে জীবনানন্দ তাঁর নিজস্ব ভাষা ও চেতনা নিয়ে ধরা দেননি। ভাবতে অবাক লাগে, বিরাট মাপের মানুষেরা সে দিন বোঝেননি শিকারীর নিয়তি নিয়ে জীবনানন্দ দাশের ‘ক্যাম্পে’ কবিতার এই সব পংক্তি। এলিট সাহিত্য ব্যক্তিত্বরা এই কবিতা সেদিন বোঝেননি? এই কবিতা নিয়ে তাঁরা যা বলেছিলেন আজ সেটাই উপহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, নানা কারণে অভাবে দিন কেটেছে জীবনানন্দর। তাঁকে খোয়াতে হয়েছে প্রথম চাকরি। তার কারণ পোস্টমর্টেম করতে বসলে একটা মোক্ষম কারণ থাকলেও অনেকে বলেন, ‘ক্যাম্পে’ কবিতার অশ্লীলতার কারণে জীবনানন্দের চাকরি গিয়েছিল।

১৯২৮ সাল। মাত্র ৬ বছর হল জীবনের প্রথম চাকরিতে ঢুকেছেন তিনি। সিটি কলেজের অস্থায়ী শিক্ষক জীবনানন্দ দাশ। ৬ বছরের মাথায় খোয়া গেল প্রথম চাকরিটি। এই ঘটনাটি নিয়ে অবশ্য নানা ধরনের মিথ প্রচলিত আছে।

এ প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশ গবেষক গৌতম মিত্র বলেন, “অশ্লীল কবিতা বা ‘ক্যাম্পে’ কবিতা লেখার জন্য জীবনানন্দ দাশের চাকরি যায়নি, কারণ ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় চাকরি যাওয়ার পরে।” এই কারণকে একপাশে রেখেও যে কারণটা সবচেয়ে বেশি জোরালো তা এই রকম:

১৯২৮ সাল। মাত্র ৬ বছর হল জীবনের প্রথম চাকরিতে ঢুকেছেন তিনি। সিটি কলেজের অস্থায়ী শিক্ষক জীবনানন্দ দাশ। ৬ বছরের মাথায় খোয়া গেল প্রথম চাকরিটি। এই ঘটনাটি নিয়ে অবশ্য নানা ধরনের মিথ প্রচলিত আছে। ঠিক কী কারণে তাঁর চাকরি খোয়া গেল, সেটা পরিষ্কার হয়নি কোথাও। জীবনানন্দের বাবা সত্যেন্দ্র দাশকে অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র লিখছেন, “আর্থিক কারণে আপাতত আপনার ছেলেকে ছাঁটাই করা হলেও আবার যখন অধ্যাপক নেওয়া হবে, তখন তাঁকে নেওয়া হবে।” আর এই আর্থিক কারণের পিছনেই রয়েছে আরও একটি ঘটনা। নিছক একটি সরস্বতী পুজোর পরিকল্পনাকে ঘিরে সমস্যার সূত্রপাত। আর তার মধ্যেই বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র বোস-সহ বাংলার অসংখ্য প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব।

সরস্বতী পুজো মানে বাঙালির ১৩ পার্বণের এক বড়ো পার্বণ। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের কাছে দিনটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আজকাল অবশ্য তার সবচেয়ে বড়ো পরিচয় বাঙালির ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসাবেই। কিন্তু ১৯২৮ সালে সরস্বতী পুজো মানে একান্তভাবেই বাগদেবীর আরাধনা, বিদ্যার দেবীর পুজো। শহর কলকাতার অনেক ছাত্রাবাসেই তখন ঘটা করে পালিত হত সরস্বতী পুজো। ঠিক এই সময় রামমোহন হোস্টেলের হিন্দু ছাত্ররাও ঠিক করলেন, তাঁরা সরস্বতী পুজো করবেন। শুরু হল প্রস্তুতি। মাঝখানে গোল বাঁধল কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।

জীবনানন্দের বাবা সত্যেন্দ্র দাশকে অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র লিখছেন, “আর্থিক কারণে আপাতত আপনার ছেলেকে ছাঁটাই করা হলেও আবার যখন অধ্যাপক নেওয়া হবে, তখন তাঁকে নেওয়া হবে।”

ব্রাহ্ম সমাজের আনন্দমোহন বসু সিটি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। যদিও সব ধর্মের ছাত্রদের জন্যই পঠনপাঠনের নিয়মকানুন ছিল একই। তা সত্ত্বেও কলেজ ও ছাত্রাবাসের জীবনধারার মধ্যে একটা ব্রাহ্ম ভাবধারার প্রভাব ছিলই। মূর্তিপূজা নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করলেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র ছাত্রদের সংযত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হল না। কারণ হিন্দু ছাত্রদের দাবির সপক্ষে এসে দাঁড়ালেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু। চিত্তরঞ্জন দাশের পর তিনিই বাংলার তরুণ নেতা হিসেবে উঠে এসেছিলেন। সুভাষ সরাসরি জানিয়ে দিলেন, যাই হোক না কেন, সরস্বতী পুজো হবে। অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান হলেও বিদ্যার দেবীর কথা তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন একাধিকবার। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত হলেন ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে। এ প্রসঙ্গে জীবনানন্দ-গবেষক গৌতম মিত্র বলেন, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ‘তাসের দেশ’ সুভাষচন্দ্র বোসকে উৎসর্গ করেন, তখন তা আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। কিন্তু এই প্রিয় সুভাষের সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ একবার খুব বাজে ধরনের বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এবং সেই বিতর্কের বলি হয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশের মতো কেউ কেউ।”

১৯২৮। সিটি কলেজে সরস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্ম ও হিন্দুদের মধ্যে কলহে এই দুই ব্যক্তি স্বেচ্ছা বা অনিচ্ছায় হোক নিরপেক্ষ থাকতে পরেননি। রবীন্দ্রনাথ ‘প্রবাসী’  ও ‘The Modern Review’-তে হিন্দু ছাত্রদের বিরুদ্ধে দুটো প্রবন্ধ লিখে ক্ষান্ত হলেন না। প্রবাসীতে জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৫-এ চিঠিতে লিখলেন:

“যাঁরা ভারতে রাষ্ট্রিক ঐক্য ও মুক্তির সাধনাকে তাঁদের সমস্ত চেষ্টার একমাত্র লক্ষ্যরূপে গ্রহণ করেছেন, তাঁরাও যখন প্রকাশ্যে এই ধর্মবিরোধকে পক্ষপাত দ্বারা উৎসাহই দিচ্ছেন, তাঁরাও যখন ছাত্রদের এই স্বরাজনীতিগর্হিত আচরণে লেশমাত্র আপত্তি প্রকাশ করতে কুণ্ঠিত, তখন স্পষ্টই দেখছি, আমাদের দেশের পলিটিকস-সাধনার পদ্ধতি নিজের ভীরুতায়, দুর্বলতায় নিজেকে ব্যর্থ করবার পথেই দাঁড়িয়েছে।”

জীবনানন্দ গবেষক গৌতম মিত্র আরও বলেন, “কাকে উদ্দেশ্য করে এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ? সন্দেহ নেই সুভাষচন্দ্র বসুকে উদ্দেশ্য করেই এই বাক্যবাণ!” এর কিছুদিন আগে ২ মার্চ ১৯২৮-এ সুভাষচন্দ্র বোস সিটি কলেজের ছাত্র আন্দোলনের প্রতিবাদ সভায় বলেছিলেন: “আমাদের বিরুদ্ধে সাধারণত একটি অভিযোগ আনা হয়। আমরাই নাকি সাধারণত দেশের যুবকদের প্ররোচিত করি। …অভিযোগটি অবান্তর। হিন্দু ছাত্রদের কোমল ধর্মীয় অনুভূতিকে পদদলিত করে সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারী আচরণের ফলে সিটি কলেজের ছাত্ররা বর্তমানে যে আন্দোলন শুরু করেছে তার প্রতি আমার সাগ্রহ ও অবাধ সমর্থন আছে। …আলোকপ্রাপ্ত এবং অগ্রসর ব্রাহ্মভদ্রলোকেরা হিন্দু ছাত্রদের উপর নিজেদের ধর্মবিশ্বাস চাপিয়ে দেবার জন্য এত নিচে কী করে নামলেন আমি তা অনুধাবন করতে অক্ষম।”

সুভাষচন্দ্র বোসের এই ‘ব্রাহ্মভদ্রলোক’ তুলে খোঁচাটাও কি আর রবীন্দ্রনাথের গায়ে লাগবার কথা নয়! সংবাদপত্রও এই রবীন্দ্রনাথ-সুভাষ বিতর্কে সরগরম হয়। মিটমাট করবার জন্য ২৩ মে ১৯২৮-এ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় একটি ‘নিবেদন পত্র’ প্রকাশিত হয়। তাতে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি স্বাক্ষর করেন। তবু কি সবটা মিটমাট হয়েছিল? জাতীয়তাবোধ দুজনেরই ছিল। কিন্তু লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। ‘প্রতিমা পূজা করিবার জন্য জিদ’ রবীন্দ্রনাথ মেনে নিতে পারেননি আর সুভাষচন্দ্র প্রতিমা পূজার পক্ষে সওয়াল করে ছাত্রদের জাতীয়তাবোকে উদ্দীপনার বিষয় করতে চাইলেন।

সিটি কলেজ থেকে জীবনানন্দের চাকরিচ্যুতির পেছনে তাঁর কবিতায় অশ্লীলতাকে কারণ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বলা হয়েছে। তবে তাঁর জীবনীকার ও গবেষকরা যথেষ্ট যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, কবিতায় অশ্লীলতা কোনো কারণ ছিল না।

ফলত দলে দলে হিন্দু ছাত্র সিটি কলেজ ছেড়ে দিতে লাগল। কলেজের অর্থনীতিতে টান পড়ল। এবং সর্ব কনিষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে জীবনানন্দ দাশের সিটি কলেজের টিউটর পদের চাকরিটা গেল। শেষ পর্যন্ত যদিও রামমোহন হোস্টেলে সরস্বতী পুজো হয়ে ওঠেনি। তবে এটা একমাত্র কারণ, সেটা মনে করেন না জীবনানন্দ গবেষকরা। যদিও সিটি কলেজ থেকে জীবনানন্দের চাকরিচ্যুতির পেছনে তাঁর কবিতায় অশ্লীলতাকে কারণ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বলা হয়েছে। তবে তাঁর জীবনীকার ও গবেষকরা যথেষ্ট যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, কবিতায় অশ্লীলতা কোনো কারণ ছিল না। বরং হিন্দু-ব্রাহ্ম বিবাদের ফলে কলেজ যথেষ্ট আর্থিক সংকটে পড়লে তার বলি হন কনিষ্ঠতম শিক্ষক জীবনানন্দ দাশ।

একটি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। স্ত্রী লাবণ্য দাশ স্কুলে শিক্ষকতা করে জীবিকার অভাব কিছুটা পুষিয়েছেন। দুই দফা দীর্ঘ বেকার জীবনে জীবনানন্দ ইন্সুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন এবং প্রধানত গৃহশিক্ষকতা করে সংসার চালিয়েছেন। এছাড়া ব্যবসার চেষ্টাও করেছিলেন বছরখানেক। দারিদ্র্য এবং অনটন ছিল তাঁর জীবনের ছায়াসঙ্গী। সেই দারিদ্র্যকে সঙ্গ নিয়েই তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃত। জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে যেভাবে আবহমান বাংলার চিত্ররূপ সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসেবে খ্যাত হয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘নির্জনতম কবি’ এবং অন্নদাশঙ্কর রায় ‘শুদ্ধতম কবি’ নামে আখ্যায়িত করেছেন।

কালের যাত্রাপথ অনেক লম্বা। আজও রহস্যে মোড়া তাঁর মৃত্যু। অনেক অভাব, দারিদ্র্যের সঙ্গে সহবাস করেও তিনি ‘চিত্ররূপময়’ কবি হয়ে বাংলা কাব্য জগতে প্রমাণ করেছেন, সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.