সারা দেশে অসহিষ্ণুতার মিথ্যা চিত্র একে দেশকে ভিতর থেকে ভাঙার ষড়যন্ত্র আমরা মানাতে পারিনি। শুধু ভিতর থেকে ভাঙা না, এই সুর স্বঘোষিত অভিভাবক সমাজকে সমে-বর্ণে বিভাজনের পাশাপাশি বিদেশে শত্রু রাষ্ট্রগুলোর কাছে ভারতকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাইছেন। এটা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, প্রতিবাদ না করে আমরা পারলাম না। আমাদের বার্তা স্পষ্ট করেই জানানো দরকার। সেজন্যই এই লেখা।
বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্দেশ্যে ২৩ জুলাই ২০১৯, একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করা হয়েছে। ভারতের বিবেক আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ‘স্বঘোষিত অভিভাবক’ ৪৯ জন তাদের বাছাই করা প্রতিক্রিয়া জানিয়ে প্রমাণ করলেন, তারা রাজনৈতিকভাবে একপেশে আর সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়া কথা বলেন না।
আমরা নিম্ন-স্বাক্ষরকারীরা মনে করি, এই ‘খোলা চিঠি’ একটি মনগড়া মিথ্যে গল্প তৈরি করা ছাড়া কিছু নয়। এদের শেষ লক্ষ্য, আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর জাতি ও দেশবাসীর সমবেত প্রয়াসকে বিচূর্ণ করা। এর উদ্দেশ্য, ভারত যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিত্য উন্নততর অবস্থানে উন্নত হচ্ছে সম্মানের আসন পাচ্ছে, তাকে ধ্বংস করা। সেই সঙ্গে তাঁরা চাইছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তুলহে যে সক্রিয় স্বচ্ছ প্রশাসন তুলে আনছেন ইতিবাচক ভারত, তাকে ভিতর থেকে দুর্বল করতে।
এই ‘খোলা চিঠি’তে যাঁরা সই করেছেন, তাঁদের অতীত কার্যকলাপ সবাই জানি। নকশালপন্থী সন্ত্রাসে যখন জনজাতি ও প্রান্তিক মানুষ অত্যাচারিত হয়। তখন এঁরা না থাকেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যখন কাশ্মীরের বিদ্যালয়গুলোকে জ্বালিয়ে দেওয়ানির ‘আদেশ’ ছড়িয়ে দেয় তখন এঁরা কিছু বলেন না, দেশজননীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার দাবিতে যখন ধ্বনি ওঠে, তার প্রতিধ্বনি শোনা যায় দেশের অগ্রসর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এখন একা না-শোনার ভান করেন। এই তো তাদের অতীত।
এইসব স্বাক্ষরকারীরা সম্ভবত ভারতের স্বাধীনতা, ঐক্য আর সংহতি, বাক-স্বাধীনতা আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ধ্বংস হোক। অন্য পক্ষে আমাদের নামে ঐক্য-সংহতির জন্য, আমাদের পবিত্র স্বাধীনতার বিপক্ষে যারাই প্রশ্ন তুলতে চাইবে, যারা একে ধ্বংস করতে চাইবে–তারা দেশ-বিরোধী। এই স্বাক্ষরকারীদের অনেকেই অতীতে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, উগ্রপন্থাকে আদর্শগতভাবে সমর্থন করেছেন। সেদিক থেকে দেখলে এদের দুশ্চিন্তা মিথ্যাচার আর সুবিধাবাদ ছাড়া কিছু নয়।
তাদের যুক্তি, সরকার বিরোধী বলেই তাঁদের দেশ-বিরোধী তকমা দেওয়া উচিত নয়। আমরা তো দেখছি, প্রধানমন্ত্রী মোদির সময়েই ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ বেড়েছে সব থেকে বেশি। সমালোচনা বা সরকারকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করা—মতান্তরের এমন অবকাশ আগে আমরা দেখিনি। পবিত্র সংবিধান অন্যমত প্রকাশের সুযোগ দিয়েছে কিন্তু তা কখনওই দেদশ-ভাঙার প্রয়াসে-লক্ষ্যে অগ্রসর হোক, সে অধিকার কেউ পেতে পারেন না। মতান্তরের সুযোগ দেশ-বিরোধী কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা অন্যায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়।
প্রধানমন্ত্রী মোদি অত্যন্ত কর্মতৎপর, তিনি তাঁর সরকারের মন্ত্র স্থির করেছেন: ‘সবার সঙ্গে সবার বিকাশ’ (সবকা সাথ সবকা বিকাশ); এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘সবার বিশ্বাস’ (সবকা বিশ্বাস)। গণপিটুনি একটি সামাজিক কর্ম; এর প্রতিরোধ অবশ্যই দরকার—চাই আইনি ব্যবস্থার যথাযথ প্রয়োগ। প্রধানমন্ত্রী, বহুবার এ নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অভিমত স্পষ্ট করেছেন সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিক— এই তাঁর নির্দেশ। অথচ বেছে বেছে কিছু গণপিটুনির বিরুদ্ধে কেন, আসুন আমরা সামগ্রিকভাবে এর প্রতিবাদ করি। ধর্ম-বিচার না করেই প্রতিশব্দ হোক। এইসব বিখ্যাত ব্যক্তিরা তা করেননি—তাঁরা অত্যাচারিতের সামাজিক পরিচিতিকে দেখেছেন, বৃহত্তর প্রেক্ষাপট না দেখে উদারভাবে গণ-অত্যাচারের পিছনে বিকৃত মনকে শনাক্ত করতে তাঁরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
এর আগে আমাদের দেশের প্রান্তিক ও অত্যাচারিত মানুষ এমন অধিকার, সুযোগ ও সামর্থ্য লাভ করেননি। এইসব অন্তসারশূন্য, ফাঁপা আওয়াজ= রাজনৈতিক পরস্পর পিঠ চুলকানির মাধ্যমে অর্জিত হয়নি; প্রকৃতপক্ষে সৃজনশীল পরিকল্পনা, বাস্তবানুগ কর্মসূচি তাদের শক্তি-সামর্থ্য দিয়েছে। আমাদের দেশের প্রান্তিক নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষ প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনে প্রশ্নাতীত সমর্থন জানিয়েছেন, এই খোলা চিঠির স্বাক্ষরকারীরা এই সিদ্ধান্তকে ব্যঙ্গ করছেন।
ছড়িয়ে দিচ্ছেন ভয়ের বাতাবরণ, ভারতের অগ্রগতিকে ব্যাহত করা ছাড়া এর অন্য লক্ষ্য নেই। ভারতীয় সমাজের সর্বস্তরের মানুষ একসঙ্গে উন্নয়ন করুন–এঁরা চান না। এর একমাত্র লক্ষ্য আন্তর্জাতি ক্ষেত্রে দেশকে অসম্মান করা। আমরা এই ষড়যন্ত্রের তীব্র প্রতিবাদ করছি।
এই স্বাক্ষরকারীরা আশ্চর্যজনক ভাবে মৌন থেকেছেন:
১. যখন ‘জয় শ্রীরাম’ বলার জন্য দেশের নাগরিকদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে তারা নাকি অপরাধী। এমনকী, নিষ্ঠুরভাবে গণপিটুনিতে মারা হয়েছে। বলপূর্বক চুপ করানোর এ ঘটনায় এই সব বিশিষ্টও চুপ থেকেছেন।
২, যখন ‘জয় শ্রীরাম বলার পরে অত্যাচারে অভিযোগ করা হয়েছে, তখন অত্যাচারীরা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে।
৩. গত লোকসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ আর তার আগে পরে বিশেষ কোনও ধর্মগোষ্ঠীর মানুষ সন্দেশখালির হিন্দুদের বাধা দিয়েছে; নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, ভয় দেখিয়েছেন এক অসামাজিক অপরাধী শাজাহান শেখ। তখন তাকে বলা হয়েছে জনপ্রিয় সমাজ সেবক। তখনও তারা নীরব।
৪, গত লোকসভা নির্বাচনে হিন্দুরা যাতে অংশ নিতে না পারেন সেজন্য নহাজারি-বগাখালি প্রভৃতি ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রের নাগরিকদের গ্রামে আক্রমণ, নারীদের লাঞ্ছনা করা হয়েছে–স্থানীয় মসজিদ থেকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে–তখনও এইসব ‘স্বঘোষিত অভিভাবক’রা মূক ও বধির থেকেছেন।
৫. ২০১৮-য় পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় যে ভয়ঙ্কর অত্যাচার হয়েছে, এখন কি এঁরা কি বলেছেন?
৬. পশ্চিমবঙ্গে বিগত লোকসভা নির্বাচনের সময় লাগামছাড়া সন্ত্রাসের সময় এদের কোনও প্রতিক্রিয়া আমরা দেখিনি।
৭. পুরুলিয়ার জগন্নাথ টুডু, ত্রিলোচন মাহাতোদের যখন ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করার জন্য নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়—তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? কোথায় ছিলেন, যখন দুলাল কুমারকে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়?
৮. উত্তর দিনাজপুরের দাড়িভিট উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র বিক্ষোভের কথা আপনাদের মনে নেই। ওরা চেয়েছিল বাংলা-ইংরেজি-ভূগোল আর কমপিউটার শিক্ষক, পরিবর্তে পেয়েছিল একজন উর্দু শিক্ষক। বিদ্যালয়ে উর্দু পড়াতে চায়নি কেউ। ছাত্র-বিক্ষোভে গুলি চলল, মারা গেল রাজেশ সরকার আর তাপস বর্মন। কই, আপনাদের বিবেক তো তখন জাগেনি!
৯. কালিয়াচক-দেগঙ্গা-বাদুড়িয়া-ধুলিয়াগড়—রানিগঞ্জ, পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় অসহষ্ণুিতার কারণে হিন্দু মন্দির ধ্বংস হয়েছে; অসমের হাইলাকান্দিতে একই কাণ্ড ঘটেছে। চন্দ্রকোণা রোডে শতাব্দী প্রাচীন শিব মন্দির ভেঙেছেন এক সাংসদ নিজে উপস্থিত থেকে। অন্য পক্ষে নেতাজি সুভাষ বিমান বন্দরের উন্নয়নের জন্য অন্য একটি ধর্মের প্রার্থনাস্থল মসজিদ একচুল নড়ানো যায়নি। আপনাদের বাছাই করা প্রতিবাদ কেন এমন একপেশে? এ বছর জুলাই মাসে দিল্লির চাঁদনি চক বাজার অঞ্চলে দুর্গা-মন্দির তছনছ করেছে বিশেষ একটি ধর্মের তরুণরা। আপনাদের চোখে পড়েনি তো!
১০. কেরলের ‘শবরীমালা’ মন্দির-প্রবেশের আন্দোলনের সময় হিন্দুধর্মে বিশ্বাস না করেই ছদ্মবেশে ষড়যন্ত্র করে রাজ্য প্রশাসনের সাহায্যে ঢুকে লক্ষ লক্ষ ভক্ত সাধারণের মানে আঘাত করা হল। তখন তো আপনাদের মুখে চওড়া হাসি ঝুলে থাকতে দেখেছি। আপনারা কি ঘোষিত ভাবে হিন্দু-বিরোধী?
১১. উত্তরপ্রদেশের কাইরানা থেকে হিন্দুদের ঘরবাড়ি সম্পত্তি দোকানপত্র ছেড়ে নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে হয়েছে। এসময় কোথায় ছিলেন আপনারা?
১২. কাশ্মীরের শ্রীনগর-উপত্যকা থেকে বলপূর্বক উৎখাত করা হয় কাশ্মীরি-পণ্ডিতদের। আজ পর্যন্ত তাঁরা বাস্তুহারা হয়ে শরণার্থী-শিবিরে বাস করেছেন। তা নিয়ে এখনও পর্যন্ত কিন্তু এইসব অসহিষ্ণুতার প্রচারকদের সক্রিয় হতে আমরা দেখিনি।
শুধু কি তাই, এই সব মানবতাবাদীরা ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’ বা তালাক-এ বিং-এর মতো নারী অধিকার বিরোধী ব্যবস্থা নিয়ে, অত্যাচারিত তালাকপ্রাপ্ত হতভাগ্য নারীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে কখনও কিছু বলেছেন বা করেছেন বলে জানা যায়নি।
এইভাবে স্পষ্ট হয়-বাছাই করা প্রতিবাদ করা অথবা নির্লিপ্ত উদাসীন থাকা এদের একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক শক্তির হাতের পুতুল হয়ে থাকা। এরা ভারতকে খণ্ড-বিখণ্ড করার ‘বলকানাইজেশন’ এর লক্ষ্যে কৃত-সংকল্প একটি দেশবিরোধী শক্তির ক্রীড়নক। এদের একমাত্র লক্ষ্য দেশকে বিপড়ি ।
এই ‘খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর প্রদানকারীরা ভারতের সংখ্যা দাবিশসকে নিয়মিত অসম্মান করে চলেছেন। শ্রীরামচন্দ্রকে যারা শ্রদ্ধা করে তাদের বিরুদ্ধে এরা খড়গহস্ত। আসলে দেশের প্রান্তিক নিম্নবর্গের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ শ্রীরামচন্দ্রকে তাদের পরমেশ্বর বলে হৃদয়ে ধারণ করে—এই বাস্তবতাকে উক্ত স্বঘোষিত অভিভাবকরা জানেন না। ভারতে বৃহত্তম জনসাধারণের ধর্ম-সংস্কারকে সম্মান জানাতে এঁরা পাবেন না, তাদের ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতে, ‘বোকা’ বলতে এঁদের জুড়ি নেই।
আমরা মনে করি, বাক-স্বাধীনতার নামে এইসব লুকোনো রাজনৈতিক অভিসন্ধিতে প্রকাশ্যে আনা উচিত। ভারতকে অস্থিতিশীল করা, অসম্মান করা, টুকরো-টুকরো তথা “বলকানাইজ’ করার যে কোনও যড়যন্ত্রের আমরা বিরোধিতা করছি।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ভারত তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশের পথে অগ্রসর হবে। দেশে প্রগতি, সামজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা এই সব অস্থিতিশীলতার নেতিবাচক রাজনীতি আর সামাজিক ভেদবুদ্ধির বিপক্ষতা করছি। এইসব মিথ্যাচার, ভুলভাবে বলা একপেশে অত্যাচারের সাজানো গল্প ছড়ানোর কৌশলে আমরা বিশ্বাস করছি না। শেষপর্যন্ত এই প্রতিবাদের মাধ্যমে আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামো আর ঐক্যের শক্তিকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। আমরা জানি পবিত্র সংবিধান প্রদত্ত মূল শক্তি অবিচল থাকবেই। এই সময়কার মূলমন্ত্র সকলের সঙ্গে সকলের বিকাশ আর সকলের বিশ্বাস (সবকা সাথ সবকা বিকাশ সবকা বিশ্বাস) নিয়ে ভারত এগিয়ে যাবেই।
অচিন্ত্য বিশ্বাস
লেখক: প্রাক্তন উপাচার্য, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়
2019-07-29