ভারতবর্ষের বিভিন্ন বিতর্কিত ধর্মীয় বা বিজয় স্থাপত্যের সঠিক ইতিহাস জানার জন্য হঠাৎ করেই দেশবাসির উৎসাহ যেন বেড়েই চলেছে। সরকার এবং আদালতও মানুষের সঠিক ইতিহাস জানার এই উৎসাহের প্রতি সন্মান জানিয়ে ভারতের পুরাতত্ব বিভাগের পন্ডিত ব্যক্তিদের সত্যান্বেশনের জন্য কাজে লাগানো শুরু করেছেন। এমতাবস্থায় একটা বাবরি, জ্ঞানভাপি, কুতুবমিনার ইত্যাদি বিভিন্ন মধ্যযুগীয় শাসকদের দ্বারা নির্মিত(মতান্তরে রূপান্তরিত) এই স্থাপত্য গুলোর মধ্যে একাধিক কলাকৃতি পাওয়া যাচ্ছে বা খালি চোখেই দেখে বোঝা যায় এসব ভারতীয় কলাকৃতি যেমন, হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তি ও বিভিন্ন পবিত্র ভাস্কর্য্য। কলাকৃতি বা ভাস্কর্য্য গুলোকে নষ্ট করার চেষ্টাও পরিস্কার ভাবে রয়েছে, যেমন কুতুব মিনারের পার্শ্ববর্তী প্রাচীরে্র নর্তকীদের ভাস্কর্য্য গুলোর মুখ ঘষে বা ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি।
কিন্তু প্রশ্নটা অন্য জায়গাতে, ঐ বহিরাগত সুলতান বাদশাহরা ভারতকে পরাধীন করার পর তো অগাধ সম্পত্তির মালিক হয়েছিল। তারপরেও কেন রূপান্তরের সময় পূর্ববর্তী স্থাপত্য গুলোকে সম্পূর্ণরূপে গুঁড়িয়ে ফেলে সেই জায়গাতে নতুন করে তাদের ধর্মীয় ও বিজয় স্থাপত্য গুলো তৈরি করল না ? কেন তারা পূর্ববর্তী স্থাপত্য গুলোর অংশ বিশেষ রেখে দিল ? অগাধ সম্পদের মালিক হয়েও তারা কেন এই ভাবে অপরাধের প্রমাণ রেখে গেল ? ভারতীয়দের সঠিক ইতিহাস জানার ইচ্ছে ও উৎসাহকে ব্যাঙ্গ করা তথাকথিত শিক্ষিত, বুদ্ধিমান এবং বিদেশ থেকে আগত সুলতান বাদশাহপন্থীরা এই প্রশ্ন বারবার তুলছেন।
কেন তারা প্রমাণ ছেড়ে গিয়েছিলেন এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানতে টাইম মেশিনই সবচেয়ে বেশি সহায়ক হয়েত হত কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য বিজ্ঞান এখনও সেই রকমের কোন যন্ত্র আমাদের উপহার দেয়নি। তাই মোটামুটি কিছুটা ধারণার ভিত্তিতেই এর উত্তর খোঁজা যেতে পারে।
আমার ধারণা মূলত এই তিনটি কারণের জন্য তারা প্রমাণ ছেড়ে গেছেন বা বাধ্য হয়েছেন,
১- রাজত্ব করা সুলতান বাদশাহরা সকলেই বহিরাগত এবং মূলত ভারতকে লুঠ করতে আসার মানসিকতা নিয়েই এদেশে আসে। সেই জন্য তারা কখনই এই দেশের শিক্ষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, শাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি গ্রহণ করেনি। এই সব কিছুর জন্যই আরব বা পারস্য থেকে ইছলামি পন্ডিতদের তারা ডেকে আনত এবং তাদের থেকে বুদ্ধি নিয়ে সেগুলো ভারতীয়দের উপর চাপিয়ে দিত। এমতাবস্থায় আদি স্থাপত্য গুলো সম্পূর্ণ ভাবে গুঁড়িয়ে একদম গ্রীনফিল্ড প্রজেক্টের মতন নতুন কিছু তৈরি করলে তার খরচও অনেক বেড়ে যেত। যা লুঠ করা ধন সম্পত্তি থেকেই তাদের দিতে হত। তাই হতে পারে লুঠের ভাগ বেশি করে দিতে না চাওয়ায় প্রমাণ রেখেই তারা রূপান্তর গুলো করে ছিল।
২- শত্রু বা প্রতিপক্ষের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে সুপ্রাচীন একটা পদ্ধতি ছিল, তারা যুদ্ধে গিয়ে প্রতিপক্ষের একজনকে আহ্বান জানাত একক লড়াইর জন্য। তারপর সেই লড়াইতে সেই ব্যক্তিকে হারিয়ে দিতে পারলেই তার মুন্ডচ্ছেদ করে সেটি বল্লমের উপর রেখে প্রতিপক্ষের সেনাদের সামনে প্রদর্শন করা হত। এই পদ্ধতিতে খুব দ্রুত প্রতিপক্ষ সেনার মনোবল ভেঙে যেত এবং এরপর দ্রুত তাদের বশ্যতা স্বীকার করানো হত। এই স্নায়ু যুদ্ধের ফলে খুব সহজেই বার্তা দেওয়া হত, তোমাদের থেকে আমরা সুপিরিয়র। হতে পারে ভারতীয় ধর্মীয় স্থাপত্য গুলোর প্রাচীন অংশ গুলো রেখে দিয়ে সেই ধর্মস্থান গুলোকে রূপান্তর করে তারা ভারতীয়দের সেই স্নায়ুযুদ্ধের মতনই বার্তা দিত, যে দেখ তোমরা এবং তোমাদের উপাস্যের থেকে আমরা এবং আমাদের উপাস্য সুপিরিয়র, সুতরাং বশ্যতা স্বীকার করো।
৩- বহিরাগত সুলতান বাদশাহরা ভারতকে কমবেশি এক সহস্রাব্দ শাসন করলেও কখনই সম্পূর্ণ ভাবে পরাধীন করতে পারেনি। গোটা সহস্রাব্দ জুড়ে কখনও অহল্যা বাই, কখনও প্রতাপাদিত্য, কখনও রায় বাঘীনি, কখনও রামপেয়ারী গুজ্জর, কখনও রানা প্রতাপ, কখনও শিবাজী প্রমুখরা বিপুল পরিমাণে প্রত্যাঘাত করতেন। আর এই স্থানীয় প্রতিবাদিরা সর্বত্র ছিলেন, যার ফলে মধ্য এশিয়া বা উত্তর আফ্রিকার মতন প্রায় গোটা সহস্রাব্দ রাজত্ব্য করার পরেও শতভাগ দেশবাসিদের ধর্মান্তরিত করতে পারেনি। বেনারসের বর্তমানের জ্ঞানভাপি মসজিদের রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়ার সময় হাজারে হাজারে নাগা সন্নাসী তা রক্ষা করতে বিজাতীয় সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। হতে পারে এই ধরণের জনরোষ থেকে রক্ষা পেতে সুলতান বাদশাহরা দ্রুত রূপান্তরের কাজ সংগঠিত করেছিলেন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, যার ফলে অপরাধের প্রমাণ গুলো আজও সমহিমায় বর্তমান।
কারণ অনুসন্ধান করলে আরও অনেক কিছু জানা যেতে পারে। তবে তার জন্য অনুসন্ধান করা এবং করতে দেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। কোন জাতির সঠিক ইতিহাস জানার অধিকার নিঃসন্দেহে মৌলিক অধিকারের মতই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইতিহাসের শিক্ষার উপরেই নির্ভর করে কোন জাতির ভবিষ্যৎ। তাই সঠিক ইতিহাস অনুসন্ধানের এই প্রচেষ্ঠাকে সকলের উচিৎ সর্বৈব সমর্থন জানানো, তার ফলাফল যা ই হোক না কেন।
অনিক বোস