জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া ৩৭০ ধারাকে বিলুপ্ত করে এটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করার পরে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এখন নাগরিকত্ব (সংশোধন) বিলে সীলমোহর দিয়ে ভারতীয় জনগণের কাছে করা তাদের প্রতিশ্রুতিগুলি একে একে পূরণ করে চলেছে। বিরোধী দলগুলির বিরোধিতা সত্ত্বেও নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলটি সোমবার বিকেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ লোকসভায় উত্থাপন করেছিলেন, এবং বিতর্ক শেষে মধ্যরাতে তা লোকসভায় পাস হয়।
প্রকৃতপক্ষে, ১৯৫৫ সালে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করার জন্যই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল লোকসভায় আনা হয়েছে। এই বিলে আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সী এবং খ্রিস্টানদের কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এর ফলে ভারতে তাদের বসবাসের সময় ১২ বছরের থেকে কমিয়ে ৬ বছর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, এখন থেকে এই শরণার্থীরা ভারতে আসার ৬ বছর পরেই ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এই বিলে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-কে কাট-অফ ডেট হিসাবে রাখা হয়েছে। এখানে এটিও বোঝা দরকার যে এই বিলের আওতায় সরকার অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর সংজ্ঞা পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে।
বিলটি বর্তমানে সংসদের নিম্নকক্ষে, অর্থাৎ লোকসভায় পাস হয়েছে। লোকসভায় বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার ফলে যেখানে বিলটি পাস করতে কোনও অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়নি, তবে বিলটি পাসের ক্ষেত্রে রাজ্যসভার উচ্চকক্ষের লোকজন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। রাজ্যসভায় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই এবং কংগ্রেস সহ সমস্ত বিরোধী দল এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করছে। তবে বিজেপির জোট ছাড়াও, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, বিজেডি এবং আরও কয়েকটি দলও এই বিলকে সমর্থন করেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন কংগ্রেস, এনসিপি, এসপি, শিবসেনা সহ সমস্ত বিরোধী দল এই বিলের বিরোধিতা করছে? এর সহজ উত্তরটি হচ্ছে ভোট ব্যাংক। আসলে, নাগরিকত্ব (সংশোধন) বিলটি পাস হওয়ার ফলে হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন এবং পার্সী সম্প্রদায়ের লোকদের জন্য ভারতে নাগরিকত্ব পাওয়া অনেক সহজ করবে। তবে এটিই এই বিলের বিরোধিতা করার মূল কারণ নয়, এর মূল কারণ হল মুসলমান বা ইসলামে বিশ্বাসী লোকদের এই বিলে কোনও জায়গা দেওয়া হয়নি।
এখন এই পরিস্থিতিতে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে যে এটি একটি এজেন্ডার মতো কাজ করছে‚ যার মধ্যে ইসলামী দেশ থেকে আগত মুসলমানদের দেশে প্রবেশ করতে না দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এর অর্থ হল পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের মতো ইসলামিক দেশগুলি থেকে ভারতে আসা অমুসলিমদের নাগরিকত্ব (সংশোধন) বিলের আওতায় নাগরিকত্ব পাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মুসলমানদের নয়।
বিরোধীরা ধারাবাহিকভাবে অভিযোগ জানাচ্ছে যে এই বিল সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদের বিরোধী‚ যে অনুচ্ছেদটি সাম্যের অধিকারের কথা বলেছে । যদি আমরা বিরোধী দলের এই অভিযোগটি খতিয়ে দেখি তবে এই অভিযোগটি সহজেই খারিজ করা যায় কারণ ১৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শুধুমাত্র দেশের সমস্ত নাগরিকেরই সমতার অধিকার রয়েছে।
এখন যদি ইসলামিক দেশগুলি থেকে আগত অনুপ্রবেশকারীদের দেশের নাগরিকত্ব না থাকায় সংবিধান কথিত সাম্যের অধিকারও তাদের নেই। একই সাথে এটিও বোঝা দরকার যে সমস্ত ইসলামী দেশগুলিতে তাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভয়াবহ নৃশংসতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, যার কারণে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার একটি নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
তবে এর আগেই বিজেপির ইশতেহারে এই বিলের উল্লেখ করা হয়েছিল। বিজেপি তার ইশতেহারে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই নির্বাচন লড়েছে। ফলে এখন বিজেপি সরকার যদি এই ইস্যুটিকে নিয়ে এগিয়ে যায়, তবে এটি তাদের ইশতেহারের ঘোষণা পালন করা হবে।
ইসলামিক দেশগুলিতে সংখ্যালঘুদের আসল পরিস্থিতি বোঝার জন্য পাকিস্তান হলো সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। পাকিস্তানে আজও হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করার জন্য চাপ দেওয়া হয় । সেখানে বসবাসরত সংখ্যালঘু পরিবারগুলি মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। কারণটি অত্যন্ত সহজ, যদি মুসলিম না হয় তবে তাদের বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে।
পাকিস্তানে মা বোনেদের সম্মান থেকে শুরু করে সংখ্যালঘুদের জীবন পর্যন্ত সবই আজ বিপদে রয়েছে। শুধু পাকিস্তান নয়, বিশ্বের আরও অনেক মুসলিম দেশেই হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থাও মোটেই ভাল নয়। তাদের প্রতিনিয়ত নির্যাতন করা হয় এবং ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়।
পাকিস্তানে হিন্দুদের সাথে যা ঘটছে তা এখন কারও কাছেই গোপন নেই। অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে প্রতিদিন কোনো না কোনো হিন্দু পরিবারের একজন সদস্যকে ইসলামী মৌলবাদীদের শিকারে পরিণত হতে হচ্ছে। ধর্ষণ এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরের ঘটনাগুলি কয়েক বছর ধরে ক্রমাগতই বেড়ে চলেছে । এই কারণেই ইসলামী দেশগুলিতে বসবাসরত সংখ্যালঘুরা নিরাপদ স্থানের খোঁজে ভারত বা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাড়ি জমান। এই ঘটনা গুলিকে মিডিয়া বা সংবাদপত্রগুলোতে সুচারুভাবে চেপে যাওয়া হয়।
পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশন নিজেই একথা প্রকাশ করেছিলো যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সর্বদাই সন্ত্রাসের আবহে থাকতে বাধ্য হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ২০১০ সালে, ওড়কজায় নামক এলাকায় বসবাসকারী ১০২ জন শিখ পরিবারের প্রায় ২৫ শতাংশকেই তালিবানদের নির্দেশ অনুসারে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল।
পাকিস্তান-সহ এই সব ইসলামী দেশগুলিতে সংঘটিত সমস্ত সাম্প্রদায়িক অত্যাচারের ঘটনাতেই পুলিশ প্রশাসনের মনোভাবও সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক ছিল। ২০১০ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের সিনেটের সংখ্যালঘু বিষয়ক স্থায়ী কমিটি এ ধরনের ঘটনা রোধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানায় , কিন্তু দেখা গেছে সরকার সর্বদাই মৌলবাদীদের সমর্থন করে যায় । যদিও উপরের উদাহরণটি পাকিস্তানের, তবে প্রায় সমস্ত মুসলিম দেশগুলিতেই যখনই ধর্মান্ধ মুসলমানরা চাইছে তখনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার করছে।
ইসলামী দেশগুলিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নৃশংসতার যেসব ঘটনা সামনে আসে সেসবই ধর্ম ভিত্তিক। এই সমস্ত ইসলামী দেশে অমুসলিমদের ধর্মীয়ভাবে শোষণ করা হয়। তাদের নিজেদের ধর্ম বিশ্বাসের অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়।
যারা ইসলামকে বিশ্বাস করে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য অনেক ইসলামী দেশ রয়েছে, তারা সেখানে গিয়ে নাগরিকত্ব পেতেই পারে।
কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ‚ বিশেষত হিন্দুদের জন্য ভারত ছাড়া আর কোনও দেশ নেই, পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা আফগানিস্তান সহ অন্যান্য দেশের অত্যাচারিত মুসলমানরা ভারতে আসতে চাইলে (বালুচ, শিয়া সহ ) যদি তারা নিয়ম অনুসারে ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে ‚তবে ভারত সরকারের উচিৎ তাদের আবেদন বিবেচনা করা এবং নাগরিকত্ব প্রদান করা ।
তবে একটি বিষয় পরিষ্কার যে নাগরিকত্ব (সংশোধন) বিল ইসলামী দেশগুলিতে বসবাসকারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষে উপকারী। তবে এর সাথে এও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে ভারতে বসবাসরত মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকদের এই বিলের সাথে কোনও সম্বন্ধ নেই। তারা আগেও ভারতে যেমন সসম্মানে ছিলেন ‚ এর পরেও ঠিক তেমনই থাকবেন।