বরুণ বিশ্বাস কে ছিল সে তো তাও এখন মোটামুটি লোকে জানে। যে নারীবাদী নেকড়েরা নারীবাদ মানে বোঝেন স্বেচ্ছাচারের স্বাধীনতা, যে শাসক শাসন মানে বোঝেন নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়া কিংবা যে মানুষ অন্য কারুর মেয়ে ধর্ষিত হলে আগে জানতে চান সে ছোট জামা পরেছিল কিনা, রাতে বাইরে বেরিয়েছিল কিনা, তার রাজনৈতিক রং কি ছিল, তারা সবাই বরুণ বিশ্বাসকে চেনেন। কারন বরুণ বিশ্বাসরা বেঁচে থাকতে অনেকের বাড়া ভাতে ছাই দিলেও মরে গেলে তারা এখন অনেকের আখের গোছানোর অস্ত্র। তাই তো আজ “কমরেড সুশান্তের” দল সিপিএম পোস্ট দেয় বরুণ বিশ্বাসকে “তাদের লোক” বলে। কারন তারা ভাবে আমরা তো মানুষকে বরুণ বিশ্বাসের কথা জানতে দিইনি, তাই মানুষ কিছু জানেনা। এখন নির্লজ্জের মতো তাকে আমাদের লোক বলাই যায়।
বরুণ বিশ্বাস কে ছিলেন? বরুণ বিশ্বাস ছিলেন সেই প্রতিবাদী যুবক যিনি শাসকের চোখে চোখ রেখে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর হাতে বন্দুক ছিলনা, পাশে প্রশাসন ছিলনা। তাঁর কথা তুলে ধরার জন্য কোন মিডিয়াতে কোন মুখপাত্র ছিলনা। এমনকি তিনি যাদের হয়ে লড়তে নেমেছিলেন তাদের তো লড়ার জন্য সাহস দূরের কথা নিজেদের মানুষ বলে ভাবার ক্ষমতাটুকুও ছিলনা। তাও বরুণ বিশ্বাস লড়তে নেমেছিলেন। তাদের সাহস যুগিয়েছিলেন। রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের উপরে হওয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে। প্রশাসনকে বাধ্য করেছিলেন অসহায় মানুষগুলোকে বিচার দিতে। তাই তো প্রভাবশালী হলেও শেষ অব্দি সুশান্তর জেল হয়েছিল। শাসকের ছত্রছায়া তাকে বাঁচাতে পারেনি।
সুটিয়ার যেমন ছিল বরুণ বিশ্বাস, তেমনিই সোনাখালির ছিল লালু। সুটিয়ায় যেমন ছিল সুশান্ত, তেমনিই সোনাখালিতে ছিল ইশা লস্কর। একই শাসকের ছত্রছায়ায় একই রকম অত্যাচার তারা বছরের পর বছর চালিয়ে যেত। সেই অত্যাচারের শিকার ছিল কারা? উদ্বাস্তু হয়ে আসা নিম্নবর্ণের মেয়েরা। এমনিতে মেয়েরা মায়ের জাত। উঁচু, নীচু বলে কিছু সেখানে হতেই পারেনা। কিন্তু তাও নিম্নবর্ণ কথাটা ব্যবহার করলাম। কারন কারা যেন নিজেদের নিম্নবর্ণের রক্ষাকর্তা বলে দাবী করেন। সুশান্ত, ইশা এরা কিন্তু সেই “রক্ষাকর্তাদেরই” শাসন কায়েম রাখার হাতিয়ার। গণধর্ষন ছিল সেই হাতিয়ার।
এই মেয়েদের পাশে কোন রাজনৈতিক দল, কোন প্রভাবশালী কেউ ছিলনা। তাদের পাশে কখনও ছিল বরুণ, কখনও ছিল লালু। শাসক পাল্টেছে কিন্তু শাসনের পন্থা একই থেকে গেছে। কিন্তু বরুণ বিশ্বাস বা লালুদের মাথা নত করানো যায়নি। তাদের সাহস, তাদের জেদের কাছে মাথানত করতে হয়েছে শাসককে। বরং তাদের লড়াই সাহস জুগিয়েছে অত্যাচারিত মানুষগুলোকে। ভীতু মানুষগুলো একসময় শাসকের, প্রশাসনের চোখে চোখ রাখার হিম্মৎ জুটিয়েছে এদের নেতৃত্বে। তাই তো সরে যেতে হয়েছে বরুণ বা লালুকে। পৃথিবীর মাটি ছেড়ে তারা আকাশের নক্ষত্র হয়েছে। মানুষকে মুছে ফেলা যায় কিন্তু আকাশের নক্ষত্রকে তো আর মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তাই সেদিনের অত্যাচারী শাসক, আজকের অত্যাচারী শাসক আজ প্রাণপনে চেষ্টা করছে ওদের ঐতিহ্যের অংশীদারী পাওয়ার। কিন্তু বরুণ বিশ্বাস বা লালুর ঐতিহ্যের অংশীদারী পেতে গেলে তো সবার আগে দরকার মেরুদন্ডের। হে শাসক, তোমার মেরুদন্ড কোথায়?
আজ যখন শুনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় বা সুন্দরবনের নানা জায়গায় আবারও একই ঘটনা ঘটছে, তখন বিচলিত হই ঠিকই কিন্তু এও জানি কোন একদিন কোন বরুণ বিশ্বাস বা লালু ঠিক আসবে এই অত্যাচারের অবসান ঘটানোর জন্য। কারন পশ্চিমবাংলার গ্রামগুলো এখনও আছে। সেখানকার সব মানুষ এখনও নিজেদের মেরুদন্ড জমা রাখেনি। তাই অন্যায়ের প্রতিবাদ একদিন হবেই, অত্যাচারের অবসান একদিন হবেই।
ইত্যবসরে আমাদের মতো সাধারন মানুষদের কাজ একটাই। আগামীর বরুণ বা লালুদের পাশে দাঁড়ানো সাধ্যমতো। তাদের কথা সমাজের কাছে তুলে ধরা বারেবারে। যাতে একদিন অত্যাচারী শাসকও বাধ্য হয় এদের ঐতিহ্যের কাছে মাথা নত করতে। যেমন আজ অত্যাচারী মাথানত করছে বরুণ বিশ্বাসের সামনে। আমাদের বোঝাতে চাইছে বরুণ বিশ্বাস “তাদেরই লোক”।
দীপ্তস্য যশ