পাঁচ শিক্ষিকা শিক্ষা দফতরের দুয়ারে গিয়ে বিষ খেলেন ।
তিনজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আর জি করে, দু জনকে এন আর এসে ভর্তি করা হল । একসঙ্গে ৫ জনকে একই হাসপাতালে না নিয়ে যাওয়ার কারণ যাতে হাসপাতালেও বিক্ষোভের আঁচ একত্রিত না হয় । বুদ্ধিটা পুলিশের কর্তাদের পাঠানো হয় নবান্ন থেকে ।
রাতে স্বাস্থ্য ভবনের প্রেস রিলিজ পেলাম – সবার অবস্থাই স্থিতিশীল ।
ওদিকে সংবাদে দেখলাম – বিকাশ ভবনে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টার পর বিশাল কনভয় নিয়ে এ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী বাবু ব্রাত্য বসু নিজের চেম্বারে ঢুকলেন । তাঁর কোন প্রেস স্টেটমেন্ট পাওয়া যায়নি রাত পর্যন্ত । অনেক সাংবাদিক তাঁকে টেক্সট করেছেন । কিন্তু উত্তর দেননি ব্রাত্য । বুদ্ধিমান মানুষ তো । বাস্তবটা বোঝেন । ঘোর অন্ধকারেও মঞ্চ থেকে দর্শকের মন এবং চোখ দেখা তাঁর প্রফেসনাল প্র্যাক্টিস । সেই অনুযায়ী ডায়ালগ ছোঁড়া, নিয়ন্ত্রণ করা দীর্ঘদিনের অভ্যাসটা কাজে লাগালেন ব্রাত্য । নীরব রইলেন, অসীম আনুগত্যে । সরকারের সীমাহীন অপরাধের দায় নিজে নিলেন না ।
তাহলে দায় কার ? এস এস কে, এম এস কে বৃত্তিমূলক শিক্ষিকাদের মাইনে মাসে দশ হাজারের আশে পাশে । যা সারা ভারতে সব থেকে কম । টাকাটা কে দেয় ? দিল্লী থেকে সমগ্র শিক্ষা অভিযানে যে বছর ভোর কয়েক হাজার কোটি টাকা মেলে তার থেকেই মাইনে পান এঁরা । পার্শ্ব শিক্ষকরাও । সব রাজ্যই এ ভাবে পায় এবং দেয় । পশ্চিমবঙ্গ সরকারও পায় । কিন্তু দেওয়ার বেলা হাত মুঠো করে নেন কেন তাঁরা ? বাকি টাকাটা তাহলে যায় কোথায় ? কে নেয় ?
একটা তথ্য দিই । আগেও দিয়েছি । প্রাথমিকের পার্শ্ব শিক্ষকদের জন্য কেন্দ্র মাথা পিছু পাঠায় ১৫ হাজার টাকা মাসে, রাজ্যের দেওয়ার কথা ১০ হাজার টাকা । একজন পার্শ্ব শিক্ষকের পাওয়া উচিত ২৫ হাজার টাকা । বাস্তবে তাঁদের দেওয়া হয় কত জানেন ? ৮৮০০ টাকা । এঁরা খেপবেন না ? দিল্লী, হরিয়ানা, পাঞ্জাব,গুজরাট, উত্তর প্রদেশে এঁরা পান ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা মাসে । বাংলায় সেটা ৮৮০০ টাকা । টাকাটা যায় কোথায় ?
আরও একটা উদাহরণ দিই । উচ্চ প্রাথমিকে একজন পার্শ্ব শিক্ষকের পাওয়া উচিত ৪০ হাজার টাকা । পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা পান কত ? পান ১১ হাজার ৩০০ টাকা । এঁরা খেপবেন না ? সমগ্র শিক্ষা অভিযান থেকে উচ্চ প্রাথমিকের শিক্ষকদের মাথা পিছু মাসে বরাদ্দ হয় দিল্লী থেকে ২৫ হাজার টাকা । রাজ্যের দেওয়ার কথা ১৫ হাজার টাকা । এঁদের মিনিমাম পাওয়ার কথা চল্লিশ হাজার টাকা । পান কত ১১ হাজার ৩০০ টাকা । বাকিটা যায় কোথায় ?
এস এস কে, এম এস কে, শিক্ষা বন্ধু, স্পেশ্যাল এডুকেটর, পার্শ্ব শিক্ষক সবার অবস্থাই এক । যা পাওয়ার কথা তার এক চতুর্থাংশ এঁরা পাচ্ছেন । বছরের পর বছর এঁরা আন্দোলনে । এঁদের আন্দোলন বাম আমল থেকেই । সম্ভবত তারিখটা ছিল ৬ ই অক্টোবর, ২০০৯ । রাণী রাসমণি রোডের এমন একটি আন্দোলনে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন মমতা । বলেছিলেন, প্রশ্ন তুলেছিলেন অন্য রাজ্য যদি দিতে পারে বাম সরকার কেন দেবে না ?
আজ এই একই প্রশ্ন তাঁদের যাঁরা আন্দোলনে লড়ছেন । কিন্তু তাঁদের কথা শুনবে কে ? বিকাশ ভবনে গেলে ব্রাত্য বসুকে পান না । জানতেও পারেন না তিনি রিহার্সালে না ত্রিপুরায় । কালীঘাটে সোজা পথে গেলে ৪০০ মিটার দূর থেকেই ব্যারিকেডে আটকে যান । অগত্যা কালীঘাটের টালি নালায় নেমে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন । তাতেও হুঁশ ফেরে না সরকারের । ব্রাত্য বসুর বাড়ি গেলেও দেখা পান না তাঁর । অগত্যা গিয়েছিলেন নবান্ন । ১৭ জন শিক্ষিকা । যদি ভুল করেও মমতা ডেকে পাঠান । পাঠান নি । উল্টে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় লালবাজার । এবং কঠিন মামলা । শেষে ১৭ জনকেই বদলি করা হয় রিমোট অঞ্চলে । চারশো, ছ শো কিলোমিটার দূরে । যেমন নামখানা থেকে কুচবিহার বর্ডার । যেতে পারবেন না, শেষে চাকরিটা হারাবেন । সেই শাস্তি ।
ঠিক এই অবস্থাতেই বিষ পান করলেন আজ বিকাশ ভবনে অভিনেতা নাট্যকার শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর দফতরের সামনে গ্রাম বাংলার ৫ শিক্ষিকা ।
ভাবছিলাম মমতা যদি আজ বিরোধী নেত্রী হতেন কি করতেন ? এই সন্ধ্যেবেলায় ? সটান চলে যেতেন এন আর এস আর আর জি করে । বসে পড়তেন আন্দোলনে । হৈ হৈ হত । সারা সন্ধ্যেটা সব চ্যানেলে টেলিকাস্ট হত । পরের দিন সব কাগজে হত হেড লাইন প্রথম পাতায় ” বিষ পান ৫ শিক্ষিকার, মমতা পথে” ।
আর আজ ৫ শিক্ষিকা যখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছেন তখন টি ভির সুইচ অন করুন । চ্যানেল গুলো দেদার ঘণ্টা খানেক, ক্রস ফায়ার, জনতার দরবার আফগানিস্থানে আপনার চোখ ঘুরিয়ে রেখেছে ।
বিষ পানের সংবাদের মাঝে শাসক এবং বিরোধীরা ফোনে প্রেস বাইট দিচ্ছেন বিষ পান নিয়ে । অকাতরে ।
অনেক রাতে একটি চ্যানেল শেষে দেখাচ্ছে ফরেনসিক লোকজন লম্বা লম্বা টর্চ নিয়ে বিকাশ ভবনের সামনে রাস্তায় পড়ে থাকা “বিষ” খুঁজছেন, খুঁজেই চলেছেন ।
সামনে থাকলে বলতাম দাদা সময় নষ্ট না করে নবান্নে চলে যান । যা খুঁজছেন চট করে পেয়ে যাবেন ।
রাত গভীর, অন্ধকার গাঢ়, তাই যাওয়াও হয়নি । বলাও হয়নি, মনের কথাটি ।
সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় ( ৯৮৩০৪২৬০৭৮)