পাসমান্দা মুসলিম কারা এবং কেনই বা আগামী লোকসভা নির্বাচনে এই সমুদায় একটি রাজনৈতিক ইস্যু হতে চলেছে। এই বিষয় নিয়ে আমি সময়ে সময়ে লিখতে থাকব। তবে বিষয়টা যেহেতু অনেকের কাছে নতুন তাই আপাতত খুব প্রাথমিক পর্যায়ে এই নিয়ে আলোচনা করব।
বিগত ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৮ শতাংশ মুসলমান বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। এই ৮ শতাংশ হলেন পাসমান্দা মুসলমান। এর পর থেকেই বিজেপি দলের মধ্যে এই নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু হয়ে যায় যে পাসমান্দা মুসলমানরা যদি পাসমান্দা হিসেবে ভোট করেন তাহলে মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। কারণ এযাবৎ এই পাসমান্দারা আশরাফিয়াদের কথায় ভোট দান করে এসেছেন। এমন কি কংগ্রেসের যত উচ্চস্তরীয় মুসলিম নেতারা আছেন প্রায় সকলেই আশরাফিয়া। অথচ সংখ্যার দিক থেকে আশরাফিয়ারা মুসলিম সমাজের ১৫ শতাংশ মাত্র। এই আশরাফিয়া সম্প্রদায় সামাজিক ও আর্থিক দিক থেকে অগ্রগামী। সেই সঙ্গে দীর্ঘ দিনের কংগ্রেস রাজত্বে এই আশরাফিয়ারা মুসলিম সমাজকে ভোটব্যাঙ্ক করে রেখে যত রকমের সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছেন তাতে করে আশরাফিয়া নেতাদের ভাগ্যটাই পাল্টে গেছে। অর্থাৎ পাসমান্দা সমাজের ভোটকে আশরাফিয়াদের জায়গির বলা চলে। কিন্তু যাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে বারবার কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেস কিংবা আরজেডি দলের নেতারা ক্ষমতায় থেকে বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছেন সেই পাসমান্দা সমাজ কিন্তু বর্তমানে ভারতের সবচাইতে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়। এমন কি হিন্দু দলিতদের অবস্থাও এদের চাইতে ভালো।
প্রশ্ন হলো যে মুসলিম সমাজে কি জাতিভেদ প্রথা আছে। আশরাফিয়ারা প্রচার করেন যে তা নেই অথচ বাস্তবে কিন্তু আছে। এমন কি আল্লামা ইকবাল মুসলিম সমাজে সকলেই সমান বলে কবিতা লিখেছেন বটে কিন্তু বাস্তবে উচ্চবর্ণের ও নিম্নবর্ণের মুসলমান আছে। উচ্চবর্ণের মুসলমানরা হলেন আশরাফিয়া যারা বাইরে থেকে এসেছিলেন কিংবা এক সময়ে ভারতে মুসলিম শাসনের ভাগীদার ছিলেন। এছাড়া এদেশের যে সব উচ্চবর্ণের হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তাদেরও আশরাফিয়া বলা হয়। সংখ্যায় এরা পুরো মুসলিম সমাজের ১৫ শতাংশ হলেও এরাই মুসলিম সমাজের নেতৃস্থানীয়। এই ১৫ শতাংশের কথায় পুরো মুসলিম সমাজ চলে। এরা মুসলিম সমাজের সংরক্ষণ চায় কারণ জানে যে এই সংরক্ষণের পুরো ফায়দা এরাই নেবে। কিন্তু যখন পাসমান্দা মুসলমানের সংরক্ষণের কথা আসে তখন বলে মুসলিম সমাজে জাতিভেদ নেই। সকলেই সমান বলে ইকবালের কবিতা আওড়ায়। এরাই মূলত পাসমান্দা মুসলমানদের নেতা হওয়ার কারণে ভারতের ৮৫ শতাংশ মুসলমানরা পৃথিবীর সবচাইতে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়। যারা মনে করেন যে মুসলিম সমাজে জাতপাত নেই তাদের জানিয়ে রাখি যে আশরাফিয়া ও পাসমান্দা মুসলিমদের মধ্যে কোন বৈবাহিক সম্পর্ক নেই। যেখানে এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরেক সম্প্রদায়ের বিয়ে শাদী হয় না সেখানে কোন অবস্থাতেই এই ধর্মীয় সমাজ সামাজিক দিক থেকে এক তো হতে পারে না। এছাড়া দলিত মুসলমানরা যে মুসলিম সমাজেই অচ্যুত এই কথা কিন্তু অনেকেই বলেছেন।
পাসমান্দাদের মধ্যে দুটি সম্প্রদায় হলো আলতাফ ও আরজাল। পাসমান্দা একটি পার্শি শব্দ যার অর্থ হলো left behind অথবা পিছিয়ে পড়া। হিন্দিতে যাকে বলে পিছড়ে বর্গ। এর মধ্যে যারা নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছেন তারা হলে আজলাফ এবং যারা দলিত ও অচ্যুত হিন্দুদের থেকে মুসলমান হয়েছেন তারা হলেন আরজাল। এই আজলাফ ও আরজাল সম্মিলিত ভাবে মুসলিম সমাজের ৮৫ শতাংশ। এই পাসমান্দাদের আশরাফিয়াদের থেকে পৃথক করেই লালু যাদব ও মায়াবতী ক্ষমতায় এসেছিলেন এবং উত্তর প্রদেশ ও বিহারে কংগ্রেসকে সাফ করে দিয়েছিলেন। উত্তর প্রদেশে আরজাল মুসলমান যারা দলিত থেকে ইসলাম ধর্মে এসেছিলেন তারা এক সময়ে বহুজন সমাজের মায়াবতীকে সমর্থন করতেন। আর আজলাফরা সমর্থন করতেন সমাজবাদী পার্টির মুলায়েম সিং যাদবকে। বর্তমানে পাসমান্দা মুসলিম সমাজ নামের সংগঠনের প্রেসিডেন্ট আনিস মনসুরি বলেছেন যে তারা উত্তর প্রদেশে বহুজন সমাজ ও সমাজবাদী পার্টিকে সমর্থন করে কিছুই পাননি। বরং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলে তাদের জীবনযাত্রার উন্নতি ঘটেছে। এছাড়া যোগী আদিত্যনাথ তাদের জন্য অনেক ধরণের উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন যা এযাবৎ কংগ্রেস কিংবা অন্য কোন দল করেনি। এই কারণে কিছুদিন আগে বাই-ইলেকশনে রামগড় ও আজমগড়ের মতো মুসলিম অধ্যুষিত নির্বাচনী ক্ষেত্রে বিজেপি প্রার্থীরা জয়ী হয়ে যান যা এক সময়ে সমাজবাদী পার্টির গড় ছিল। তাই বর্তমানে বিজেপি দলের নেতারা মুসলিম ভোটে ছেদ সৃষ্টি করে কিছুটা নিজেদের দিকে টেনে নিতে পাসমান্দাদের আলাদা করে সম্বোধন করছেন। নরেন্দ্র মোদী প্রকাশ্য জনসভায় পাসমান্দাদের আলাদা করে তাদের নিজেদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করতে বলেছেন। কারণ একটা কথা সকলেই জানেন যে পাসমান্দারা যদি আশরাফিয়াদের থেকে আলাদা হয়ে যান তাহলে আসাদউদ্দিন ওয়েসির মতো অনেক নেতারই রাজনৈতিক দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।
ধর্ম পরিবর্তন হয়ে গেলেও একটা মানুষের সব কিছু পরিবর্তন হয়ে যায় না। এখানে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমি নাম ভুলে গেছি তবে খুব সম্ভব কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি যিনি খ্রিস্টান হয়ে যাবার পর আরেক খ্রিস্টানের সঙ্গে তার কন্যার বিয়ে দিতে রাজি হোন নি কারণ সেই খ্রিস্টান যুবকের পরিবার খ্রিস্টান হওয়ার আগে ব্রাহ্মণ ছিল না। অর্থাৎ খ্রিস্টান হয়ে যাবার পরেও তিনি সেই খ্রিস্টানের সঙ্গে তার কন্যার বিয়ে দেবেন যে ওনার মতো ব্রাহ্মণ থেকে খ্রিস্টান হয়েছে। অর্থাৎ বাঙালী খ্রিস্টানদের মধ্যে বিয়ে শাদীর ব্যাপারে দীর্ঘকাল ধরে বামুন কায়েত ছিল। ভারতের মুসলিম সমাজে এই জাত বিচার এখনও আছে। তারেক ফাতাহ এই নিয়ে টেলিভিশনে একটা প্রোগ্রাম শুরু করেছিলেন। কাজেই মুসলিমদের মধ্যে যেমন দলিত সমাজ আছে তেমনি খ্রিস্টানদের মধ্যেও দলিত সমাজ আছে।
১৯৫০ সালে যখন হিন্দু নিম্নবর্ণকে অনুসূচিত জাতি হিসেবে সংরক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল তখন অন্যান্য ধর্মের মানুষের এই সংরক্ষণের সুবিধা দেওয়া হয়নি কারণ সেই সব ধর্মে নাকি জাতপাত নেই। সকলেই সমান। অথচ গ্রাউন্ড রিয়েলিটি তা ছিল না। বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিতেন আশরাফিয়া সম্প্রদায় যারা উচ্চবর্ণ হিসেবে স্বীকৃত। এরাই নিম্নবর্ণের মুসলমানদের সংরক্ষণ দেবার আপত্তি জানিয়েছে প্রথম থেকেই। বিশেষত কংগ্রেস দলের যত নেতারা আছেন তাদের প্রায় সকলেই আশরাফিয়া অর্থাৎ উচ্চবর্ণের। এদের খাতির খুব বেশি ছিল কারণ নিম্নবর্ণের পাসমান্দা মুসলমানরা এদের কোথায় ভোট দেন। দিল্লীর জামা মসজিদের ইমাম থেকে বাদবাকি যত নামীদামী ইমামরা আছেন সবাই আশরাফিয়া। এরা মুসলিম সমাজে জাতপাত নেই বলে যে প্রচার চালিয়েছেন তার ফলে পিছিয়ে পড়া মুসলমানরা সরকারি সুযোগ সুবিধা বিশেষ পাননি। এই কারণেই দলিত মুসলমান কিংবা দলিত খ্রিস্টানদের চাইতে দলিত হিন্দুদের অবস্থা বর্তমানে অনেক ভালো অথচ এক সময়ে তাদের অবস্থা প্রায় একই রকমের ছিল।
পাসমান্দা মুসলমানরা কেন আশরাফদের কথায় ভোট দেন এই নিয়ে পাসমান্দা সমাজের একজন মহিলা নেত্রী তথা সোশিয়েল অ্যাক্টিভিস্ট আমানা আনসারি বেগম বলেছেন যে এই আশরাফিয়াদের কাজ হলো ক্রমাগত পাসমান্দা সমাজের লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়া যে বিজেপি তোমাদের খেয়ে ফেলবে। এমনি কি যদি কোন মুসলিম গুণ্ডা, বদমাশ, ধর্ষক কিংবা খুনিকেও বিজেপি সরকার শাস্তি দেয় তাহলেও তারা এটাকে ধর্মের রঙ চড়ায়। অথচ এই আশরাফিয়ারা কোনদিন আমাদের আর্থিক কিংবা সামাজিক স্তরের বৈষম্য নিয়ে চিন্তা করে না। তবে আশরাফিয়ারা তাদের ইকো সিস্টেমে কিছু হিন্দু সাংবাদিককেও রেখেছে যাতে যাতে বলতে পারে যে দ্যাখো হিন্দুরাই তো বলছে। এই কারণে কিছু পাসমান্দা সংগঠন ধীরে ধীরে তাদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আশরাফিয়াদের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এই পৃথক হয়ে যাওয়াটা কোন খারাপ জিনিস নয় কারণ ফুল যখন কুঁড়ি অবস্থায় থাকে তখনই তার সমস্ত পাপড়িগুলো একসঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু ফুল যখন ফুটে তখন এই পাপড়িগুলো নিজেদের অবস্থানের কথা বুঝতে পেরে একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে দূরত্ব বজায় রাখে বটে তবে গোঁড়ার দিকে একই বৃন্তে যুক্ত হয়ে থাকে। তাই মুসলিম সমাজের ফুল যখন ফুটছে তখন পাসমান্দা ও আশরাফিয়াদের সমস্যাকে আলাদা করে দেখা হবে এটা নিশ্চিত। কারণ এই দুই সম্প্রদায়ের সমস্যা এক নয়। এখন পাসমান্দা সংগঠনগুলোর সঙ্গে বিজেপি একজোট হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদী এই নিয়ে একটি বড় ধরণের পরিকল্পনা করেছেন। আপাতত উত্তর প্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ পাসমান্দা নেতাকে নিজের মন্ত্রীমণ্ডলে সামিল করে সমাজবাদী পার্টির গড়ে ছেদ করে দিয়েছেন যার ফলে রামপুর ও আজমগড়ে বিজেপি জয়লাভ করেছে। আগামী দিনে হয়ত বা আরো অনেক কিছুই ঘটতে পারে।
????️ রজত কান্তি দাশ।