১৯১৯ সালের বিজয়ার আনন্দ মরশুম। কোয়ালপাড়া থেকে কেদার মহারাজ (স্বামী কেশবানন্দ) জয়রামবাটিতে মায়ের কাছে এসেছেন প্রণাম করতে। কথায় কথায় মহারাজ মা-কে ঠাকুরের আবির্ভাব উদ্দেশ্য নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ঠাকুর কি এবার সর্বধর্মসমন্বয়ের মতো নতুন ভাব দেবার জন্য এসেছিলেন?
মা-এর তা মনে হয় নি। তিনি পরিষ্কার বললেন, “দেখো বাবা, তিনি যে সমন্বয়-ভাব প্রচার করবার মতলবে সব ধর্মমত সাধন করেছিলেন, তা কিন্তু আমার মনে হয় নাই। তিনি সর্বদা ভগবদ্ভাবেই বিভোর থাকতেন। খ্রিস্টান, মুসলমান, বৈষ্ণব — যে যে-ভাবে তাঁকে সাধনা করে সেই বস্তু লাভ করে, তিনি সেইসব ভাবে সাধনা করে নানা লীলা আস্বাদন করতেন, দিনরাত কোথা দিয়ে কেটে যেত, কোন হুঁশ থাকত না তাঁর। তবে কি জানো বাবা, এই যুগে, এই কালে তাঁর ত্যাগই হলো আদর্শ “
শ্রীমা বোঝালেন কামিনী কাঞ্চন ত্যাগ করে সেবার আদর্শ প্রচারই শ্রীরামকৃষ্ণের মর্ত্য আগমনের মূল উদ্দেশ্য। ত্যাগ কেমন? শ্রীরামকৃষ্ণ মা সারদা-কে জিজ্ঞেস করছেন, “তুমি আমায় সংসারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছ?” মা বললেন, “তোমার জীবনব্রতে সহায় হতে এসেছি।” ঠাকুর বলতেন “টাকা মাটি মাটি টাকা”। যে দর্শনে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা নেই, যে মানুষের মধ্যে অাসুরিক শক্তিতে নারীকে জোর করে ভোগ করার স্পৃহা, অন্য সম্প্রদায়ের সম্পদ জোর করে লুন্ঠন করার বাসনা, তার/তাদের প্রতি ঠাকুরের কোন আগ্রহ থাকতে পারে না।
রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনের গনগনে রোদ্দুরে যখন ঠাকুর-মা-স্বামীজির সামীপ্যে আসা বহু মানুষ জীবিত; সেই অবস্থায় কেন নতুন করে প্রয়োজন ঘটলো ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ’-এর মতো সন্ন্যাসী-সঙ্ঘের? “যত মত তত পথ”-এর বাণীতে বহুধা বিভক্ত হিন্দু সমাজের তো কাছে আসার কথা ছিল! তবে কেন হিন্দু সমাজকে ডাক দিয়ে ‘শক্তি-সংগঠন-সেবা-সমন্বয়-সংযম’-এর আদর্শে ফের তৈরি করতে হল ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ’?
তার কারণ হল, দেব-অসুরের দ্বন্দ্ব সমাস। অমর-পথে আসুরিক শক্তি বা হিংস্র-মতের কথা থাকতে পারে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল হিন্দু সমাজের একাংশ, কিন্তু কথার বিতর্কে তা ভেসে উঠতে পারে নি। মায়ের এই বিচার আমাদের আবারও ভাবিয়ে দেবে, যারা ” যত মত তত পথ” বাণীকে উপজীব্য করে একটি বিশেষ সুবিধাবাদী আগ্রহের পরিমন্ডল তৈরি করেন, অথচ ঠাকুর-মা-স্বামীজির মতো ‘ত্রয়ী ঐশী চেতনা’ ও রামকৃষ্ণ সঙ্ঘকে নিয়ে নানান সময়ে নানান অন্যায্য ও অনৈতিক কথা বলেছেন, বাণীটি সম্পর্কে তাদের ব্যবহারিক উদ্দেশ্য মহৎ নয়।
আজকের মাতৃ-স্মরণ দিবসে, শ্রীমার প্রয়াণ দিবসে নতুন করে ভাবনার জগৎ খুলে দিতে হবে। প্রস্তুত নিবন্ধ-লেখকের মতে, “যত মত তত পথ” বাণীর মধ্যে হিন্দু ধর্মের বহুতর শাখার মধ্যেই মূলত সমন্বয়ের ভাবনা৷ এটি প্রকৃতপক্ষে হিন্দু সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার বাণী। হিন্দু-বীর-সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ এই হিন্দুত্বের প্রচারেই বিশ্বজয় পেয়েছিলেন।
(তথ্যসূত্র : মাতৃসান্নিধ্যে — স্বামী ঈশানানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ কার্তিক ১৩৭৫, তৃতীয় সংস্করণ মাঘ, ১৪১০, ১০ ম পুনর্মুদ্রণ পৌষ ১৪২১ : পৃষ্ঠা ১০৭-১০৮)
কল্যাণ গৌতম।