কী খাব-কেন খাব, কোনটা খাঁটি, কোনটা ভেজাল : ঠিক করার দায়িত্ব ক্রেতাদেরই

Story image

“খাইখাই কর কেন, এস বস আহারে,
খাওয়ার আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে।
যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালীর ভাষাতে,
জড় করে আনি সব, থাক সেই আশাতে।”

সুকুমার রায়ের এই ছড়া পড়ে আমরা যতই হেসে লুটিয়ে পড়ি না কেন, মনে রাখতে হবে এটি একটি ব্যাঙ্গাত্বক ছড়া। বাঙালির খাদ্যাভ্যাস নিয়ে ব্যঙ্গ করেই তিনি এটি লিখেছিলেন। আমরা শুধুই খাইখাই করি কিন্তু, আদৌ কি জানি, 

কী খাব, কেন খাব, কীভাবে খাব, কখন খাব? 
কোনটা খাঁটি, কোনটা ভেজাল?

রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন বলেছিলেন, খাদ্যে ভেজাল মেশানো সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য সমাজবিরোধী কাজ। ভেজালের বহু পুরোনো ইতিহাস আছে। প্রাচীন রোমে খাদ্য ও পানীয়ের রং তদারকি করার জন্যে পরিদর্শক রাখা হয়েছিল। ইংল্যান্ডে এডওয়ার্ডের আমলে মদে ভেজাল দেওয়ার অপরাধে মদ প্রস্তুতকারীকে ঘোড়ার পিছনে বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছিল। ভেজাল নিয়ে শাস্তির নানা উদাহরণ তৈরি হলেও, তা নিয়ে সংগঠিত জনমত তৈরি হতে কিন্তু বেশ সময় লেগেছিল। উনিশ শতকের ৩-এর দশক নাগাদ এই সচেতনতা প্রথম লক্ষ্য করা যায়। ১৮৩২ সালে Lancet পত্রিকার ড. টমাস ভেজালের বিরুদ্ধে প্রথম সারা বিশ্ব জুড়ে আন্দোলন শুরু করেন। ১৮৬০ সালে ব্রিটেনে তৈরি হয় ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডালটারেশন অ্যাক্ট – ১৮৬০’। অন্যদিকে, আধুনিক ভারতে ভেজাল নিয়ে নজরদারির শুরু স্বাধীনতার কিছু পরেই। ১৯৫৪ সালে তৈরি হয় ‘খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণ আইন’ (Food Adulteration Act- 1954)। যেখানে ভেজালের সংজ্ঞা, ভেজাল নিয়ে নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ ও ভেজালের অপরাধে কড়া শাস্তিবিধানের কথাও বলা আছে। কিন্তু আদতে তার প্রায় কোনো কিছুই কার্যকরী নয়। এ বিষয়ে যাবতীয় তথ্য দেওয়া আছে ডিআরসিএসসি (DRCSC – Development Research Communication and Services Centre)-এর বই ‘খাঁটি ভেজালের খোঁজে’-তে।১৯৮২ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ তথা দেশের নানা জায়গায় উন্নয়নমূলক কাজ করে চলেছে এই সংগঠন (ডিআরসিএসসি)। লক্ষ্য, প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ক্ষুদ্র-প্রান্তিক-ভূমিহীন কৃষকের খাদ্য ও কাজের জোগান সুনশ্চিত করা। যে লক্ষ্যের পথ হবে সামাজিক ন্যায়-নির্ভর, সহভাগী, পরিবেশ-বান্ধব ও অর্থনৈতিক ভাবে উপযুক্ত। ডিআরসিএসসি-র প্রকাশনা বিভাগ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর যৎসামান্য মূল্যের বেশ কিছু চটি বই প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ‘খাঁটি ভেজালের খোঁজে’। এখনকার বাজারে কোনটা খাঁটি, কোনটা ভেজাল – বোঝা দুর্বোধ্য মনে হলেও ভেজাল চেনার বিভিন্ন উপায় আছে। পরীক্ষাগার তো রয়েইছে এছাড়াও, নিজে পরীক্ষা করে ভেজাল ধরতে পারবেন, এমনও অনেক পন্থা রয়েছে। এ বিষয়েও বিশদে, সহজবোধ্য ভাষায় তথ্য রয়েছে বইটিতে। তবে, এই লেখা ভেজাল নিয়ে বিশদ আলোচনার জন্য নয়।   আজ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে কী খাব, কেন খাব, কীভাবে খাব, কখন খাব।

প্রথমেই বলি, কেন খাবো?

বেঁচে থাকতে হলে খেতে হবে, তাই খাব। খিদে পেলে খেতে হবে, তাই খাব। লোভনীয় কিছু দেখলেই খেতে ইচ্ছে হয়, তাই খাব। হ্যাঁ, সাধরণ ভাবে প্রায় সকলের কাছে উত্তর এইরকমই। কিন্তু কেন খাব’র বিষয়টি এতটা হালকা ভাবে না দেখে যদি একটু গভীর ভাবে বোঝার চেষ্টা করি তাহলে উত্তরটা হয়, জীবন যাপনের জন্য খাব তো নিশ্চয়ই একই সঙ্গে শরীরের সুস্থতার বিষয়টা আগে প্রাধান্য দিতে হবে। আমাদের খাদ্য সংস্কৃতি ও রুচি যাই হোক না কেন, ২০ – ৪০ – ৩০ – ১০ এই ভাগ অনুযায়ী যে দৈনন্দিন খাদ্য পরিকল্পনা তৈরি করে নিলে, আমাদের শরীরের গঠন ও বৃদ্ধিতে সঠিক ভাবে সাহায্য করতে এবং সমস্ত রকম কাজের জন্য শক্তি জোগাবে। আধুনিক ভোগবাদে খাবার যত বেশি আমোদ প্রমোদের বিষয় হয়ে উঠেছে তত খাদ্যের মধ্যে ওষধিগুণ কমেছে বলে সেই ভূমিকাগুলি গৌন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে প্রাকৃতিক ও জৈব কৃষিজ উৎপাদনে সকল খাদ্যকে আমরা বিশিষ্ট ওষধিগুণ সমৃদ্ধ ভাবে পাই। 

কী খাবেন? 

• খাদ্যাভ্যাস ও রুচি অনুযায়ী খাবার খাওয়ায় কোনও আপত্তি নেই। শুধু পরিবারের জন্য একটি পুরো দিনের খাবারের কথা যখন ভাববেন এই বিষয়গুলোকে মাথায় রাখার চেষ্টা করুন-

• ধবধবে সাদা ভাত একদম নয়। আমরা বাজার থেকে সাধারণত যে চাল কিনি, তা তৈরি সময় মেশিনে বাদ হয়ে যায় ফাইবার ও হেলদি আন স্যাচুরেটেড ফ্যাট যুক্ত জার্ম –চালের গুরত্বপূর্ণ দুটি স্তর। 

• ময়দা একদম নয়। আটার রুটি যেন ব্রান যুক্ত হয়। ময়দা মূলত স্টার্চ কার্বহাইড্রেট, যেটি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো।

• বেশি ফাইবার ও বেশি প্রোটিন যুক্ত খিচুড়ি, মাল্টিগ্রেন মিক্স খান। মাঝে মাঝে ডালিয়া খান। 

• ডালের মধ্যে একটু খোসা রেখে খান। এতে শরীরে ফাইবারের ঘাটতি পূরণ হবে। স্বাদেও ডাল ভালো হবে, পুষ্টিগুণ অনেকটা বেড়ে যাবে।

• সারাদিনের খাবারে চল্লিশ ভাগ থাকুক মরসুমি সবজি দিয়ে তৈরি তরকারি ও কিছু ফল। বিভিন্ন ধরনের টাটকা শাক সারা সপ্তাহ ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খান। বাজারে সহজলভ্য নটে, পুঁই, পালং কিংবা কলমি ছাড়াও পিড়িং, আমরুলী, পুনর্ণবা, আপাং, লুনে, ইন্দ্রমারিস, আতাড়ি-পাতাড়ি, দুলপী, শুষনি – যেমন নামের বাহার, তেমনই পুষ্টিগুণ বাংলার শাকপাতার। রং বেরঙের সবজি খান, কিন্তু কৃত্রিম রং করা যে কোনও খাবার পারলে এড়িয়ে চলুন। কিন্তু, এইসব রং-অ্যাসিড আসছে কোথা থেকে? কে দিল এসব ব্যবহারের অনুমতি? ১৯৫৪ সালে যে ‘খাদ্যে ভেজাল নিরোধক আইন’টি তৈরি হয়, পরবর্তীতে তার সংশোধন করা হয় বেশ কয়েকবার। সংশোধনের পর ১৯৯৭ সালে ভারত সরকারের ডিরেক্টর জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসেস (ফুড) – এর এক নির্দেশনামা মাফিক নির্দিষ্ট কিছু খাদ্যদ্রব্যে ৮টি কৃত্রিম রং ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদিত রংগুলি কোনওভাবেই সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। এর মধ্যে হলুদ রঙের জন্য ব্যবহৃত সানসেট ইয়েলো, টারট্রাজিন অথবা লাল রঙের জন্য ব্যবহৃত কারমোসিন শরীরের হজমশক্তি কমিয়ে দেয়।

• ত্রিশ ভাগ থাকুক মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, পনীর, ছানা ইত্যাদি। ছোটো মাছ, ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড যুক্ত মাছ বেশি করে খান।

• পোলট্রি ফার্মের ব্রয়লার মুরগি ও ডিম পারলে এড়িয়ে চলুন। মুরগি যেন হয় অ্যান্টিবায়োটিক ও গ্রোথ হরমোন মুক্ত, ঘাস পাতা খাওয়া, চরে বেড়ানো।

• দুধ অল্প খান, সঠিক খান। না হলে খাবেন না। দুধে জল বা অন্যান্য উপকরণ মেশানো মানুষ মেনে নিয়েছে। জেনে রাখুন, দুধে স্বাভাবিক ভাবে জলের পরিমাণ হল ৮৬.৭%। এই জলে দ্রবীভূত অবস্থায় ভিটামিন বি১, বি৬, বি৯, বি১২ ও ভিটামিন সি থাকে কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আলাদাভাবে জল মেশালেই তাদের গুণ নষ্ট হয়ে যায়। দরকার হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পরিপূরক অন্য খাবার খেতে হবে।

• আর বাকি দশ ভাগের মধ্যে ঘি, রান্নার জন্য তেল। বাজারে ১০০% খাঁটি ঘি, তেলের আজ আর অস্বিত্ব নেই। ইদানিং ক্ষুদ্র কিছু কৃষি সংগঠন, কিছু অর্গানিক ফার্ম দাবি করছে তাঁরা খাঁটি তেল/ঘি উৎপাদন করছে। যাচাই করে সেগুলো কিনতে পারেন। দেশিয় পদ্ধতিতে যে ঘি আপনি পাবেন সেটি স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয় তো বটেই, শরীরের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী ওষুধের মত কাজ করে। রান্নার সময় তেল বা ঘি একবারেই পুরোটা ব্যবহার করবেন। রান্নায় ব্যবহারের পর অবশিষ্ট তেল ফেলে দিতে দুবার ভাবা উচিত নয়। রেখে দিয়ে পরে আবার ব্যবহার করলে বা বারবার ব্যবহার করলে কিছু বিষাক্ত পদার্থ তৈরি হয় যা শরীরে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট তৈরি করতে সাহায্যকারী উৎসেচকদের বিনষ্ট করে, এতে ক্যানসারের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। 

আমাদের খাদ্য সংস্কৃতি ও রুচি যাই হোক না কেন, ২০ – ৪০ – ৩০ – ১০ এই ভাগ অনুযায়ী যে দৈনন্দিন খাদ্য পরিকল্পনা তৈরি করে নিলে, আমাদের শরীরের গঠন ও বৃদ্ধিতে সঠিক ভাবে সাহায্য করতে এবং সমস্ত রকম কাজের জন্য শক্তি জোগাবে।

কীভাবে খাব? কখন খাব?

• গত একশ বছরে আমাদের গড় আয়ু যেমন প্রায় একশো শতাংশ বেড়েছে, তেমনি অসুস্থতা বেড়েছে একশো গুণ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর কারণ মূলত খাবার এবং ওষুধের বিষক্রিয়া। একশ বছর আগে মানুষ মারা যেত খাবার না খেয়ে, কিন্তু এই সময়ে ভুল খাবার খেয়েই মানুষ অসুস্থ হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বারবার ফুড ইন্ড্রাস্ট্রিগুলোকে সাদা চিনি, সাদা তেল এবং সাদা ময়দার উপরে ইঞ্জুরিয়াস টু হেলথ লিখতে বলছে। কিন্তু কে শোনে, কার কথা!

• খাওয়ার সময় শুধু খাবারেই মনোসংযোগ করুন। 

• ফাস্ট ফুড নয়, স্লো ফুড। প্রসেসড ফুড নয়, বেশি ফাইবার যুক্ত খাবার ধীরে ধীরে চিবিয়ে খান। সবজি কাটার আগে ভালো করে জলে ধুয়ে নেবেন। নাহলে সবজিতে থাকা জলে দ্রবণীয় ভিটামিন অনেকটা বেরিয়ে যাবে। অধিকাংশ সবজি ও ফলে খোসার ঠিক নিচেই ভিটামিনের পরিমান বেশি থাকে। খোসা পুরো না ফেলে চেঁচে বা আঁচড়ে নিয়ে রান্না করাই ভালো। 

• দাঁড়িয়ে বা হাঁটতে হাঁটতে ঢক ঢক করে জল পান করা নয়, বরং বসে আস্তে আস্তে জলও চিবিয়ে খান। সকালে মুখ ধুয়ে ফেলার আগে বাসি মুখে এক গ্লাস জল খান। মুখের মধ্যেকার জমে থাকা স্যালাইভা সারাদিনের হজমের জন্য খুব ভালো।
• বার ঘণ্টার বিরতি, বাকি বার ঘণ্টায় খাওয়া।

• খিদে পেলে খান, নচেৎ ঠিক যেন হজম হয়নি অথচ সময় ধরে খেতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা রাখবেন না। 

• পরিশেষে বলি, অভিনেত্রী-সমাজসেবক এমা ওয়াটসন একবার বিবৃতিতে বলেছিলেন, “As consumers, we have so much power to change the world by just being careful in what we buy.”। ভেজাল খাবেন না খাঁটি তা নির্ধারণের ক্ষমতা রাখেন একমাত্র ক্রেতারাই। আমাদেরই ঠিক করতে হবে কী খাবো, কী খাবো না। আজ যেভাবে জৈব চাষের দিকে ঝোঁক বাড়ছে, অর্গানিক খাবার পেতে চাইছেন ক্রেতারা, তা একটা ইতিবাচক দিকই ধরা যেতে পারে। ভালো কিছুকে কেন্দ্র করে বাজার তৈরি হওয়া ভালো। আমরা যদি ভেজাল বা নিম্নমানের খাবারের মার্কেটকে বয়কট করতে শুরু করি তাহলে বিক্রেতারাও সচেতন হবেন। মনে রাখবেন, সুস্থ শরীরে ও মনে, আনন্দে জীবন যাপনের জন্য খাবার হতে হবে সম্পূর্ণ নিরাপদ, পুষ্টিগুণে ভরা। আর সেইজন্য খাদ্য উৎপাদনের পুরো ব্যবস্থাটা হওয়া উচিত প্রাকৃতিক, অর্থাৎ প্রকৃতি নির্ভর। কী খাব, কেন খাব, কীভাবে খাব, কখন খাব – এই বিষয়গুলি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকলে সুস্থ জীবন যাপন কোনও অনিশ্চিত, কঠিন বিষয় নয়।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.