রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ একটি রাষ্ট্রবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠন, যথাযোগ্য সম্মানের সাথে ভারতের সকল মনীষীদের সম্মান জানান। এই সমস্ত দিনগুলিতে আসমুদ্র হিমাচল সঙ্ঘের সমস্ত শাখায় তথা সমস্ত সাংগঠনিক খন্ডে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক সেই মনীষীর কথা স্মরণ করে প্রেরণা লাভ করেন। ভারতমাতার বীরপুত্র নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে সঙ্ঘের প্রথম সরসঙ্ঘচালক ডঃ হেডগেওয়ারের প্রথম সাক্ষাত হয় ১৯২১ সালে কলকাতাতে কংগ্রেসের অধিবেশনে, তখন ডাক্তার হেডগেওয়ার বিদর্ভ কংগ্রেসের সচিব ছিলেন। নেতাজী এবং ডাক্তারজী দুজনেরই সম্পর্ক গভীর। ডাক্তার হেডগেওয়ার কলকাতাতে ডাক্তারি পড়তে আসেন এবং ১৯১৪ সালের জুন মাসে ডাক্তারি পাশ করেন। কলকাতাতে থাকার সময় ডাক্তারজী “অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর” দলের প্রত্যক্ষ কাজে নিজেকে যুক্ত করে স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং অচিরেই বিপ্লবীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, তার ছদ্মনাম হয় “কোকেন”। পরবর্তী সময়ে নেতাজী এবং ডাক্তারজী দুজনেই কংগ্রেস থেকে বেড়িয়ে আসেন। ডাক্তারজী ১৯২৫ সালে ১২ জন যুবক নিয়ে নাগপুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করেন এই বিশ্বাস থেকে যে সমাজের মধ্যেকার সংগঠনই দেশকে স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারবে। নেতাজী এবং ডাক্তারজী দুজনেরই বিশ্বাস ছিল যে রাষ্ট্রীয় ভাবধারায় অনুপ্রাণিত আদ্যন্ত অনুশাসিত সংগঠনই ভারতের স্বাধীনতার একমাত্র পথ। তাই একজন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং অন্যজন আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব দিয়েছেন। নেতাজীর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ সম্বন্ধে প্রথম অনুভব হয় একটি চলমান ট্রেনের কামরার জানালা দিয়ে, যখন তিনি সেই ট্রেনটিতে ভ্রমন করছিলেন, নাগপুরের উপর দিয়ে ট্রেনটি যাবার সময় নেতাজী স্বয়ংসেবকদের গনবেশ পরে পথ সঞ্চলন (কুচকাওয়াজ) করতে দেখেন। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন এই স্বয়ংসেবকরা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের এবং তার প্রতিষ্ঠাতা হলেন তারই একসময়ের কংগ্রেসের সতীর্থ ডাক্তারজী। তিনি ডাক্তারজীর সাথে দেখা করবার অভিলাষ ব্যক্ত করেন এবং ১৯৪০ সালের জুন মাসে নাগপুরে তাদের দেখা হয়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে নেতাজী, ডাক্তারজীর সাথে দেখা করতে গেছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনী এর সাথে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সংযুক্তির অভিপ্রায় নিয়ে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেই সময় ডাক্তারজী গুরুতর অসুস্থ ছিলেন এবং এমত অবস্থায় ডাক্তারজীর সাথে নেতাজীর খুব অল্পই সাক্ষাৎ হয়, সেই সপ্তাহেই ডাক্তারজীর তিরোধান ঘটে।

পরম পূজনীয় সরসঙ্ঘচালকের উপস্থিতিতে দক্ষিনবঙ্গ প্রান্তের কলকাতা ও হাওড়া মহানগরের স্বয়ংসেবক দ্বারা আজ ২৩ শে জানুয়ারি ২০২৩, কলকাতা শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে নেতাজীর ১২৬ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে “নেতাজী সহ প্রণাম” সকাল নয়টা থেকে এগারোটা পর্যন্ত এক কার্যক্রমের আয়োজনে উপস্থিত হয়েছিলেন পরম পূজনীয় সরসঙ্ঘ চালক মোহনভাগবত জী।  কার্যক্রমে স্বয়ংসেবকদের দ্বারা শারীরিক ও বৌদ্ধিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে নেতাজীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এবং নেতাজীর আদর্শ ও দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনের জন্য তার আত্মত্যাগকে স্মরণ করা হয়। প্রসঙ্গত, প্রতিদিন সঙ্ঘের শাখায় শাখায় নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সঙ্ঘের শারীরিক কসরৎ করা হয় এবং তাঁর জীবনী আলোচনা করা হয়। এর মাধ্যমে স্বয়ংসেবক শুভানুধ্যায়ীরা অনুপ্রাণিত হন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নেতাজির ভাগ্নেয় অর্ধেন্দু বসু। 

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছেন পরম পূজনীয় সরসঙ্ঘচালক মোহনভাগবত জী। তিনি বললেন –

হয়তো আমি ডাক্তার জির সঙ্গে সঙ্ঘে প্রবেশ করিনি ,  আমি তাঁর মৃত্যুর ১০ বৎসর বাদে জন্মে ছিলাম। কিন্তু আমি জীবনে একটি ব্রত নওয়েছিলাম। সেটি হল দেশ উদ্ধারের। আজ নেতাজির জন্মদিন , ওনার জন্মদিন আমরা পালন করি প্রতি বছর। মনীষীদের স্মরণ করা একান্ত প্রয়োজন। দেশ যাঁরা রক্ষা করেছিলেন তাঁদের মহাজীবন পাঠ ও স্মরণ আজকের সমাজে একান্ত প্রয়োজন। রাষ্টের জন্য নেতাজি আপন সকল কিছু ত্যাগ ও দেশমাতৃকার নিমিত্ত উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু আমরা তাঁকে কিছুই দি নাই। গুরু গোবিন্দ সিং জি আপন ৪ সন্তানকে সমর্পন করেছিয়েলন। স্বামীজী চেয়েছিলেন গুরু গোবিন্দ সিংয়ের ন্যায় একজন মানুষ। নেতাজি ছিলেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরন। কিন্তু আমরা কেউ ওনার জন্য কিছু করে নাই। তবুও উনি আমাদের স্মরণে আছে। উনি নিজের উদাহরণে  নেতৃত্ব করতেন। 

নেতাজি মানে শুধুই জন্মদিন। নেই তার মৃত্যু। শত কোটির বীর পুত্র সাহসী বঙ্গ সন্তান। মহান দেশপ্রেমী যাই বলে সম্বোধন করি না কেন, তাই যেন তার জন্য অনেক কম। তার কর্মকান্ডে, ভারতবর্ষে ব্রিটিশের শক্ত ভীত নড়ে উঠেছিল।

যে ক্ষণজন্মার জন্ম না হলে হয়তো ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সূর্য উঠত না কোনদিন।  তিনি আর কে হতে পারেন? যিনি আমাদের শৈশব থেকেই আমাদের মনের ভিতর বসবাস করছেন, যার জন্য অহংকারের শেষ নেই আপামর বাঙ্গালীর। দেশবাসীর অমর সন্তান।

২৩ শে জানুয়ারি বীর নায়কের জন্মদিনটি পরাক্রম দিবস হিসাবে পালন করা হয়। নেতাজি এমন একটি নাম, যে নাম উচ্চারণে খাড়া হয়ে ওঠে প্রতি টি লোমকূপ। এলগিন রোডের তিন তলার ঘর বিএলএ ৭১৬৯ নাম্বার প্লেটের সেই গাড়ি

আজও তোমার অপেক্ষায়। নেতাজীর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন বাংলার উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। ইনিই তো আমাদের ভাবতে শিখিয়েছিলেন যে স্বাধীনতা কেউ দেয় না, অর্জন করে নিতে হয় স্বাধীনতার জন্য দরকার আত্মশক্তি যা সাহসী পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করে যদি

জীবন সংগ্রামের ঝুঁকি না থাকে তাহলে বেঁচে থাকা অনেকটা ফিকে হয়ে যায় নেতাজীই তো বলতে পারেন সংকট ও বিপর্যয় ভয় পাই না, আমি কষ্টের দিনেও দৌড়াবো না। তবে এগিয়ে যাবো এবং ভোগান্তি সহ্য করবো। নেতাজি মানেই শুধুই জন্মদিন। নেই তার মৃত্যু।

যিনি আজও আমাদের হৃদয়ে রয়েছেন বেঁচে। সবার হৃদয় ছুঁয়ে আছো তুমি যাইনি তো কেউ ভুলে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মোহন ভাগবত বলেন, “নেতাজি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন আমাদের সত্যি করতে হবে। ভাগ্য সহায় থাকলে উনিই আগে দেশ শাসন করতে পারতেন। নেতাজি যে কাজ করতেন, সংঘ সেই কাজ করে। নেতাজি যে সমৃদ্ধশালী দেশ দেখতে চেয়েছিলেন, সংঘও তাই চায়। আমাদের দেশ গোটা দুনিয়াকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমাদের সেই উদাহরণ তৈরি করতে হবে।

জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় উন্নতির জন্য মানুষকে বহু পরিশ্রম করতে হয়। হঠাৎ করে কিছুই হয় না। যেমন হঠাৎ করে সুভাষ নেতাজী হন নি। তাঁর জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়ন শৈশব থেকে ধাপে ধাপে লক্ষ্যে এগিয়েছে। তাঁর মতো নেতা এ দেশে খুব , এই পৃথিবীতে খুব কমই জন্ম নিয়েছেন। ভয় ডর বলতে কিছু ছিল না তাঁর মধ্যে। যদি আমার তোমার নজর দিয়ে তাঁকে দেখি ,তিনি ছিলেন জীবন্ত মহাকাল, অসীম ক্ষমতার অধিকারী , তিনি মহাশক্তিধর। যদি বল , তিনি কি বিবেকানন্দের মতো শক্তিধর ছিলেন ? তবে বলি কি গুরুশিষ্যের তুলনা করা উচিত নয়। এক বিবেকানন্দ কত যে দেশমাতৃকার সেবক আজও নির্মাণ করে যাচ্ছেন তার কোনো হিসাব নেই। 

সুভাষচন্দ্র মাঝে মাঝেই বলতেন , স্বাধীনতার জন্য বড় বড় বক্তা এবং বাক্ যোদ্ধার বিশেষ দরকার।

সুভাষ দৃপ্ত কন্ঠে বলেছিলেন, ” দেশের জন্য জীবন দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রাখব। কেবল ভাবপ্রবণতায় তা সম্ভব নয়। বিবেকানন্দের মতো কথা বলতে হবে। তাঁর মতো ভাষণ দিয়ে মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে হবে।আমি শ্রীরামকৃষ্ণকে অসম্মান করছি না। তবে আমার গুরুর থেকে শিষ্যকেই বেশি ভালো লাগে। স্বামীজী আমার জীবনের আদর্শ। সেখানেই তো তাঁর মহত্ব। এই জন্যই নরেন বিবেকানন্দ। তিনি এইভাবেই গুরুর প্রতি নিজের শ্রদ্ধা ভক্তি প্রদর্শন করেছেন। নিজের গুরু, গুরুর আদর্শ ও বাণীকে বিশ্বময় বিখ্যাত করেছেন। “

তিনি বলেছিলেন – ” ভারত আমাদের ডাকছে, রক্ত দিয়ে রক্তকে ডাকছে, আর সময় নেই অস্ত্র তোলো, ঈশ্বর চাইলে শহিদের মৃত্যু বরণ করে নেব আমরা।আমাদের দেশ ভারতে জাতীয়তাবাদ এমন এক শক্তির সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে, যা মানুষের মধ্যে বহু শতাব্দী ধরে সুপ্ত ছিল।”

সুভাষের দেশে শাসকের অভাব ছিল না।অভাব ছিল না সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা সাধকেরও। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু, তৈলঙ্গস্বামী, লোকনাথ ব্রহ্মচারী, বামাখ্যাপা প্রমুখ সকলেই সাধনার উচ্চমার্গে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু কেউ কি বিবেকানন্দের মতো শিষ্য পেয়েছিলেন?

তাই তেজোদ্দীপ্ত বীরসন্ন্যাসীর প্রতি সুভাষের এত ভক্তি। তিনি মনে করতেন স্বামীজীই ভারতাত্মার মূর্ত প্রতীক। স্বামীজী ব্যতীত ইতিপূর্বে কেই বা এই দেশের কথা , এই পোড়া জাতির কথা এমন করে ভেবেছেন? স্বামীজীই একমাত্র মহাপুরুষ যিনি ভাবজগতের সাধক হয়ে মাটি ও মানুষের নিকট ছিলেন।  তিনিই গেয়ে গেছেন জীবনের গান। আর পাঁচজন সাধকের মতো তিনি কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক জগতে বিচরণ করেন নি। তাঁর বিবেক বাণী জাগ্রত করে তুলেছিল শত সহস্র মানুষকে। নবীন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে তাদের মধ্যে। 

তাই তো সুভাষ তাঁকে আদর্শ গুরু হিসাবে গ্রহণ করেছেন। বিবেক বাণীই সুভাষকে অত উদার আর নির্ভীক করে তুলেছিল। সুভাষের সব কিছুর মূলেই ছিলেন বীর সন্ন্যাসী। তাই তো জীবন – মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি থাকতেন নির্বিকার হয়ে। তুচ্ছ জ্ঞান করতেন মৃত্যুকে। আধ্যাত্মিক বলে বলীয়ান হলে তবেই এমন চিন্তাভাবনা করা সম্ভব। বিবেকানন্দের মানসপুত্র সুভাষ ছিলেন সত্যিকারের সাধক। জন্মগত সাধক। 

সুভাষ স্বার্থসিদ্ধি বা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করেন নি। আধ্যাত্মিক চেতনাবোধ ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল তাঁর জীবনে। ভারতবাসীর মুক্তি কামনার সঙ্গে জাগ্রত হয়ে উঠত তাঁর মননে মানব মঙ্গলের কথা। তাই তিনি বিশ্বযুদ্ধের বোমা বর্ষণ, গুলি বৃষ্টি, দুর্যোগের মধ্যেও চলে যেতেন সিঙ্গাপুর রামকৃষ্ণ মিশনে।

শৈশবকাল থেকে আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল সুভাষের। বিবেকানন্দকেই তিনি আদর্শ গুরু হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।

সুভাষ বলতেন, ” এমন একটা আদর্শের  তখন আমার প্রয়োজন ছিল , যার উপর ভিত্তি করে সকল জীবনটাকে গড়ে তুলতে পারব। সকল প্রলোভন তুচ্ছ হয়ে যাবে। এমন একটা আদর্শ খুঁজে বের করা সহজ ছিল না। ..

আচ্ছা বল তো দেখি , জ্ঞান না বল কোনটি শ্রেষ্ঠ ? আচ্ছা তোমার শরীর যদি খারাপ থাকে দীর্ঘ কাল তবে কি তুমি জ্ঞান চর্চা করতে পারবে, যদি তোমার মনোবল বা মানসিক বল কঠিন না হয় ? শরীর চর্চা করলে দেহ যেমন সুস্থ থাকে , তেমন মনের বল , একাগ্রতা বৃদ্ধি পায়। ওই যে স্বামীজী ফুটবল খেলতে বলেছিলেন। তার মানে কি উনি শাস্ত্র পাঠ করতে মানা করেছেন ? না মোটেই না। এর অর্থে উনি বলেছেন , ” তুমি যদি দুর্বল হও তবে তুমি শাস্ত্রের সহজ অর্থ করতে গিয়ে ভুল অর্থ করবে, গীতার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারবে না। ” ,মুন্ডক উপনিষদ্ তাই বলেছেন  – ” নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ”….. বাস্তবিক , আত্মজ্ঞান দুর্বলের জন্য নয়।

শরীর , মন , বুদ্ধি সকল স্তরের বল একজন বীরপুরুষ গঠন করে। একজন প্রকৃত বীরপুরুষকে সবাই অনুসরণ করে। সুভাষ তেমনই একজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি যা করবেন বলে সংকল্প করতেন তাই তিনি করতেন। এমনকি সেই কাজ যদি তাঁকে একাকে করতে হয় তাও তিনি কোনোদিন পিছপা হন নি। তাই নারদকে সনৎকুমার বলেছেন –  মনের থেকেও শ্রেষ্ঠ হল সংকল্প। লোকে প্রথমে সংকল্প করে, তারপর সে চিন্তা করে, পরে বাককে পরিচালনা করে, সবশেষে বাককে নাম উচ্চারণে প্রবৃত্ত করে। সমস্ত মন্ত্র নামে এবং সমস্ত কর্ম মন্ত্রে একীভূত হয়। 

সুভাষ চন্দ্র, ঋষি অরবিন্দ , সূর্য সেন, বিনয় – বাদল – দীনেশ , যতীন দাস, ক্ষুদিরাম, চন্দ্রশেখর আজাদ, রামপ্রসাদ বিসমিল্, ভগৎ সিং, বালগঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায় প্রমুখের মতো বীরপুরুষ এ সংসারে খুবই কম জন্মেছেন। কিন্তু এই ভারতের বুকে বহু জন্মেছেন। তাঁদের মনমুখ এক ছিল।সংকল্পের এই দৃঢ়তার জন্য বিশ্ব তাঁদের শ্রদ্ধা করে। অনেক সময় আমরা যা ভাবি তা মোটেই করি না। মন ও মুখ এক করে কর্ম করতে হবে। দুর্বল মানুষেরা তা কখনো পারে না। 

নারদকে তাই সনৎকুমার বলছেন , – একজন প্রকৃত বীরপুরুষের সামনে একজন প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তিও ভীত থাকেন। যাঁর বল আছে তাঁর উদ্যমও আছে।দুর্বল মানুষ উদ্যমহীন হন। একজন উদ্যমী ব্যক্তি কখনো সময় নষ্ট করেন না। 

সুভাষচন্দ্র বিবেকানন্দের আদর্শকে সামনে রেখেই সারা জীবন নিরন্তর কর্ম করে গেছেন। বীরসন্ন্যাসী বিবেক – বাণীই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল সবচেয়ে বেশি। নেতাজী বলতেন – ” ধর্মচর্চা বলতে আমি কেবল যোগাভ্যাসকেই জানতাম – এ কথা বললে ভুল বলা হবে। অবশ্য কিছুদিন আমি যোগ নিয়ে একটু অধিক মেতে উঠেছিলাম, কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য জনসেবাও অপরিহার্য। এই ধারনাই বিবেকানন্দ আমাকে দিয়েছেন। তিনিই জনসেবা তথা দেশসেবার প্রচার করেছিলেন।

বীরসন্ন্যাসীর অভয় মন্ত্রের জন্যই একদিন বঙ্গের বীরকুলের শিরোভূষণ হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। ত্যাগে কর্মে চরিত্রে পৌরুষে স্বপ্নে এবং সংগঠনে সুভাষচন্দ্র আজ একেশ্বর সূর্য -শাণিত তলোয়ারের মতো উজ্জ্বল। 

এই হলেন বিবেকানন্দভক্ত সুভাষ। এই তাঁর আধ্যাত্মিক জগতের পরিচয়। তাই তো তিনি বিবেকানন্দের মানসপুত্র। 

জাগতিক বা আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যও মানুষকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। অকস্মাৎ কিছুই হয় না।অতএব যা, সত্য, যা শিব, যা সুন্দর তাকে লাভ করার জন্য যে আমাদের আরো অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে। তা আর বিচিত্র কি? 

শিক্ষাসাধনার গুরুতর কর্তব্য বলে মনে করতে হবে। জানি এর প্রধান অন্তরায় অভিভাবক; পড়া মুখস্থ করতে করতে জীবনীশক্তি মননশক্তি কর্মশক্তি সমস্ত যতই কৃশ হতে থাকে তাতে বাধা দিতে গেলে তাঁরা উদ্‌বিগ্ন হয়ে ওঠেন। কিন্তু মুখস্থ বিদ্যার চাপে এই-সব চির-পঙ্গু মানুষের অকর্মণ্যতার বোঝা দেশ বহন করবে কী করে? উদ্যোগিনং পুরুষসিংহমুপৈতি লক্ষ্মীঃ। আমাদের শিক্ষালয়ে নবীন প্রাণের মধ্যে অক্লান্ত উদ্যোগিতার হাওয়া বয়েছে যদি দেখতে পাই তা হলেই বুঝব, দেশে লক্ষ্মীর আমন্ত্রণ সফল হতে চলল। এই আমন্ত্রণ ইকনমিক্‌সে ডিগ্রি নেওয়ায় নয় : চরিত্রকে বলিষ্ঠ কর্মিষ্ঠ করায়, সকল অবস্থার জন্যে নিজেকে নিপুণভাবে প্রস্তুত করায়, নিরলস আত্মশক্তির উপর নির্ভর ক’রে কর্মানুষ্ঠানের দায়িত্ব সাধনা করায়। অর্থাৎ কেবল পাণ্ডিত্যচর্চায় নয়, পৌরুষচর্চায়। “…..

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তারজি হেডগেওয়ারের সাথে নেতাজির সম্পর্ক ইতিহাসের নতুন কোনো তথ্য নয়।  ডাক্তারজির সাথে ১৯২১ সালেই কংগ্রেসে কলকাতা অধিবেশনে নেতাজির প্রথম দেখা হয়েছিল। বাংলার সাথে দুজনেরই গভীর সম্পর্ক আছে। হেডগেওয়ার তার ডাক্তারী পড়াশোনা করেছিলেন কলকাতায়। ১৯১৪ সালের জুন মাসে তিনি ডাক্তারী পাশ করেন।  এছাড়াও এই বাংলাতেই তিনি বিপ্লবী দল অনুশীলন সমিতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং তার পরবর্তী সাংগঠনিক জীবনের জন্যে প্রস্তুতি নেন। 

পরবর্তীতে কংগ্রেসের নীতি আর কর্মপদ্ধতি মানতে না পেরে নেতাজি আর ডাক্তারজি দুজনকেই কংগ্রেস ত্যাগ করতে হয়। নেতাজি এবং ডাক্তারজি উভয়েই বিশ্বাস করতেন যে জাতীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি সুশৃঙ্খল সংগঠনই ভারতের স্বাধীনতা অর্জন ও তাকে রক্ষা করতে পারে। তাই নেতাজি ব্রিটিশ বিরোধিতা জোরদার করার জন্যে আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন আর অন্যদিকে ডাক্তারজিও ১৯২৫ সালে দেশকে স্বাধীন আর স্বনির্ভর করার স্বপ্ন নিয়ে আরএসএস এর প্রতিষ্ঠা করেন। 

নেতাজি আরএসএস এর সংস্পর্শে আসেন একটু অভিনবভাবে। নাগপুরের মধ্যে দিয়ে ট্রেন ভ্রমনের সময়‚ একটি চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে তিনি প্রথমবারের জন্যে সঙ্ঘের স্বেচ্ছাসেবকদের ইউনিফর্ম ( গনবেশ) পরে মিছিল করতে দেখেন আর নিজেও রেজিমেন্টেড মানসিকতার হওয়ায় সঙ্ঘ সম্পর্কে কৌতুহলী হয়ে পড়েন। 

 খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন যে এই স্বেচ্ছাসেবকরা ছিলেন আরএসএসের ছিল এবং সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা হলেন তাঁরই প্রাক্তন কংগ্রেস সহকর্মী। খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ তিনি ডাক্তারজির সাথে দেখা করতে চান। এরপর ১৯৪০ সালে তার নাগপুর সফরের সময় ডাক্তারজির সাথে দেখা করতে যান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ডাক্তারজি সেইসময় গুরুতর অসুস্থ থাকায় তাদের দেখা করা সম্ভব হয় নি। ডাক্তারজি সেই সময় ঘুমিয়ে থাকায় নেতাজি তাঁকে জাগিয়ে বিরক্ত করতে চাননি। ঘুম ভেঙ্গে ওঠার পর তা জেনে হেডেগেওয়ার খুব দুঃখিত হন। আর এর পরের দিনই তাঁর মৃত্যু ঘটে।

মোহনভাগবতজী আরও বলেন, “আরও বলেন, “কোনও গন্তব্যে যাওয়ার জন্য কখনও পথ সোজা হয়, কখনও কঠিন। কিন্তু, গন্তব্য সর্বদা একটাই হওয়া উচিত। সুভাষ চন্দ্র বসুর যা গন্তব্য ছিল, সেটাই আমাদের গন্তব্য। আমরাও সেই কাজটাই করি।” বিশ্বমঞ্চে ভারতের অবস্থান প্রসঙ্গে এদিন মোহন ভাগবত বলেন, “ভারত অমর রাষ্ট্র। ভারত গোটা বিশ্বকে ধর্ম শিখিয়েছে। এই ধর্মের মানে আলাদা। এই ধর্ম ন্যায়ের কথা। ভারত বিশ্বকে একতার শিক্ষা দেয়। সেই ভারত গড়ার দিকেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। দুনিয়া ভারতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।”

নেতাজী বলেছিলেন –

দেখ মা, ভারতে যাহা চাও সবই আছে– প্রচণ্ড গ্রীষ্ম, দারুণ শীত, ভীষণ বৃষ্টি আবার মনোহর শরৎ ও বসন্তকাল, সবই আছে। দাক্ষিণাত্যে দেখি– স্বচ্ছসলিলা, পুণ্যতোয়া গোদাবরী দুই কূল ভরিয়া তর তর কল কল শব্দে নিরন্তর সাগরাভিমুখে চলিয়াছে– কী পবিত্র নদী! দেখিবামাত্র বা ভাবিবামাত্র রামায়ণে পঞ্চবটীর কথা মনে পড়ে, তখন মানসনেত্রে দেখি সেই তিনজন– রাম লক্ষ্মণ ও সীতা, সমস্ত রাজ্য ও সম্পদ ত্যাগ করিয়া, সুখে, মহাসুখে, স্বর্গীয় সুখের সহিত গোদাবরীতীরে কালহরণ করিতেছেন–আর এদিকে আমরা সাংসারিক দুঃখানলে নিরন্তর পুড়িতেছি।… দেখি, পুণ্যসলিলা জাহ্নবী সলিলভার বহন করিয়া চলিয়াছে– আবার রামায়ণের একটি দৃশ্য মনে পড়ে। তখন দেখি বাল্মীকির সেই পবিত্র তপোবন– দিবারাত্র মহর্ষির পবিত্র কণ্ঠোদ্ভূত পূত বেদমন্ত্রে শব্দায়িত– দেখি বৃদ্ধ মহর্ষি অজিনাসনে বসিয়া আছেন– তাঁহার পদতলে দুইটি শিষ্য– কুশ ও লব– মহর্ষি তাহাদিগকে শিক্ষা দিতেছেন। পবিত্র বেদধ্বনিতে আকৃষ্ট হইয়া ক্রূর সর্পও নিজের বিষ হারাইয়া, ফণা তুলিয়া নীরবে মন্ত্রপাঠ শুনিতেছে… রামায়ণে সমস্তই পবিত্র– সামান্য তৃণের বর্ণনা পর্য্যন্তও পবিত্র, কিন্তু হায়! সেই পবিত্রতা আমরা ধর্ম্মত্যাগী বলিয়া আর এখন বুঝিতে পারি না।”


পৃ: ১৬-১৭। পত্রাবলী (১৯১২-৩২), সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজী রিসার্চ ব্যুরো, এম সি সরকার অ্যাণ্ড সনস প্রাইভেট লিমিটেড। 

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.