রামকৃষ্ণের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক কি ? তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব কতখানি ?

রামকৃষ্ণের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক কি ? তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব কতখানি ? নাকি তিনি নিছকই একজন ধর্ম ব্যাবসায়ি ? সম্প্রতি আমি রামকৃষ্ণের হাব ভাব বাস্তবে কেমন ছিল তা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখে শেয়ার করি , এবং তার প্রেক্ষিতে কিছু ব্যাক্তি এই প্রশ্ন তোলেন । তাদের মতে ইতিহাসের পেজে লেনিন কিংবা হিটলারের মতন ব্যাক্তিদের চরিত্র চর্চা শোভা পায় , কিন্তু রামকৃষ্ণের চর্চা অপ্রাসঙ্গিক কারণ তিনি নিছক একটা ধর্মগুরু , কোনও ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্ত্ব নন । একটু ঘুরিয়ে বললে দাঁড়ায় , ইতিহাসে ধর্মের কোনও ঠাই নেই ।

কিন্তু সত্যি কি তাই ? আসুন দেখা যাক ।

ছোটবেলায় আমরা সবাই A.D. ( anno domini ) B.C. (before Christ) পড়েছি । যীশুর জন্মের সালকে মানদণ্ড করে সারা পৃথিবীর ইতিহাসের সময়কালকে দুভাগে ভাগ করা হয় । এবার , বিশ্ব ইতিহাসে যীশুর অবদান কি ? তিনি একজন ধর্ম প্রচারক এবং একটি বিশেষ ধর্মমত প্রতিষ্ঠাতা । অর্থাৎ এক ধর্ম প্রচারকের জন্মের দিনক্ষণ দেখে অপামর বিশ্ব ইতিহাস চর্চা করে ! আজ্ঞে হ্যাঁ , ইতিহাসের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ !

বিশেষত রামকৃষ্ণ , যিনি শুধু একজন ঐতিহাসিক পুরুষই নন , তিনি ইতিহাসের স্রষ্টা । যদি রামকৃষ্ণ কষিয়ে এক চড় না মারতেন তাহলে কয়জন চিনতো রানি রাসমণিকে ? ইতিহাসে তো পরহিতব্রতী রানি কম ছিলেন না । অথচ আজ আমরা কজন কে মনে রেখেছি ? নাটোরের রানী ভবানীর নাম কজনা শুনেছে বলতে পারেন ?

যদি রামকৃষ্ণ না হত , তাহলে দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ি নিছক এক অখ্যাত জমিদারের মন্দির হয়েই রয়ে যেত । যেরকম মন্দির আজও বাংলার বহু জায়গায় জরাজীর্ণ কলেবরে দাঁড়িয়ে আছে । দক্ষিণেশ্বর যে আজ এক মহাতীর্থের মর্যাদা পেয়েছে সে কেবল ওই রামকৃষ্ণের জন্য । ছোকরা নরেন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ হয়েছে শুধুমাত্র রামকৃষ্ণের জন্য । এই মণিকাঞ্চন যোগ না হলে হয়তো সে থেকে যেত ব্রাহ্মধর্মের এক মামুলি যুবক , কিংবা ভবঘুরে নাস্তিক কিংবা সাধারণ একটা কেরানি হয়ে ।

আর নরেন বিবেকানন্দ না হলে যে কি হতো , তার লিস্ট তো সুবিশাল !

বিবেকানন্দ না থাকলে চিকাগো ধর্ম সম্মেলনে কেউ বক্তৃতা দিত না । কুসংস্কার , দারিদ্র , অসহায়তার নিচে ঘুমিয়ে ছিল যে ভারতাত্মা , তাকে চিনিয়ে দেওয়ার কেউ থাকতো না । ভিক্টোরীয় যুগের গোঁড়া খ্রিস্টান মূল্যবোধে জারিত পাশ্চাত্য দেশে দাঁড়িয়ে ভারতকে ভালোবাসতে শেখানোর কেউ থাকতো না । বিদেশির চোখে ভারত থেকে যেত একটি সাপ , বাঘ , হাতি , ধনরত্ন , মহারাজা , স্নেক চার্মার , ফকির , সাধু , সতীদাহ , অস্পৃশ্যতা , নরবলি , পৌত্তলিকতা অধ্যুষিত এক রহস্যময়ি exotic প্রাচ্য দেশ হয়ে । বিবেকানন্দ না থাকলে শুধু হিন্দু ধর্ম নয় , ভারতীয় সংস্কৃতিও বাইরের দেশে পারি জমাতে পারত না । আজ যে আমেরিকার ৫৫ মিলিয়ন মানুষ যোগ অভ্যাস করে তার কৃতিত্ব বিবেকানন্দের প্রাপ্য । না , তিনি ৫৫ মিলিয়ন আমেরিকাবাসিকে জনা জনা যোগ শিক্ষা দেন নি বটে , কিন্তু তাঁরই প্রদর্শিত পথে পরবর্তীকালে একের পর এক ধর্মগুরু আর যোগ প্রচারক পাশ্চাত্যের মাটিতে পাড়ি জমিয়েছেন । পরমহংস যোগানন্দ থেকে ইস্কনের স্বামী প্রভুপাদ , ইনারা সকলেই বিবেকানন্দের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভারতের সংস্কৃতি বিদেশের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিয়েছিলেন । তার সম্মিলিত ফলে আজ পাশ্চাত্যের ঘরে ঘরে যোগ চর্চা , হলিউডের সিনেমার নাম ‘অবতার’ ! আজকে বিদেশির মুখে মুখে ‘ধর্ম’ ( dharma ) , ‘কর্ম’এর ( karma ) মতন আদ্যান্ত ভারতীয় কনসেপ্ট !

বিবেকানন্দ শুধু ধর্ম নিয়ে যান নি । সঙ্গে নিয়ে গেছেন আসমুদ্র ভারতবর্ষের ছয় হাজার বছরের কৃষ্টিকে ! এটাকে বলে ‘সফট পাওয়ার’ । বিশ্বের দরবারে খুব কম দেশ আছে যারা এই সফট পাওয়ারের আস্ফালন করতে পারে । ভারত তার মধ্যে অন্যতম এবং বিবেকানন্দ তার প্রধান এবং প্রাচীনতম দূত। এবং এই বিবেকানন্দ নিজে বারংবার এই বিশাল কর্মকাণ্ডের কৃতিত্ব দিচ্ছেন দক্ষিনেশ্বরের পাগলা পুরুত কে !

এই রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবান্দলনের ফলে আটকে যায় মিশনারি খ্রিস্টানদের অগ্রাসি ধর্মপ্রচার এবং ধর্মান্তকরণ । রামকৃষ্ণ পরবর্তী যুগের বাংলায় নতুন করে “ইয়ং বেঙ্গল” তৈরি হয় নি । কারণ বিগ্রহের গায়ে লাথি মেরে নিজেকে আধুনিক প্রমানের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছিল । তৎকালীন হিন্দু সমাজ বুঝে গেছিল কিভাবে ধর্মের মধ্যে থেকে অসার টুকু বাদ দিয়ে সারটুকু সংগ্রহ করে নিতে হয় । তাই সেই যুগের শিক্ষিত এলিট বাঙ্গালিদের নাস্তিক হয়ে যাওয়া কিংবা কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতন খ্রিস্টান হয়ে যাওয়া কিংবা ব্রাহ্ম সমাজে নাম লেখিয়ে মডার্ন হওয়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছিল ।

এখানে অত্যুৎসাহি কেউ প্রশ্ন করতে পারেন , বাঙ্গালি খ্রিস্টান হবে না হিন্দু থাকবে তাতে ইতিহাসের কি আসে যায় ? হ্যাঁ আসে যায় , কিন্তু সেটা হিন্দু বা খ্রিস্টান বলে নয় । আসে যায় কারণ হিন্দু কেবল একটা ধর্ম নয় , এটি এই দেশের নিজের ধর্ম । ফলত এই দেশজ সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক । খ্রিস্টানিটি যেমন মধ্য প্রাচ্যের কৃষ্টির ধারক ও বাহক একইভাবে যে কোনও ভারত ভূখণ্ডে উদ্গত ধর্ম সেই ভারতের সংস্কৃতির বাহক । কাজেই কোনও দেশি ধর্ম লোপ পেলে , দেশজ সংস্কৃতিও লোপ পেতে বাধ্য । আধুনিক পাকিস্তান বা আফঘানিস্তান যার জাজ্বল্যমান প্রমাণ ! সেই দেশজ ধর্মের এবং দেশীয় কৃষ্টির অবলুপ্তিকরণের পথ আটকে দিয়ে জাতিকে উদ্ধার করেছিল রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবধারা ! বলতে গেলে , ব্রাহ্ম সমাজের প্রাশঙ্গিকতা হারানোর প্রধান কারণই এই রামকৃষ্ণ ভাবধারা । আজ যে আপনি সচ্ছল , শিক্ষিত , শহুরে , আদব কায়দা জানা বিলেত ফেরত বাঙ্গালি হয়েও সগর্বে মা দুর্গার পুতুল পুজা করছেন …… এবং তাতে লজ্জিত হচ্ছেন না , সেই স্বাভিমান ও আত্মগরিমা বোধকে পাকা করে গেছিল রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবধারার উত্থান ।

আর বিবেকানন্দের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর যে সুবিশাল প্রভাব , সে কথা আশা করি বাঙ্গালিকে আর মনে করিয়ে দিতে হবে না । প্রায় প্রতিটি ভারতীয় দেশ নায়ক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী তাঁর অবদান মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে গেছেন ! নেতাজী তো বলেই বসলেন – ‘ তিনি বেঁচে থাকলে আজ আমি তাঁর পায়ের কাছে বসে থাকতাম । ‘ রবি ঠাকুর বললেন – ‘ভারতকে চিনতে হলে বিবেকানন্দ কে চেনো ।‘ সে যুগের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রধান অনুপ্রেরনা ছিল তিনটি বস্তু – স্বামীজির বাণী , বঙ্কিমের আনন্দমঠ আর ভগবৎ গীতা । বিবেকানন্দ নিজে রাজনীতি থেকে শতহস্ত দূরে থাকলেও পরাধীনতার গ্লানি ভালই বুঝতেন । তিনি প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক শিক্ষা দেন নি । কিন্তু রাজনৈতিক চেতনার যে ভিত্তি সেটা নির্মাণ করে দিয়েছিলেন । তিনি বুঝেছিলেন যে জাতি যদি নিজের ঐতিহ্যে একবার গর্ব বোধ করতে সক্ষম হয় , আর সঙ্কীর্ণতা ভুলে এক ভারতবাসি হিসেবে নিজেকে দেখতে শেখে , তাহলে পরাধীনতার শৃঙ্খল ঘোচা শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র !

স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন বিবেকানন্দ শিষ্যা সিস্টার নিবেদিতা । এমনকি একটা সময় মা সারদার জয়রামবাটির বাড়ি এবং বেলুড় মঠের ওপর ব্রিটিশ পুলিশের গুপ্ত নজরদারি চলতো ! জয়রামবাটিতে কেউ অথিতি এলে তাকে স্থানীয় থানায় নাম ঠিকানা বলে আসতে হত ! এমনই ছিল রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবধারার সাথে স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্পর্ক । এই নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে বলে বিশদে যাচ্ছি না ।

আবার এই নিবেদিতার হাত ধরেই নতুন প্রাণ পেল ভারতীয় শিল্প । নিবেদিতাই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করেন অজন্তার গুহাচিত্র স্টাডি করে ভারতের নিজেস্ব ঢঙে ছবি আঁকা প্রবর্তন করতে । শিল্প বোধের এই ভারতীয়করণের শ্রেষ্ঠ ফসল রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতন ।

বিবেকানন্দই প্রথম ব্যাক্তি যিনি হিন্দু ধর্মকে বিদেশের মাটিতে ছড়িয়ে দিলেন । “ম্লেচ্ছ” জাতকেও বেদ মন্ত্র জপের অধিকার দিয়ে প্রাচ্য পাশ্চাত্যের দেওয়াল ভেঙ্গে দিলেন । কালাপানি পারের কুসংস্কার খণ্ডন করে সন্ন্যাসী হয়েও সমুদ্রপারে গেলেন ! আবার উনিই প্রথম বারের জন্য জাতি প্রথাকে জন্মগতভাবে নয় , গুণবাচক ভাবে ব্যাখ্যা করলেন । যে ব্যাক্তি ব্রাহ্মনের গুণে গুণান্বিত সেই ব্রাহ্মন । পরবর্তীকালে হিন্দু ধর্মের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই এই গুণবাচক ব্যাখ্যা কে আপন করে নিয়েছে । জন্মগত ব্যাখ্যা আজ প্রায় কোণঠাসা । আজ মুখোপাধ্যায় বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি উপাধি গুলোর আলাদা কোনও ব্রাহ্মণত্বের মুল্য নেই । এই যে বিরাট সামাজিক বিপ্লব , তাঁর প্রথম হোতাও বিবেকানন্দ ।

বিবেকানন্দই প্রবর্তন করলেন সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে জীব সেবা । উনার পূর্বে অনেক হিন্দু ধর্মীয় সঙ্ঘ ছিল এবং তারা বিক্ষিপ্ত সেবা কাজ করতো বটে । কিন্তু কোনও সঙ্ঘের প্রধান কার্যকলাপ হিসেবে জীবসেবা কে তুলে ধরা রামকৃষ্ণ মিশনেই সর্বপ্রথম ঘটে । সে যুগে অন্য মতাবলম্বী সাধুরা রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুদের টিটকিরি মারত কারণ তারা সাধু হয়ে জনগণের সেবা না নিয়ে নিজেরাই রুগির গু মুত ঘেঁটে সেবা করে বলে । তাই হরিদ্বার কঙ্খলে মিশনের সাধুদের নাম হয়েছিল ‘ভাঙ্গি সাধু’ । আর আজ মাত্র এক শতাব্দী পরে বলতে গেলে সমস্ত হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে একটা করে হাসপাতাল , দাতব্য , ইস্কুল স্থাপন করা ম্যানডেটোরী ! হিন্দু সমাজ তথা ভারতের চরিত্রই আমুল বদলে দিয়েছে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ যুগ্ম আন্দোলন ।

এবার ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে গিয়ে খুঁজুন তো এই মহা কর্মযজ্ঞের উৎসমুখটি ! দেখবেন এই প্রাবাহের গোমুখি হচ্ছে দক্ষিনেশ্বরের সেই ছোট্ট ঘরে , যেখানে একজন অর্ধশিক্ষিত , গাঁইয়া , মাইনে করা পুরুত ঠাকুর বসে বসে কলকাঠি নাড়ছেন । তাঁর পায়ের কাছে বসে সে যুগের প্রধান প্রধান ব্যাক্তিত্ত্ব – কেশব সেন , শিবনাথ শাস্ত্রি , বঙ্কিম চাটুজ্যে , গিরিশ ঘোষ প্রমুখ ।

১০০ বছর পরে এই একবিংশ শতকে এসে কেউ কেউ রামকৃষ্ণের ঐতিহাসিক প্রাশঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন করছেন । তাদের উদ্দেশ্যে আমি একটাই কথা বলব মধু কবির ভাষায় —

“ হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;–
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!
অনিদ্রায়, অনাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;–
কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল-কানন! “

——– Halley Goswami

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.