রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে ‘খাদ্যরসিক’ শব্দটি অনেকেই বসান। কিন্তু আদতে রবীন্দ্রনাথ কোন খাবারটি পছন্দ করতেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। তবে তিনি যে খাবারের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট বিবরণ পাওয়া যায়।
কী কী খেতে ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ?
শোনা যায়, আম খেতে পছন্দ করতেন তিনি। তিনি নাকি জাপান যাওয়ার সময় আম সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, একবার অসুস্থ হয়ে আমেরিকা যাওয়ার সময় মুম্বই বন্দর থেকে এক বাক্স আলফানসো আম কিনেছিলেন তাঁরা।
সে তো গেল ফল। এবার আসা যাক রান্না করা খাবারের তালিকায়।
লেখক বনফুল সপরিবার গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবের সময়ে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন স্ত্রীর বানানো সন্দেশ। রবীন্দ্রনাথ বনফুলের হাতে সন্দেশের বাক্স দেখে বললেন, এটি কী? বনফুল বললেন, সন্দেশ। তিনি কৌটাটি খুলে রবীন্দ্রনাথের সামনে রাখলেন। রবীন্দ্রনাথও একটি সন্দেশ মুখে দিয়ে বিমোহিত হয়ে গেলেন। সন্দেশ খেতে খেতে বললেন, ‘বাংলাদেশে তো দুটি মাত্র রস-স্রষ্টা আছে। প্রথম দ্বারিক, দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ যে তৃতীয় লোকের আবির্ভাব হল দেখছি।’
সেই একই সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ বনফুলকে বিকেলে দেখা করতে বললেন। বললেন, ‘তোমার লেখা পড়ে মনে হয় তুমি ঝাল খেতে ভালোবাস। বিকেলে বড় বড় কাবলে মটরের ঘুগনি করলে কেমন হয়? ঘুগনির মাঝখানে একটা লাল লঙ্কা গোঁজা থাকবে। কী বল?’
বনফুলের সম্মতি না জানানোর কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই সূক্ষ্ম রসবোধ উড়িয়ে দেওয়ার নয়। বনফুলের লেখা পড়েই কি তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে বনফুল ঝাল খেতে পছন্দ করেন? বনফুল কোথাও না কোথাও রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করেছিলেন। সেটা তাঁর নজরে পড়েছিল। সেদিনই তিনি বনফুলকে বলেছিলেন, ‘তোমার নাম হওয়া উচিত ছিলো বিছুটি। যা দু’-এক ঘা দিয়েছো, তার জ্বলুনি এখনও কমেনি।’
রবীন্দ্রসাহিত্যে কিংবা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন লেখকের স্মৃতিকথায়, জীবনীতে তাঁর খানাপিনা নিয়ে ভাবনার অনেক কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু খুব কম জায়গায় পাওয়া যায় তাঁর খাদ্যদর্শন।
বনফুলের লেখা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ খেতে এবং খাওয়াতে ভালোবাসতেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথও সে কথা লিখেছেন। ইন্দিরা দেবীও মোটামুটি কাছাকাছি কথাই লিখেছেন।তবে তাঁর খাদ্যদর্শনটি ধরতে পেরেছিলেন সম্ভবত রথীন্দ্রনাথই।
রবীন্দ্রনাথের খামখেয়ালি সভার কথা মনে আছে। এর সভ্যরা প্রতি মাসে নিজেদের বাড়িতে সভার আয়োজন করতেন পালাক্রমে। সেখানে গান-কবিতা-অভিনয় ছাড়াও প্রচুর আড্ডা হত। তার সঙ্গ চলত খাওয়াদাওয়া। বেশ কয়েকবারই রবীন্দ্রনাথের পালা পড়েছিল নিজের বাড়িতে আড্ডা বসানোর।
রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বাবার যেবার নিমন্ত্রণ করার পালা পড়ল, বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেল। মাকে ফরমাশ দিলেন খাওয়ানোর সম্পূর্ণ নতুন রকম ব্যবস্থা করতে হবে। মামুলি কিছুই থাকবে না, প্রত্যেকটি পদের বৈশিষ্ট্য থাকা চাই।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘বাবা মনে করতেন খাওয়াটা উপলক্ষ মাত্র, রান্না ভালো হলেই হল না— খাবার পাত্র, পরিবেশনের প্রণালী, ঘর সাজানো, সবই সুন্দর হওয়া চাই। যেখানে খাওয়ানো হবে তার পরিবেশে শিল্পীর হাতের পরিচয় থাকা চাই। মা রান্নার কথা ভাবতে লাগলেন, অন্যরা সাজানোর দিকে মন দিলেন।’
একই রকম বর্ণনা দিয়েছেন বনফুল। সেই যে বেশি করে লঙ্কা দিয়ে ঘুগনি খাওয়ার সময় যেদিন, সেদিন মূলত রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে বনফুলের পরিবারকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। উত্তরায়ণের একটি বারান্দাকে পর্দা দিয়ে ঘিরে খাবারের আয়োজন। অদ্ভুত সে আয়োজনের বর্ণনা দিয়েছেন বনফুল।
বনফুল জানাচ্ছেন, তাঁদের প্রত্যেকের পেছনে এমনকী তাঁর দেড় বছরের ছেলের বসার আসনের পেছনেও দাঁড়িয়েছিলেন একজন করে তত্ত্বাবধায়ক। খাবার নিশ্চয়ই ভালো ছিল। কিন্তু খাবার নিয়ে এই যে আয়োজন, সেটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের খাদ্যদর্শন।