পশ্চিমবঙ্গের ভোট এবং নরকের দক্ষিণ দুয়ার

কোথাও নাকি স্ট্রং রুমে ঢুকেছেন মন্ত্রী ! কোথাও আবার বিধায়ক ! শাসকদলের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগে একাধিক জেলায় বিরোধীদের বিক্ষোভ। এরইমধ্যে, হাওড়ার (Howrah) ডোমজুড়ে গণনাকেন্দ্রের পাঁচিল ভাঙাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা। এগরায়, তৃণমূলের বিরুদ্ধে ব্যালট বদলের চেষ্টার অভিযোগে বিক্ষোভ দেখায় বিজেপি। আবার কোচবিহারের (CoochBehar) দিনহাটায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর সামনেই হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে তৃণমূল ও বিজেপি। জোর করে স্ট্রংরুমে ঢোকার অভিযোগ বিজেপির বিরুদ্ধে। স্ট্রংরুমে আগে ঢুকেছে তৃণমূল, পাল্টা অভিযোগ বিজেপির। যার পরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সামনেই স্ট্রংরুমে ঢুকে যান বিজেপি-তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। তৈরি হয় প্রবল উত্তেজনা। হাতাহাতিও চলে দু’দলের সমর্থকদের মধ্যে।

তেমনি একটি ঘটনা জানা যাচ্ছে বারুইপুর থেকে। ভোট এবং নরক প্রায় সমান কথা পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকাল সেই উপলব্ধিই দিয়েছে। কি সেই ঘটনা? আসুন জানি কার্যকর্তার মুখ থেকেই-
আমরা বিজেপির কার্যকর্তারা ৮ই জুলাই রাত থেকে কাউন্টিংয়ের দিন পর্যন্ত গোবিন্দপুর রত্নেশ্বরী হাইস্কুলে স্ট্রংরুমের বাইরে প্যান্ডেল বেঁধে থাকবো। একথা জানানোয় , ৫ই জুলাই সর্বদলীয় বৈঠকে বারুইপুরের BDO সৌরভ মাঝি বলেছিলেন, আপনাদের প্যান্ডেল বেঁধে থাকার দরকার নেই, স্কুল জুড়ে স্ট্রংরুমে CCTV ক্যামেরা লাগানো রয়েছে,তার মনিটর যে ঘরে থাকবে সেই ঘরে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের থাকার ব্যাবস্থা করা হবে। তারজন্য আপনার দলের ছয়জনকে আগামী দুদিনের মধ্যে আইডেন্টিটি কার্ড করে দেওয়া হবে। তারা অল্টার করে সেই ঘরে থাকতে পারবে।

ওনার কথা মাফিক ৭জুলাই আমি দক্ষিণ ২৪ পরগনা(পূর্ব) জেলার সম্পাদক বিশ্বজিৎ পাল ও জেলা সদস্য বিশ্বজিৎ বড়ুয়া BDOর অফিসে গিয়ে দেখলাম, তালা ঝুলছে। সেখান থেকে গোবিন্দপুর রত্নেশ্বরী হাইস্কুলে এলাম। সেখানে BDO র সাথে দেখা করে জানালাম, ছ’জন দুকপি ছবি,ভোটার কার্ড নিয়ে প্রস্তুত আছে কার্ড করার জন্য। উনি বললেন “ব্যালট বক্স রিলিজ হচ্ছে,খুব চাপ আছে,সন্ধ্যায় আসুন।” ওনার কথামতো আমরা রাত ৮টায় গিয়ে আবার BDOর সাথে দেখা করলাম। BDOর সাথে তখন APO কুমারজিত ছিলেন। BDO বললেন “আজ এখনও কাজ মেটেনি, কাল করে দেওয়া হবে।” আমরা বললাম ” কাল ভোট,আপনারা ব্যাস্ত থাকবেন,আমরাও থাকবো, আর কাল রাত থেকে ভোট সম্পন্ন হলেই এই স্ট্রংরুমে ব্যালট ঢুকতে শুরু করবে….” উনি প্রত্যুত্তরে জানালেন “কাল রাতেই আইডেন্টিটি কার্ড করে দেওয়া হবে।” আমাদের সাথে যাওয়া জেলা পরিষদের প্রার্থী জিজ্ঞেস করলেন, ” কাল রাতে আইডেন্টিটি কার্ড দেওয়া সম্ভব না হলে, আমাদের ক্যান্ডিডেটদের আইডেন্টিটি কার্ড নিয়ে মনিটর রুমে থাকতে পারবো?” BDO জানালেন ” না ওই রুমে থাকার জন্যে আলাদা আইডেন্টিটি কার্ড করে দেওয়া হবে।” পরের দিন ৮ ই জুলাই ভোট হলো, সারাদিন ফোনে ওনাকে পাওয়া যাচ্ছিলোনা। রাত ৯টায় আমাদের কিছু প্রার্থী, ইলেকশান এজেন্টদের নিয়ে সেখানে গেলাম। BDOর সাথে দেখা করতে গিয়ে গেটে আমাদের আটকানো হলো। যদিও দেখলাম লুঙ্গি পড়ে, গামছা কাঁধে নিয়ে লোক স্ট্রংরুমে ঢুকছে,বেড়োচ্ছে। আমরা প্রতিবাদ করলাম। BDOকে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পরে ফোনে পাওয়া গেলে, উনি দেখা করার কথা না বলে, আগের দিনের মতো পাশ কাটিয়ে যেতে থাকলেন। তারপর APO কুমারজিত মনিটর রুমে থাকার বিষয়টা সম্পূর্ন অস্বীকার করে আমার ফোন কেটে দিলেন। বুঝতে পারলাম এই স্ট্রংরুম সুরক্ষিত নয়। স্ট্রংরুম তখন সম্পূর্নভাবে শাসকদল তৃণমূলের নিয়ন্ত্রনে চলে গেছে। তাই BDO ভিতরে থাকা সত্বেও দেখা না করে, নিজের অবস্থান বদল করেছে। আমরা সকলে সেখানে, তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অবস্থান বিক্ষোভ করতে শুরু করলাম। ঘনাটি পুলিশ দাঁড়িয়ে কেবল দেখছিল। প্রায় ৩০ মিনিট পরেও গেলো কোন সদুত্তর পেলাম না। আচমকা ওই স্কুলের গেটের সামনে CCTV বেষ্টিত, ১৪৪ ধারা ও প্রশাসনের সামনে আমাদের ছত্রভঙ্গ করতে সশস্ত্র অবস্থায় বারুইপুর মিউনিসিপ্যালিটির ১২ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলের গুণ্ডারা সশস্ত্র অবস্থায় ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমাদের প্রার্থী, ইলেকশান এজেন্টদের মারা হলো, আমার মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হল । যখন নাক মুখ থেকে রক্ত ঝড়ছে, মাটিতে পড়ে গেছি তারপরেও তিনবার মাথা লক্ষ্য করে চেয়ার তুলে মারা হলো, পাশে থাকা অন্য চেয়ার দিয়ে কোনভাবে মাথা সেভ করে বাঁচলাম। আমাদের কার্যকর্তার বাইকে সারা শরীর রক্তাক্ত অবস্থায় বারুইপুর হাসপাতালে ভর্তি হলাম। ভগবান বর্বরদের হাত থেকে প্রাণে বাচিঁয়ে দিলো, সাথে সাথে এই তৃণমূলকে উচ্ছেদ করার মানসিকতা কয়েকশো গুন বাড়িয়ে দিলো। এবং পরিকল্পনামাফিক ১১ই জুলাই এই বর্বরবাহিনী কাউন্টিংরুমে দাপিয়ে বেড়িয়ে, বিডিও-প্রশাসন-সরকারী সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে গ্রামের মানুষের রায়কে বদলে দিলো। স্ট্রংরুমের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবো, প্রতিটি বুথের কার্যকর্তাদের কথা দিয়েছিলাম, মার খেয়েছি কথা রাখতে গিয়ে। তবে, ওদের এতটা টার্গেট ছিলাম আগে জানা ছিলোনা,সেদিন ওদের আমাকে মেরে দেওয়ার চেষ্টায় এটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। বিডিও সৌরভ মাঝির নেতৃত্বে বারুইপুর পৌরসভার কাউন্সিলর গৌতম দাস, বারুইপুর পশ্চিম বিধায়ক বিমান ব্যানার্জী, বারুইপুর পূর্ব বিধায়ক বিভাস সরদার, বারুইপুর ব্লক সভাপতি কালু চক্রবর্তী সহ একাধিক তৃনমূল নেতার নেতৃত্বে ভোট লুট হয়েছে।


২০১৮-এর পুনরাবৃত্তি যেন ২৩-এ না হয়। পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণার আগে থেকে এবং ঘোষণার পরে শাসক বিরোধী সবার মুখে একত্রে শোনা গিয়েছিল এই লাইন। যদিও যুযুধান এই বিরোধীপক্ষগুলির উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। বাস্তবে D-Day অর্থাৎ ভোটগ্রহণের দিনে দেখা গেল ১৮-এর ছবি তেইশে ফেরেনি ঠিকই, বরং সন্ত্রাস মিটারে ভয়াবহতা আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে নয়া বেঞ্চমার্ক সেট করেছে চলতি বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচন। বোমা-ছাপ্পা-গোলাগুলিতে রক্তে ভিজল বাংলার মাটি। ১০ ঘণ্টায় গণতন্ত্রের রক্তপুজোয় বলি ১২টা তরতাজা প্রাণ। বাংলার বুকে নামল ‘রেড স্যাটার্ডে’।


উপস্থিত পরীক্ষা লগ্ন। এমন অবস্থায় একজন পড়ুয়ার যেই অবস্থা হবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এদিনের অবস্থা অনেকটা সেই পড়ুয়ার মতো। প্রস্তুতির নিয়ে অনেক পরিকল্পনা থাকলেও সিলেবাস শেষ না হওয়া পড়ুয়া পরীক্ষা সামলাতে ল্যাজে গোবরে। ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েও ভোটের সকাল পর্যন্তও মেলেনি পর্যাপ্ত বাহিনী নির্বাচন কমিশনের গাফিলতি বা কোয়াপরেশনের অভাবে। প্রত্যেক বুথে ভোটের শেষ লগ্ন অবধিও মেলেনি কেন্দ্রীয় বাহিনী। কমিশন সূত্রে খবর, ৬০ হাজার বুথের মধ্যে মাত্র ১৫ হাজার বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন সম্ভব হয়েছিল। বুথে বুথে সন্ত্রাস, ছাপ্পা, বোমা বাজি, মৃত্যু এই নিয়েই শেষ হয়েছে গ্রামীণ প্রশাসনের নির্বাচনী প্রক্রিয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.