কলকাতা, (হি স)। “তখন সকলে বলিল- ‘বাহবা বাহবা, বাহবা নন্দলাল।’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ত নন্দলাল হতে চাইছেন।“
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত কবিতার লাইনটা আওড়ে ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-কে এই মন্তব্য করলেন প্রবীন সংবিধান বিশেষজ্ঞ তথা প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রবীণ শিক্ষাবিদ অমল মুখোপাধ্যায়।
ভোটের আগেই রাজ্যে বিধান পরিষদ গঠনের কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য অনেক রাজ্যে বিধান পরিষদ থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে নেই। এবার সেই বিধান পরিষদ গঠনের পথে এক ধাপ এগিয়ে গেল রাজ্য সরকার। সোমবার মন্ত্রিসভার সংক্ষিপ্ত বৈঠকে এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ৩টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
রাজ্যের ক্ষেত্রে বিধান পরিষদ অনেকটা সংসদের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভার মতো কাজ করে। সে ক্ষেত্রে বিধান পরিষদের সদস্যরা মন্ত্রিসভার সদস্য হতে পারবেন। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী যদি বিধান পরিষদের সদস্য হন তবে তাঁকে আর বিধানসভা ভোটে জিতে আসতে হবে না।
বর্ষীয়ান অমলবাবু পশ্চিমবঙ্গে বিধান পরিষদ তৈরির প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে এই পরিষদ ছিল। ১৯৬৯-এ তুলে দেওয়া হয়। এটা না থাকায় কোনও অসুবিধা হয়নি, হচ্ছেও না। রাজ্যের যে আর্থিক অবস্থা, এই পরিষদ তৈরির ভাবনারই কোনও যুক্তি নেই। কিছু মানুষকে পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থামাত্র। এ রাজ্যে সব সিদ্ধান্ত একজনই নেন। নির্বাচিত মন্ত্রীদেরই পর্যাপ্ত ক্ষমতা নেই। সেখানে রাজ্যের সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে মনোনীতরা কী পরামর্শ দেবেন? কী ভূমিকা হবে তাঁদের?“
কেন তাহলে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে? উত্তরটা নিহিত আছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ওই কবিতায়—
‘আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?’
তখন সকলে বলিল- ‘বাহবা বাহবা বাহবা বেশ।’ অমলবাবুর কথায়, ’‘উনি বাহবা পেতে চাইছেন। এটা অনেকটা পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। এর জন্য বাড়তি কোটি কোটি টাকা আসবে কোথা থেকে?’’। একই সুর সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও রাজ্য কমিটির সম্পাদকমন্ডলীর দীর্ঘদিনের সদস্য, ১৪ বছরের প্রাক্তন বিধায়ক, বিধানসভার প্রাক্তন মুখ্য সচেতক রবীন দেবের।
‘হিন্দুস্থান সমাচার’-কে রবীনবাবু বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে ১৯৬৯-এ অনেক ভাবনাচিন্তার পর এই পরিষদ তুলে দেওয়া হয়। এটা একটা হাতি পোষার মত ব্যাপার। ৫২ বছর আগে বিধান পরিষদ তুলে দেওয়া নিয়ে বিধানসভায় বিতর্ক হয়েছিল। ২০১১-তে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে আসার পর ফের পরিষদ তৈরির চেষ্টা করে। সে সময় সর্বদলীয় বৈঠকে আমার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার অবকাশ হয়েছিল। জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের (আর পি অ্যাক্ট) ধারাগুলো গুলে খেয়েছিলাম। বিধান পরিষদের কোনও দরকার নেই।“
তৃতীয় পর্যায়ের সাংসদ তথা পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যর বক্তব্য, “এমনিতে তত্বের দিক থেকে বিধান পরিষদ ভাল। এ রাজ্যে ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্র। প্রতিটিতে আড়াই লক্ষের ওপর ভোটদাতা। তফশিলি জাতি-উপজাতিদের না হয় সংরক্ষিত কেন্দ্র আছে। কিন্তু চিকিৎসক, শিক্ষক, বিজ্ঞানি, শ্রমিক— এই সব পৃথক গোষ্ঠীর কথা আইন প্রণয়নের সময় সঠিকভাবে অনেক সময়ে তোলা যায় না। আমি মহারাষ্ট্রে বিধান পরিষদের কিছু সদস্যর সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তাঁরা বিরোধী দলের সদস্য হয়েও শাসকপক্ষের মান্যতা পান। তবে, পশ্চিমবঙ্গে সেই পরিস্থিতি আছে কিনা, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন। এরকম পরিষদের মাধ্যমে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি হয়, এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই।“
প্রবীন রাজনীতিক তথা বিধানসভার বিরোধী দলের প্রাক্তন প্রধান কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান বলেন, “বিধান পরিষদের কোনও দরকার নেই। এটায় জনগণের টাকার অপব্যবহার হবে। একটা সময়ে প্রকৃত গুণীদের এই পরিষদের সদস্য করা হত। এটা এখন পেটোয়া লোকদের পুনর্বাসনের জায়গা, অপরাধীদের সম্মেলন হয়ে গিয়েছে। এ সব ভেবেই ’৬৯-এ এ রাজ্যে পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। গত ৫০-৬০ বছরে দেশে নতুন করে কোনও রাজ্যে বিধান পরিষদ তৈরি হয়নি।“
রাজ্য মন্ত্রিসভায় যে প্রস্তাব গ্রহণ হয়েছে, তা এর পর যাবে রাজ্যপালের কাছে। রাজ্যপালের অনুমোদন পেলে সেই প্রস্তাব এর পর যাবে বিধানসভায়। সেখানে আলোচনার পর পাশ হলে তা আইনে পরিণত হবে। এবং আইনসভায় আলোচনার মাধ্যমে বিধান পরিষদের নিয়ম নীতি নির্ধারণ করবেন বিধায়করা।
আব্দুল মান্নান মনে করেন, গাছে কাঁঠাল গোঁপে তেল। কেন্দ্র অনুমতিই দেবে না। বিধান পরিষদের ভালমন্দের প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? একই মত রবীন দেবের। তাহলে তৃণমূল সরকার পরিষদ তৈরির লক্ষ্যে এগোচ্ছে কেন? রবীনবাবুর বক্তব্য, “তৃণমূলনেত্রীর ঝুলিতে এরকম অনেক ভাবনা আছে। এর পর চেঁচাবে, কেন্দ্র দিচ্ছে না দিচ্ছে না বলে। যেমন রাজ্যের নামবদল নিয়ে করেছেন।”
হিন্দুস্থান সমাচার/ অশোক সেনগুপ্ত