(মকর সংক্রান্তি উৎসব উপলক্ষে)
ভূগোলের মাস্টারমশাই খুব সুন্দর করে বুঝাচ্ছিলেন – সূর্যকে প্রদক্ষিণের সময় পৃথিবীর মেরুরেখা কক্ষতলের সঙ্গে সাড়ে ছেষট্টি (৬৬.৫) ডিগ্রী কোণে হেলানোভাবে অবস্থান করে বলে বছরের বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে দিন রাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধি হয়।বছরের ছয় মাস পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ এবং বাকি ছয় মাস পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ সূর্যের দিকে সাড়ে ছেষট্টি (৬৬.৫) ডিগ্রী কোণে কাত হয়ে বা হেলে থাকে (চিত্র নং ১)। তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে চকিতে অরূপের মনে পড়লো এক নক্ষত্র খচিত অমাবস্যার রাতের কথা।মামাবাড়িতে দাদু সেই রাত্রে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, দিকচক্রের সাপেক্ষে রাতের আকাশের তারারা ক্রমশ: পূর্ব থেকে পশ্চিমে সরে যায় বটে, কিন্তু ওদের নিজেদের মধ্যে তুলনামূলক অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয় না।তারারা আকাশে কয়েকটা মিলে দল বেঁধে থাকে।গঠন করে নির্দিষ্ট নক্ষত্র বা তারকাপুঞ্জ অথবা তারকামন্ডল-যারা সবাই মিলে একই চেহারা বজায় রেখে অনন্ত কাল ধরে মহাকাশে ছুটে চলেছে, ছুটেই চলেছে। পৃথিবী থেকে মনে হয় সূর্যও চলছে, আর ঘুরতে ঘুরতে ওইরকম পরপর কতকগুলি নক্ষত্রের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রতি ভারতীয় মাসে সূর্য এই আপাত গতিতে একটা না একটা নক্ষত্র রাজ্যের সামনে দিয়ে চলে যায়। এই প্রত্যেকটা নক্ষত্রকে বলে রাশি।এইভাবে বারো (১২) মাসে বা এক বছরে বারোটা নক্ষত্র সূর্যের পথে পড়ে (চিত্র নং ২)। সূর্য যতক্ষণ এক একটা রাশির মধ্য দিয়ে যেতে থাকে, হিন্দুরা ততক্ষণকে একটা ‘মাস‘ বলে ধরেন। আর সূর্য যখন মাসের শেষে এক রাশি ছেড়ে অন্য রাশিতে সংক্রমণ করে (মানে,চলে যায়), সেই যাওয়াকে বলে ‘সংক্রান্তি‘।
পরপর গোল করে সাজানো বারোটা রাশিকে একসঙ্গে বলা হয় রাশিচক্র। এই বারোটা রাশি বা বিশেষ নক্ষত্রদের নাম – মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ এবং মীন। সূর্য বৈশাখ মাসে মেষ রাশিতে থাকে মানে এক ধার থেকে অন্য ধার পর্যন্ত যায় বলে মনে হয়। তারপর জ্যৈষ্ঠে বৃষ রাশিতে।ক্রমে আষাঢ়ে মিথুন রাশি, শ্রাবণে কর্কট …….
মাস্টারমশাই তখনো পড়িয়ে চলেছেন। প্রতিবছর ২১শে ডিসেম্বর (পৌষ মাস) – এর পর থেকেই সূর্যের উত্তরমুখী আপাতগতি বা উত্তরায়ণ শুরু হয় এবং ক্রমশ ধনু রাশি অতিক্রম করে পৌষ সংক্রান্তির দিন সূর্য মকর রাশিতে প্রবেশ করে (সাধারণত ১৪ ই জানুয়ারি)। তাই ওই সংক্রান্তির দিনটিকে মকর সংক্রান্তি বলে। উত্তরায়ণের ফলে উত্তর গোলার্ধে (যার মধ্যে আমাদের ভারতবর্ষের অবস্থান) দিন ক্রমশ: বড় ও রাত্রি ক্রমশঃ ছোট হতে থাকে।
ভারতবর্ষের সংস্কৃতিতে সূর্যের এই উত্তরায়ণ তথা মকর সংক্রান্তি উত্তরণের দ্যোতক হিসেবে গণ্য হয়।জীবনের রাত্রিরূপ সকল অসত্য, অন্ধকার, অজ্ঞানতা ও জড়ত্ব থেকে মুক্তি লাভের চিরকালীন আকাঙ্ক্ষা, ‘অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মা অমৃতংগময়‘ উত্তরায়ণের নবোদিত অরুণালোকে যেন ভাস্বর হয়ে ওঠে।অলস শীতের দীর্ঘরাত্রির অবসানে নব আনন্দে, নব জীবনে, নব জ্যোতির্ময়ী ঊষার হাসি যখন ফুলে ফুলে, মধুর বাতাসে কিংবা পাখির কলকাকলিতে ছড়িয়ে পড়ে, প্রাণে জাগে নূতন উন্মাদনা তখন কবি গেয়ে ওঠেন-
‘‘ চলো যাই কাজে মানব সমাজে, চলো বাহিরিয়া জগতের মাঝে-
থেকো না অলস শয়নে, থেকো না মগন স্বপনে।
………………
ফেলো জীর্ণ চীর, পরো নব সাজ, আরম্ভ করো জীবনের কাজ-
সরল সবল আনন্দমনে, অমল অটল জীবনে।‘‘
তাই মকর সংক্রান্তির পুণ্য প্রভাতে অলস শয্যা ত্যাগ করে মকরবাহিনী গঙ্গায় কিংবা পুণ্যতোয়া নদ-নদীতে অবগাহন করেন হিন্দু নরনারী। জীর্ণ পুরাতনকে বিসর্জন দিয়েই নব আনন্দে জীবনের কাজে এগিয়ে চলে। বাঙালীর ঘরে ঘরে আনন্দের রেশ। বাতাসে পিঠে-পুলির সুবাস, ভাজা তিলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা চারিদিক। আজ তো পৌষ-পার্বণ, তিল সংক্রান্তিও বটে। স্নেহপূর্ণ বিচ্ছিন্ন তিল রাশি গুড়ের মিষ্ট পাকে সুস্বাদু অথচ নিরেট নাড়ুতে পরিণত – এ যেন রূপকার্থে সুসংহত জাতির পরিচায়ক। বিচ্ছিন্ন সমাজকে সাংগঠনিক শক্তির সংস্কারিত পাকে বেঁধে এক শক্তিশালী সুশীল সমাজ গঠনের ইঙ্গিত।
দেশকে পরম বৈভবশালী করার লক্ষ্যে, সুসংগঠিত রাষ্ট্রীয় জীবন তথা ঐক্যবদ্ধ হিন্দু সমাজ গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এই মকর সংক্রান্তির দিনটিকে উৎসব হিসেবে পালন করে। পালন করে জাতীয় জীবনে সহমর্মিতা ও সমরসতার দিন হিসেবে। এদিন সমাজের সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে, অস্পৃশ্যতা ও নানাবিধ কুসংস্কার দূর করে একাত্মতার সংকল্প গ্রহণের দিন হিসেবে পালন করে সঙ্ঘ। অরূপের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় এই মহৎ উৎসব পালনের তাৎপর্য।
আত্মবিস্মৃতিরূপ অন্ধকার বিনাশ করে জাতীয় জীবনে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও একাত্মবোধের উদ্বোধনই হল সঠিক দিশায় পরিবর্তনের সংক্রান্তি। ভারতবর্ষের সর্বাঙ্গীণ উন্নতিই হলো সম্যক্ ক্রান্তি। সুসংহত, সুশীল, বীর্যশালী হিন্দু জাতি গঠনই হল পরিপূর্ণ ক্রান্তি- আর এ সকল কাজই গত প্রায় নয় দশকের বেশি সময় ধরে করে চলেছে সঙ্ঘ।প্রত্যেক স্বয়ংসেবকই এই ক্রান্তিতে অংশগ্রহণকারী এক একজন বীর সেনানী। ভারতমাতার জয়ই তাদের একমাত্র কাম্য। সঙ্ঘকার্যে নিবেদিত অনুভবী অরূপের মন ভরে ওঠে গর্বে। কারণ এই বিপ্লবে সেও তো অংশীদার।
মকর সংক্রান্তির দিনটি এত পবিত্র যে পিতামহ ভীষ্মও তাঁর ইচ্ছামৃত্যুর জন্য এই দিনটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। দেশবরেণ্য হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম এই তিথিতে। একাত্মতার আহ্বানে গঙ্গাসাগরে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মানুষ পুণ্যস্নানের জন্য ছুটে আসেন এই দিনটিতেই। এই পবিত্র দিনেই ১৯৩৮ সালে উদ্বোধন হয়েছিল বেলুড় মঠের।তাই আলোয় ফেরার এই দিনটিতে মেতে দেশবাসী উৎসব পালন করবে বৈকি। তাই মকর সংক্রান্তি উৎসব পালনে শাখার পথে দৃপ্ত স্বয়ংসেবকদের গলায় বাজে সমবেত আবৃত্তির ধ্বনি-
‘‘ জাগুক মন, কাঁপুক বন, উড়ুক ঝরা পাতা-
উঠুক জয়, তোমারই জয়, তোমারই জয়গাথা।‘‘
ডা: শিবাজী ভট্টাচার্য