বিজয় দিবস (১৬ ই ডিসেম্বর)

২৫ শে র্মাচ, ১৯৭৯ শুরু হল স্বাধীনতা সংগ্রাম। তাঁরা বললেন’ মুক্তিযুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানের কাছ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের যুদ্ধ, পশ্চিম-এর মুসলিম দমন পীড়নের হাত থেকে পূর্বের মুসলমানদের স্বাধিকার অর্জনে আন্দোলন, উর্দু ভাষার নামপাস থেকে বাংলা ভাষা তথা পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির মুক্তির লড়াই।

দ্বিজাতি তত্ত্ব তথা মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্প সেই ১৮৫৭-র স্বাধীনতার প্রথম মহাসংগ্ৰামের পর থেকেই ক্রমশঃ ভারতবর্ষের রাজনৈতিক তথা সামাজিক বাতাবরণকে গ্ৰাস করতে শুরু করে। ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে মুসলিম বুদ্ধিজীবিদের একাংশ প্রচার করতে শুরু করে যে, হিন্দু ও মুসলিম কেবল দুটি পৃথক জাতিই নয় – পরস্পর বিরোধী স্বার্থযুক্ত এবং যুদ্ধরত দুটি পৃথক জাতি। ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত “আলিগড় অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ” ( অধুনা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়) ও তার ব্রিটিশ অধ্যক্ষ এবং সৈয়দ আহমেদ খান প্রমুখ দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রচারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্ৰহন করে। ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু মেলার উদ্যেক্তরা যখন অখন্ড ভারত ও এক ভারতীয় মহাজাতি গঠনের স্বপ্ন দেশবাসীকে দেখাচ্ছিলেন, পরবর্তী সময়ে ‘ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন (১৮৭৬) ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫) – এর নেতৃত্বে যখন দেশবাসী দের মধ্যে দেশাত্মবোধের উদ্ধোধন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ও স্বদেশী আন্দোলনের বীজ বপন করেছিলেন তখন কিছু মুসলিম নেতা “আলিগড় ইনস্টিটিউট গেজেট” পত্রিকার মাধ্যমে হিন্দু – বিদ্বেষ, বাঙালি – বিদ্বেষ ও কংগ্রেস – বিদ্বেষ প্রচার করতে থাকে। ১৯০৫ সালে শুরু হওয়া বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে যখন দুর্মর হয়ে উঠেছে ঠিক তখনই ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার নবাব সালিমুল্লার নেতৃত্বে ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় ” সর্বভারতীয় মুসলিমলিগ”। মুসলিম স্বার্থরক্ষা এবং কংগ্রেস তথা হিন্দু বিরোধীতাই এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য।


১৯৫২ থেকে ১৯৭১ ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মা দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গেল। দেখা গেল পশ্চিমাদের থেকে বাঙালির সংখ্যা শুরু হওয়া সত্ত্বেও, পাকিস্তান পার্লামেন্টে পূর্ব পাকিস্তানের সিট সংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যার চেয়ে বেশী হওয়া সত্ত্বেও, পূর্ব পাকিস্তানের শেখ মুজিবরের আওয়ামী লিগ সমগ্ৰ পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় পার্টি হওয়া সত্ত্বেও মুজিবনে প্রধানমন্ত্রী না করে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো কে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হল। কারণ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পলিসি হচ্ছে সমস্ত ক্ষমতা পশ্চিম খন্ডেই কেন্দ্রীভূত করা। আর্মি সেখানে, নেভি সেখানে, এয়ার ফোর্স সেখানে, সিভিল সার্ভিসের উচ্চপদস্থ আমলারা সেখানে। সেখান থেকেই গভর্নর নিযুক্ত করা হয়।
বছর কয়েক আগে থেকে স্বাধিকারের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন চলছিলই। চলছিল সেই আন্দোলন দমিয়ে রাখার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের দমন – পীড়ন। মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী না করায় অথবা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীকার না দেওয়ায় বিদ্রোহ ঘনিয়ে ওঠে। একাত্তর সালের ৭ ই মার্চ মুজিব ঘোষণা করেন, এ বার বার সংগ্ৰাম স্বাধীনতা সংগ্রাম। কোনও রকম রাখা নিস্পত্তি না করে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য সমাবেশ করায় আন্দোলন হিংসার পথ নেয়। ২৫ শে র্মাচ, ১৯৭১ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়।

গ্ৰেপ্তার হবার আগে মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান এবং তিনি তাঁর দেশের নামকরণ করেন ” বাংলাদেশ” । তাঁর সেই বার্তা মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের একটি বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার করেন। সৈন্য দলকে ডাক দেন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। সেটা এক দুঃসাহসিক ঘটনা।


ভাবতে লজ্জা হয় যে জাতীয়তাবাদী সবল নেতৃত্বে একদিন বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ করতে সমর্থ হয়েছিল (১৯১১) মাত্র ৩৬ বছরের ব্যবধানে সেই জাতীয়তাবাদী কিন্তু দুর্বল ফলে দেশ বিরোধী শক্তি মুসলিম লিগ শুধুমাত্র দ্বিজাতি তত্ত্বের ভ্রান্ত ধারণা ও দেশ ভাগের আব্দার সফল করে আমাদের মাতৃভূমিকে তিন টুকরো করে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান আদায় করে নিল। কমিউনিষ্টদের মদতে ইংরেজদের চক্রান্তে এবং কংগ্রেসী নেতৃত্বের অদূরদর্শী দুর্বলতা ও বিশ্বাস ঘাতকতা মুসলিম লিগকে শক্ত জুগিয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করতে (১৫ই আগষ্ট, ১৯৪৭)। লক্ষ্য লক্ষ্য হিন্দু নর-নারীর জীবন, জীবিকা, সম্পদ ও সম্মান ধ্বংস করে সৃষ্টি হল মুসলিম দেশ পাকিস্তান। স্বাধীনতা সংগ্ৰামী হিন্দুরা ভেসে গেল উদ্বাস্তুর স্রোতে । অনিশ্চিতের টানে খন্ডিত ভারতের নানা প্রান্তে।
কিন্তু, কিছু দিনের মধ্যেই দ্বি-জাতি তত্ত্বের অসারক্ত প্রমানিত হতে থাকল। পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিমরা একত্র অধিনায়কত্ব দেখাতে শুরু করল পূর্ব পাকিস্তানের উপর। পশ্চমারা বললেন , বাংলা হল হিন্দুর ভাষা, তাতে আরও বেশি আরবি- ফরাসি শব্দ মেশাতে হবে এবং বাংলা লিপির বদলে আরবি চালু করতে হবে। পূর্বের বাঙালিরা বলল, না। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাসাহেব ঢাকায় এসে ঘোষণা করলেন উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা। পূর্বের জনতা বলল, না। ১৯৫২ সালের ২১ শেষ ফেব্রুয়ারী কয়েকজন বাঙালি মুসলিম যুবক উর্দু চাপিয়ে দেশের বিরুদ্ধে প্রান দিয়ে প্রতিবাদ জন্মায় – না, না , উর্দু নয়, বাংলা। তারা মাতৃভাষাকে ভালোবাসে, সে ভাষাকে তারা ছাড়বে না। ক্রমশ পূর্ব পাকিস্তানের বাংলার দাবি জোরদার হয়। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে সেখানে মুসলিম লিগ হেরে যায়। ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান নীতির দিক থেকে পরাস্তু হয়।

পাকিস্তানী ফৌজের তুলনায় বিদ্রোহী ফৌজের জোর কতুটুকু? তা সত্ত্বেও বহু বাঙালি সেনা বিবিধ রণাঙ্গনে লড়াই করতে থাকেন মুজিবের অনুগামীরা এই যুদ্ধের নাম দিলেন মুক্তিযুদ্ধ আর ফৌজের নাম হল মুক্তি ফৌজ। মুজিবের বিশিষ্ট অনুগামীরা অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন এবং নদীয়া সীমান্তের মেহেরপুর মহকুমার একটি গ্ৰামকে মুজিবনগর নাম দিয়ে সেই অস্থায়ী সরকারের রাজধানী করেন। পরে সেই অস্থায়ী সরকার কোলকাতার তৎকালীন লোয়ার সার্কুলার রোডের একটি ( আশুতোষ ঘোষ -এর) বাড়িতে সরে আসে।দিন যত পেরোয়, খাঁন সেনাদের অত্যাচার তত বাড়ে। ততোধিক বাড়তে থাকে পশ্চিমবঙ্গেঁ শরনার্থীদের ঢল। শরনার্থীদের বেশিরভাগই হিন্দু। শরনার্থীদের সংখ্যা কেবলই বাড়তে থাকে। তাদের থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা ও বিবিধ বিষয়ে সরকারী খরচও বাড়তে থাকে সমহারে। অন্য অনেক বেসরকারী সংস্থা বিশেষ করে বাস্তুহারা সহায়তা সমিতি লক্ষ লক্ষ হিন্দু শরনার্থীদের সহায়তায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। ক্রমে শরনার্থী স্রোত বেসামাল হয়‌ এক কোটি ছাড়িয়ে যায়। ওপার বাংলায় মানুষ মরতে থাকে লাখে লাখে। আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, চীন তথা সব তথাকথিত মানবতার ধ্বজাধারী উন্নত রাষ্ট্রগুলি চোখ বুজে থাকে। পাকিস্তানী খাঁন সেনাদের অত্যাচার সকল ভব্যগ, সভ্যতার সীমা ছাড়িয়ে এক বর্বর পৈশাচিক পরিবেশ তৈরী করে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে। পাকিস্তানীরা রাজাকারদের মাধ্যমে বাংলাদেশের সেরা বুদ্ধিজীবিদের নির্মম ভাবে হত্যা করে, কারণ তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কলম ধরেছিলেন।
টানা আটমাস অর্থাৎ নভেম্বর, ১৯৭১ অবধি ভারতবর্ষ প্রতিবেশী পাকিস্তানের অপকর্ম সহ্য করে গভীর ধৈর্য্যের সঙ্গে বাংলাদেশী শরনার্থী ও দুর্গতের সেবায় নিয়োজিত ছিল। নজর রেখেছিল পাকিস্তানী গতিবিধির উপর। মুক্তিবাহিনী চাইলেও ভারত যুদ্ধে জরিয়ে পরেনি।

কিন্তু যেদিন (৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১) পাকিস্তান ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তে আক্রমন করল সেইদিনই রাত্রে আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দিয়ে। ঐ দেশের নরহত্যা তথা মানবতা বিরোধী শক্তি বিনাশের জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার সংকেত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দিলেন। লে. জে জগজিৎ সিং অরোরার নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৭১ ভারতীয় সীমা পেরিয়ে ভীম বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাকিস্তানী সেনার উপর। তারপর শুধু ভারতীয় সেনাদের বীরত্বের কাহিনী। জল – স্থল – অন্তরীক্ষে সব বিভাগেই যুদ্ধ চালিয়ে মাত্র বারোদিনের মধ্যে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকা দখল করে, সূচিত হয় ” বাংলাদেশের” স্বাধীনতা। প্রমানিত হল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সাড়ে ২৪ বছর আগের ভারত ভাগ ছিল সম্পূর্ণ ভুল একটি সিদ্ধান্ত। মাত্র বারোদিনের মধ্যে ভারতীয় সেনারা পশ্চিম- পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈনিকে ভারতের সামনে যুদ্ধ বন্দী করে ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসা প্রায় এক কোটি হিন্দুকে বাংলাদেশে পুনর্বহাল করে দিলেন – এরকম অভূতপূর্ব বিজয় বিশ্বের সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে কখনো শোনা যায়নি। তাই ১৬ ই ডিসেম্বর প্রতিবছর আমরা ঐ বিজয় স্মরনে বিজয় দিবস পালন করি।

ডাঃ শিবাজী ভট্টাচার্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.