সঠিক সময়ে চিত্রনাট্যে ব্যবহার করে ‘মুখোশ’ (Mukhosh) নামের ছবিতে তিনি শুধু পুলিশের মুখোশ খোলেননি, সমাজের আরও কিছু প্রতিষ্ঠিত মানুষের প্রকৃত মুখ দেখিয়ে দিয়েছেন

সাম্প্রতিক বাংলা সিনেমায় রহস্য, গোয়েন্দা গল্প, খুন, তদন্তের অ্যাকশন – এসব নিয়েই একটু বেশি চর্চা। ফেলুদা (Feluda) এবং ব্যোমকেশের (Byomkesh) বুদ্ধি ও মগজের খেলাও বেশ জমাটি বাজার তৈরি করে নিয়েছে। এই চেনা স্রোত ও ছকের বাইরে গিয়ে বিরসা দাশগুপ্ত (Birsa Dasgupta) এক নতুন ধারার “Who done it” কাহিনিতেও অন্যরকম টুইস্ট এনে সত্যিই একটি নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করলেন দর্শকদের। তাঁর হাতে তুরুপের তাস ছিল অনেকগুলোই, প্রত্যেকটিকে সঠিক সময়ে চিত্রনাট্যে ব্যবহার করে ‘মুখোশ’ (Mukhosh) নামের ছবিতে তিনি শুধু পুলিশের মুখোশ খোলেননি, সমাজের আরও কিছু প্রতিষ্ঠিত মানুষের প্রকৃত মুখ দেখিয়ে দিয়েছেন।

পরিচালকের প্রথম হাতিয়ার দুই অনির্বাণ (ভট্টাচার্য ও চক্রবর্তী), চান্দ্রেয়ী ঘোষ, টোটা রায়চৌধুরী, কৌশিক সেন। এঁরা প্রত্যেকেই চিত্রনাট্যের পাতা ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছেন চরিত্র হয়ে। বিশেষ করে দুই অনির্বাণ। অনির্বাণ ভট্টাচার্য (Anirban Bhattacharya) চরিত্রের ভিতরে সুন্দরভাবে ঢুকে পড়েন এবং স্বাভাবিক আচরণ করেন অনির্বাণ চক্রবর্তী (Anirban Chakrabarti)। তাঁর চরিত্রের অপরাধবোধের অসহায়তা খুব সূক্ষ্মভাবে জানিয়ে দেন। পরিচালকের দ্বিতীয় হাতিয়ার চিত্রনাট্য (সাকেত বন্দ্যোপাধ্যায়)।


ছবির শুরু পরপর তিনজন পুলিশ অফিসারের খুন হওয়া দিয়ে। খুনি সংকেত হিসেবে অকুস্থলে রেখে যায় একটি করে ক্রস এবং মৃতের হৃৎপিণ্ড বার করে নেয়। এই সিরিয়াল খুনের তদন্তের দায়িত্ব পড়ে পুলিশের বড় অফিসার কাবেরী (চান্দ্রেয়ী), ইন্সপেক্টর অধৃষ্য(অনির্বাণ চক্রবর্তী) এবং তরুণ অপরাধবিজ্ঞানী কিংশুক-সহ (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) এক টিমের ওপর। শুধু খুনি কে সেটা নয়, খুনের মোটিভ জানাটাও এক্ষেত্রে জরুরি, যে কারণে কিংশুকের আগমন। একসময় সেই-ই হয়ে ওঠে প্রায় প্রধান তদন্তকারী। খুনির মানসিকতার খোঁজ নিতে গিয়েই এমন একজন মানুষের সন্ধান মেলে যাঁকে কোনওভাবেই খুনি ভাবা সম্ভব নয়। আর এখানেই বিরসা গল্পতে এক অভিনব মোচড় দিয়ে যান।

রহস্য গল্প, সুতরাং রহস্য বজায় থাক! কিন্তু তুরুপের এই দু’টি তাসকে তিনি সুচারুভাবে বুদ্ধি ও নাটকীয় ভঙ্গিমাতে ব্যবহার করে ‘মুখোশ’কে দর্শকের কাছে উপভোগ্য করে তুলেছেন। তাঁর হাতে তিন নম্বর তাসটি হল শুভঙ্কর ভরের (Subhankar Bhar) অসাধারণ মুড ফটোগ্রাফির কারুকাজ। বাড়িঘর, কারখানা, পুলিশের অফিস, আউটডোর সর্বত্র তাঁর ক্যামেরার লেন্স যেন কথা বলেছে।


একজন শিক্ষিত, ভদ্র, স্বাভাবিক মানুষ কীভাবে, কেন এবং কখন কোন পরিস্থিতিতে ‘খুনি’র মুখোশ পড়তে বাধ্য হয়, কখন সে নৈতিকতার বেড়া ভেঙে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে ওঠে? ছবিতে সেটাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। চিত্রনাট্যের বৈশিষ্ট্যও এখানেই। বিরসার পরিচালন কৌশলে যথার্থ প্রফেশনালিজমের ছাপ এই প্রথম দেখলাম। বোঝা গেল হরিসাধন-রাজার উত্তরসূরি হয়ে ওঠার পথেই এগোচ্ছেন তিনি। এবার শুধু প্রয়োজন একটু সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিচয় রাখা। একেবারে বাস্তব ও সমাজ বিমুখ হয়ে পেশাদার পরিচালক হওয়া যায়, কিন্তু তখন ব্যবসায়িক মুখোশটাই মুখ হয়ে যায় যে, সেটা যেন না হয়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.