১৪ই সেপ্টেম্বর হিন্দিদিবস উপলক্ষ্যে দেশ জুড়ে হিন্দি ভাষার ব্যবহার বাড়ানোর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী অমিত শাহ্। বললেন, সারা দেশের প্রতিটি রাজ্যে হিন্দি হতে পারে অন্যতম প্রধান সংযোগ মাধ্যম। অমিত শাহ্ আরও বলেছেন যে ভারতবর্ষ নানাভাষাভাষী মানুষের দেশ এবং ভারতবর্ষের কোনো ভাষাই কোনো বিদেশী ভাষার চেয়ে কম সমৃদ্ধ নয়। তবে বহু প্রদেশ সমন্বিত ভারত রাষ্ট্রের সমস্ত রাজ্যে কোনো একটি নির্দিষ্ট ভাষা, যেমন হিন্দি, যদি সাধারণ সংযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে তা ভারতের আভ্যন্তরীণ ঐক্যকে বাড়াতে সাহায্য করবে। অর্থাৎ হিন্দিকে দেশের ঐক্যের ভাষা হিসেবে উপস্থাপন করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্। তিনি বলেন, একটি ভারতীয় ভাষাকে সমস্ত প্রদেশের সাধারণ সংযোগ মাধ্যম হিসেবে রাখার জন্যই আমাদের সংবিধান-রচয়িতারা ইংরিজির পাশাপাশি হিন্দিকে রেখেছিলেন দেশের রাজভাষা হিসেবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ হেন বক্তব্য প্রত্যাশিতভাবেই দেশজুড়ে উসকে দিয়েছে বিতর্ক ও সমালোচনা। মেইনস্ট্রিম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি ও প্রতিযুক্তির। সমাজ-সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত দিক থেকে অপরিসীম বৈচিত্র্যের দেশ হওয়া সত্ত্বেও ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ ই হল ভারতীয় গণতন্ত্রের চিরকালীন ভাবধারা। এতদসত্ত্বেও ঐক্যের ভাষা হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলাদাভাবে হিন্দিকে তুলে ধরতে চাওয়ায় তা তুলে দিয়েছে বহু প্রশ্ন, উস্কে দিয়েছে সন্দেহ, সমর্থন এবং অবশ্যই প্রবল প্রতিবাদও। অনেকেই আন্দাজ করছেন এবং অনেকেই অখুশি যে অদূর ভবিষ্যতে হিন্দিকেই হয়ত রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে চলেছে এন ডি এ। অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে যে তা নাহলে অমিত শাহ্ এই সময়েই প্রায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে শুধুমাত্র “হিন্দি দিবস” উদযাপন উপলক্ষে হঠাৎ হিন্দিকে একেবারে সর্বভারতীয় যোগাযোগের ভাষা হিসেবে তুলে ধরতে চাইলেন কেন?
এই কেন’র উত্তর খুঁজতে গেলে এবং মাননীয় গৃহমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা ও তাৎপর্য বুঝতে গেলে আমাদের একটু নজর ঘোরাতে হবে ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া আর একটি আলোড়নকারী ঘটনার দিকে।
সম্প্রতি ভারতেরই একটি রাজ্য আসাম হয়ে উঠেছে প্রাদেশিক রাজনীতির অভিঘাতে উত্তাল। ‘আসাম অ্যাকর্ড’ নামক প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট সাংবিধানিক ধারার বলে এন আর সি করে আসাম তাদের ১৯ লক্ষ অধিবাসীকে নাগরিকত্বহীনতার অভিযোগে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাতে চাইছে। ঠিক সেই কারণে এই সময়েই সর্বভারতীয় ঐক্যের ভাষার প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন অমিত শাহ।
আসাম এন আর সি’র পরিপ্রেক্ষিতে গৃহমন্ত্রীর বক্তব্যের তাৎপর্য সম্যক বুঝতে হলে আসাম এন আর সি’র প্রেক্ষাপট কিছু বলা প্রয়োজন।
আসামে এন আর সি হয়েছে আসাম অ্যাকর্ড অনুযায়ী। আসাম অ্যাকর্ড পাশ করিয়ে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন রাজীব গান্ধী, ১৯৮৫ সালে। রাজনৈতিক দলমত নির্বিশেষে অসমীয়াদের প্রায় সকলেরই দাবী ছিল যে আসাম অনুপ্রবেশকারী-মুক্ত হোক। আসাম-বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে আসামে অনবরত মানুষের ঢল নিয়ে অসমীয়ারা ছিল ক্ষোভে উত্তাল। তাঁদের দাবী ছিল আসাম হোক কেবলমাত্র আসামের ভূমিপুত্রদের জন্য, যাঁরা অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। ১৯৮৫র আসাম অ্যাকর্ড তাঁদের এই সমস্ত দাবীগুলিকে সাংবিধানিক মান্যতা দিয়েছিল। আসাম অ্যাকর্ডের ওপর ভিত্তি করেই হল আসাম এন আর সি যার চূড়ান্ত তালিকায় আসামের ১৯ লক্ষ অধিবাসীর নাম উঠল না। অর্থাৎ এঁরা আসামের নাগরিক নন বলে ঘোষিত হলেন। খবরে প্রকাশ যে এমন বহু মানুষের নাম এন আর সি’র চূড়ান্ত তালিকায় ওঠে নি যাঁরা নিশ্চিতভাবেই আসামের নাগরিক। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও নাম ওঠেনি এমন সংখ্যাও প্রচুর। ফলে প্রশ্ন উঠেছে যে এমনভাবে নাম বাতিল ইচ্ছাকৃত কিনা। অসমীয়ারা চিরকালই বিদ্বেষ পোষণ করেন বাঙালীর বিরুদ্ধে, বলছেন অনেকেই। বাঙালীর বিরুদ্ধে তাঁরা নাকি উগ্র প্রাদেশিকতার অনুভূতি নিয়ে চলেন। আসাম অ্যাকর্ড পাশ হওয়ার আগে পর্যন্ত অসমীয়ারা নিরলস চালিয়ে গিয়েছিলেন সহিংস ‘বঙ্গাল খেদাও’ আন্দোলন। সরেজমিনে ঘুরে দেখে অনেকেই মন্তব্য করছেন যে অসমীয়াদের বিদ্বেষ মূলতঃ হিন্দু বাঙালীর বিরুদ্ধে কারণ হিন্দু বাঙালীর সামনে তাঁরা হয়ত সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক হীনমন্যতায় ভোগেন। আসামের ভালো চাকরিগুলির একটি বড় অংশ রয়েছে হিন্দু বাঙালীর দখলে যা অসমীয়ারা মেনে নিতে পারেন না। হিন্দু বাঙালীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁরা নিজেদেরকে পরাজিত মনে করে একধরনের শত্রুতা অনুভব করেন, বলছেন বহু বিশিষ্ট মানুষও।
এমন পর্যবেক্ষণও রয়েছে যে বাংলায় কথা বলা বাংলাদেশী মুসলমানদের প্রতি একই রকম বিদ্বেষভাব অসমীয়াদের নেই, যদিও তাঁরাও সীমান্ত পার হয়েই বাংলাদেশ থেকে আসামে প্রবেশ করেছেন। এই বাংলাদেশী মুসলমানরা আসামে মূলতঃ চাষবাসের কাজ ও কায়িক শ্রমের কাজ করে থাকেন। চাকরি ক্ষেত্রে বা ভাষা-সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গে তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা অসমীয়ারা হয়ত অনুভব করেন না। মুসলমানরা অনেক বেশি সংহত থাকেন তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে এবং তাতে অসমীয়াদের কোনো আপত্তি হয় না। আসাম এন আর সি’র চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়া ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষই হিন্দু বাঙালী এবং ৫ লক্ষ মুসলমান। অথচ বেশ কয়েকটি জাতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী আসামে মুসলমান-জনসংখ্যার বৃদ্ধির শতকরা হার হিন্দু-জনসংখ্যার বৃদ্ধির শতকরা হারের চেয়ে অনেক বেশি এবং একথা মনে করারও কোনো সঙ্গত কারণ নেই যে আসামে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে মুসলমান নেই, আছেন শুধু হিন্দুরাই। এইসব পরিসংখ্যানগুলিও পরোক্ষে ব্যবহৃত হচ্ছে হিন্দু বাঙালীর প্রতি অসমীয়াদের পক্ষপাতদুষ্ট অপছন্দকে সত্য বলে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে। বাদ পড়া মানুষদের জন্য আসাম তৈরি করছে ডিটেনশন ক্যাম্প। প্রাদেশিকতার এই দ্বন্দ্ব সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে অস্বস্তিতে ফেলছে বিজেপিকেও। আসাম অ্যাকর্ডকে ভারতের সংবিধানে স্থান দিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী, কিন্তু সেই অ্যাকর্ড অনুযায়ী প্রাদেশিকতাভিত্তিক এন আর সি হল বিজেপির সময়ে। ফলে বিজেপিও সংবিধান ও গণতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার দায়ে আদতে অসমীয়া প্রাদেশিক স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হল। এতে ভারতীয় জাতীয়তার সামগ্রিক স্বার্থ যে খানিক ক্ষুন্ন হল তা অনস্বীকার্য এবং বিজেপির মত জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষে যথেষ্ট অস্বস্তিকরও বটে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্বভারতীয় ঐক্যের ভাষা হিসেবে হিন্দির পক্ষে সওয়াল করলেন তখনই যখন আসামে প্রাদেশিকতাভিত্তিক অসহিষ্ণুতার রাজনীতি তুঙ্গে। তাই স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় যে ঐক্যের ভাষার প্রসঙ্গ তুলে অমিত শাহ্ বোধ হয় আসামসহ অন্যান্য সব রাজ্যকেই অতিরিক্ত প্রাদেশিকতার রাজনীতির বিরুদ্ধবার্তা শোনালেন। গৃহমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে একথা স্পষ্ট করেছেন যে সমগ্র ভারতবর্ষকেই ঐক্যবদ্ধ করতে পারে এমন কোনো একটি নির্দিষ্ট সংযোগ-সূত্র এইমুহুর্তে ভারতবর্ষের অত্যন্ত প্রয়োজন। এবং সেই প্রয়োজন মেটাতে পারে কেবলমাত্র কোনো সর্বজনীন ভাষা। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে নিজে একজন অহিন্দিভাষী হয়েও গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ্ ভারতবর্ষের সর্বজনীন ভাষা হিসেবে হিন্দি ভাষাকে তুলে ধরলেও তিনি কিন্তু অন্য কোনো ভারতীয় ভাষাকেই ছোট করেন নি। হয়ত তিনি বিশেষ করে হিন্দিকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন এই কারণেই যে বহুভাষিক ভারতবর্ষে যদি কোনো একটি ভাষাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে হয়, তবে তা ‘সর্বাধিক সংখ্যক ভারতীয় নাগরিকের মাতৃভাষা হিন্দি’ হওয়াই স্বাভাবিক। লক্ষ্য করতে হবে যে তিনি কিন্তু কোনো ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্ব না দেখিয়ে হিন্দিকে কেবলমাত্র উদাহরণ হিসেবেই পেশ করেছেন। আসলে সম্ভবতঃ তিনি কেবলমাত্র একটি সর্বভারতীয় ঐক্যের মাধ্যম খুঁজতে চেয়েছেন। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে তবে কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরোক্ষে স্বীকার করে নিলেন যে ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে পারস্পরিক ঐক্যের অভাব আছে? এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে আর এস এস তৃতীয় বর্ষের বক্তৃতায় সরসঙ্ঘচালক শ্রী মোহন’জী ভাগবতও জোর দিয়েছিলেন বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে সসম্মানে গ্রহন করার ওপরে। বলেছিলেন প্রত্যেক প্রদেশের মানুষের উচিত নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেও অন্যের মধ্যেকার বৈচিত্র্যকে সহমর্মিতার সঙ্গে উপযুক্ত সম্মান করা।
কিন্তু আসাম এন আর সি’র চূড়ান্ত রূপ প্রমাণ করেছে যে অসমীয়ারা অন্ততঃ এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ধারণাটি গ্রহন করতে অক্ষম হয়েছেন। বস্তুতঃ আসাম এন আর সি এবং সে বিষয়ে অসমীয়াদের দৃষ্টিভঙ্গী ভারতীয় মূল্যবোধের সঙ্গেই একধরনের সংঘাত সৃষ্টি করছে। প্রমাণ করেছে যে এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের সার্বিক ঐক্যের জন্য কোনো স্পষ্ট অধিগম্য মাধ্যমের আশু প্রয়োজন। সর্বভারতীয় ঐক্যের খাতিরে গোটা দেশে কোনো একটি নির্দিষ্ট ভাষার পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সওয়াল করা তাই উচিত, প্রাসঙ্গিক এবং সময়ানুগ পদক্ষেপ বলেই মনে হয়। এ বিষয়ে মাননীয় গৃহমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা যাঁরা করবেন, তাঁদের মনে রাখা উচিত যে এই বিরোধিতার দ্বারা তাঁরা পরোক্ষে, হয়ত বা নিজেদের অজ্ঞাতসারেই, আসাম এন আর সি’র বিচ্ছিন্নতাবাদী সুরটিকে সমর্থন করে ফেলবেন। আশা করি কেউই সজ্ঞানে এই দ্বিচারিতা করতে উদ্যত হবেন না।
দেবযানী ভট্টাচার্য