লক্ষ্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এনে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ। কিন্তু তা আইনে পরিণত করতে গেলে জনজাতি সমাজগুলিতে বড়সড় বিরোধের মুখে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ(আরএসএস)-এর। যার নেতিবাচক প্রভাব আসন্ন বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনে পড়তে পারে। ফলে এখন থেকেই এ বিষয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে বিজেপি নেতৃত্বকে মাঠে নামার পরামর্শ দিয়েছে সঙ্ঘ। এ দিকে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’বোর্ড (এআইএমপিএলবি) জানিয়েছে, তারা ওই বিধির বিরোধিতা করবে। শীঘ্রই আইন কমিশনে নিজেদের বক্তব্য জমা দেবে ল’বোর্ড।
রামমন্দির, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের পরে গৈরিক শিবিরের চোখ এখন অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দিকে। গত কাল যে ভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ওই বিধির পক্ষে সওয়াল করেছেন তাতে স্পষ্ট, লোকসভা নির্বাচনের আগে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। রাজনীতিকদের মতে, মূলত ওই আইন রূপায়িত হলে অস্তিত্ব হারাবে মুসলিম পার্সোনাল ল’বোর্ড। বিজেপি নেতৃত্ব ভাল করেই জানেন, সেই পরিস্থিতিতে পথে নামবে মুসলিম সংগঠনগুলি। তাদের পাশে দাঁড়াবে বিরোধীরা। সে ক্ষেত্রে হিন্দু ভোটের মেরুকরণের পথ সুগম হবে।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে দেশের সব ধর্মের মানুষ একই রকম পারিবারিক, বিবাহ ও উত্তরাধিকার আইন মানতে বাধ্য থাকবেন। এই আইন যেমন মুসলিমদের জীবনে তো বটেই, জনজাতিদের জীবনেও প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে জনজাতিদের বিবাহ, উত্তরাধিকার সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক প্রথা রয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই হিন্দু সমাজথেকে আলাদা। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে সেই সাংস্কৃতিক প্রথার কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন আরএসএস। সামনেই মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিধানসভা নির্বাচন। ওই দুই রাজ্যে ভোটদাতাদের একটা বড় অংশ জনজাতি। ফলে বিধি নিয়ে বিরোধীরা প্রচার চালিয়ে জনজাতি সমাজকে বিজেপি-বিরোধী করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা সঙ্ঘের। গত রবিবার মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের সঙ্গে আরএসএসের একটি বৈঠকে তাই এ বিষয়ে বিজেপি কর্মীরা যেন জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় গিয়ে প্রচার করেন, তার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। দেশের মোট ৪৭টি লোকসভা আসন জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছেন। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে যে সংশয় তৈরি হয়েছে তা দূর করার জন্য বিজেপি নেতৃত্বকে ওই লোকসভার আসনগুলিতে বিশেষ ভাবে প্রচার করতে বলেছে আরএসএস। ওই বৈঠকে আরএসএস ও বিজেপি নেতৃত্ব ছাড়াও সঙ্ঘের শাখা সংগঠন বিদ্যা ভারতী, সংস্কার ভারতী, বনবাসী কল্যাণ পরিষদের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
ঘরোয়া ভাবে বিজেপি নেতারা দাবি করেছেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে তা কোনও সংখ্যালঘু বা জনজাতি সমাজের ‘সংস্কৃতি’-কে কোনও ভাবেই প্রভাবিত করবে না। বিজেপি নেতৃত্ব বলছেন, তিনটি বিষয়কে ওই আইনের আওতায় নিয়ে আসার কথা ভাবা হয়েছে। বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ ও উত্তরাধিকার। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় শাসক শিবিরের যুক্তি, বিবাহের ক্ষেত্রে যেমন বহু বিবাহ বন্ধ করা, মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স বেঁধে দেওয়া, আইনি বিচ্ছেদের পরেই পরবর্তী বিবাহ করাকে নিশ্চিত করবে ওই আইন। তেমনি বিচ্ছেদের বিষয়টি যাতে একমাত্র আদালতের হস্তক্ষেপেই নিষ্পত্তি হয়, তা নিশ্চিত করার কথা ভাবা হয়েছে। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের উভয়ের সমান দাবি প্রতিষ্ঠিত করাই ওই বিধির লক্ষ্য। এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘দেশের সব মানুষের জন্য ওই বিধি আইনে রূপায়িত হলে একটি বিশেষ ধর্মের লোকেদের ওই নিয়ম মেনে চলতে হবে। সে জন্যই এ নিয়ে এত বিতর্ক।’’ কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, ওই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে জনজাতি সমাজ বিশেষ করে উত্তর-পূর্বের জনজাতি সমাজ, যারা মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী তাঁদের দৈনন্দিন জীবন প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ নিয়ে বিজেপি নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনও সমস্যা হলে তা মেটাতে দু’পক্ষ যেমন আদালতের শরণাপন্ন হয়ে থাকে, ঠিক সে ভাবেই আগামী দিনে আদালতের যাওয়ার সুযোগ থাকবে।
ল’বোর্ড গত কাল রাতেই জরুরি ভিত্তিতে বৈঠকে বসেছিল। ল’বোর্ডের সদস্য মৌলানা খালিদ রশিদ ফারাঙ্গি মাহালি বলেন, ‘‘আমাদের বিরোধিতার বিষয়গুলি নিয়ে আইন কমিশনের কাছে দরবার করব। ওই বিধি কেবল মুসলিমদেরই নয়, হিন্দু, শিখ, পার্সি, খ্রিস্টান, জৈন ও ইহুদিদের জীবনেও প্রভাব ফেলবে। ভারতের মতো দেশে প্রতি একশো কিলোমিটারে যেখানে ভাষা পরিবর্তিত হয়, সেখানে সব জনগোষ্ঠীর জন্য একটি মাত্র আইন দিয়ে কি বেঁধে ফেলা সম্ভব?’’
আজ আইন কমিশন জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত তাদের কাছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংক্রান্ত প্রায় ৮.৫ লক্ষ পরামর্শ জমা পড়েছে। দু’সপ্তাহ আগে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রসঙ্গে এক মাসের মধ্যে সব পক্ষের মতামত জানতে চেয়ে নির্দেশিকা জারি করেছিল কমিশন।