অখন্ড ভারত শব্দটি শুনলেই মানুষের হৃদয়ে জেগে উঠে উদ্দীপনা, কল্পনা এবং প্রশ্ন। ভারতবর্ষ আমাদের মাতৃভূমি ও পুণ্যভূমি। রাজনৈতিক মানচিত্রে তার ভৌগোলিক সীমারেখার ছবি আমরা দেখতে পাই । সে কি তাহলে খণ্ডিত এক দেশের ছবি মাত্র ? ভারতবর্ষ তাহলে কি আরো অনেক বড় ? ইতিহাসে পড়েছি যে দেশভাগ হয়েছিল। কিন্তু সেটা এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর নয়। উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, যেখানে ভারতের সভ্যতার উজ্জ্বলতা তার আলো ছড়িয়েছে, সনাতন ধর্ম তার সংস্কৃতির স্নিগ্ধ -শীতল ছায়া মেলেছে, সেই হলো ভারতবর্ষ। সেই হলো অখন্ড ভারত, যা শুধুমাত্র আধুনিক মানচিত্ৰ, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করা যায় না।
ভারতবর্ষ তো শুধুমাত্র আধুনিক কল্পনা নয়। ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা ও তাদের ভারতীয় ধামাধররা বারংবার তর্ক করে গেছে যে ইংরেজ শাসনের পূর্বে ভারতবর্ষ বলে কিছু ছিল না; আমাদের দেশের সংজ্ঞা এবং দেশাত্মবোধ ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে শিখেছি। তা, যে রাজনৈতিক ভাবে খণ্ডিত দেশে আমরা রয়েছি তা অবশ্যি ব্রিটিশদের ও তাদের অনুগামীদের দান। কিন্তু এটা যদি সত্যি হতো তাহলে ভারতবর্ষ নামটারই অস্তিত্ব থাকতো না পুরাকাল থেকে। India নাম তো এসেছে বিদেশিদের কাছ থেকে, গ্রিক আমল থেকেই। কিন্তু ভারত , ভারতবর্ষ নাম তো আমাদের নিজস্ব ইতিহাসে রয়েছে। নামটা ও স্বদেশের ধারণা আমরা আধুনিক কালে সৃষ্টি করি নি। আমরা যাকে সত্যযুগ বলি তাখন থেকেই এই নাম আছে।
ঋগবেদে ভারত জাতির উল্লেখ পাই। রামায়নে ভারতবর্ষ নাম পাই। সেখানে দেখি অযোধ্যার রাজপ্রাসাদে মিথিলা/বিদেহ রাজ্যের ( যা আধুনিক নেপালের অন্তর্গত ) কন্যা এলেন বধূ রূপে। তাঁরা বনবাসে উত্তর থেকে পশ্চিমে থেকে দক্ষিণে ঘুরে বেড়ালেন, যুদ্ধ হলো স্বর্ণালংকায়। রামেশ্বরম সেতু লোকেদের স্মৃতিতে মূল ভারতবর্ষ ভূখন্ড ও লংকাকে চিরকালের জন্য বেঁধে দিলো। আবার মহাভারত নামেরই অর্থ হলো ভারতের গান। সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে গান্ধারের ( আধুনিক আফগানিস্তান) রাজকুমারীর সঙ্গে হস্তিনাপুরের রাজার বিবাহ হয়েছে, পান্ডব সম্রাজ্ঞী কৃষ্ণা – দ্রৌপদী এসেছেন পাঞ্চাল দেশ থেকে, যা সুদূর হিমালয়ের পদতলে, ( আধুনিক জম্মু-কাশ্মীর সংলগ্ন ), অর্জুনের সঙ্গে বিবাহ করেন মণিপুরী ও নাগা রাজকন্যারা। মহাযুদ্ধের সময় দাক্ষিণাত্য থেকে এলেন তখনকার নৃপতিরা। তামিল নাড়ু ও কেরালার বহু দ্রৌপদী মন্দির ভারতবর্ষের সেই পুরাতন সম্পর্কের সাক্ষ্য বহন করছে। এইভাবে সমস্ত ভারতবর্ষ এক সংস্কৃতি , এক রাজনৈতিক চেতনায় বাঁধা ছিল। এইজন্যই বেদব্যাস লিখে গেছেন, “যা নাই ভারতে, তা নাই ভারতে” — অর্থাৎ সমস্ত ভারতবর্ষকে, তার, কাহিনী, তার ধৰ্ম, তার আচরণ, ব্যবহার, রীতি নীতি, শিক্ষা দীক্ষা আমরা এই ইতিহাস-কাব্যের মধ্যে পাচ্ছি। একতার যদি অনুভূতি না থাকত তাহলে এটা সম্ভব হতো না।
বিষ্ণুপুরান বলছে, “হিমগিরি উত্তরে, দক্ষিণে সাগর।“ এই হিমালয় পর্বতমেলা হাজার হাজার মাইল ধরে চলেছে নেপাল, ভুটান, তিব্বত, পাকিস্তান , আফগানিস্তান, বার্মা অতিক্রম করে। যে সমুদ্রে গিয়ে আধুনিক ভারতবর্ষের শেষ বিন্দু কন্যাকুমারিকা মিলেছে, সেই সমুদ্র ছুঁয়ে গেছে শ্রী লঙ্কা, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া কে। পুরানটি আমাদের এও জানাচ্ছে যে সব স্থানের মাঝে ভারতবর্ষ ধন্য , কারন তা হচ্ছে কর্মভূমি। এইখানেই মানুষ স্বর্গ লাভ করে, মোক্ষ লাভের অধিকারী হয়। অন্য দেশে তা হয় না, তাঁরা ভোগভূমি। সুতরাং ভারতবর্ষ বলে পৃথক এক দেশ যার বিশেষ সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা ও কর্মকান্ড রয়েছে সমন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা এখানে ব্যক্ত হয়েছ। তর্কের খাতিরে আমরা যদি এও ধরে নি যে বিষ্ণুপুরান রচিত হয়েছে মাত্র দুই হাজার বছর আগে তাহলেও তো সেই ধারণা ব্রিটিশদের আসার আগে। তাহলে ভারতবর্ষ বলে এক পুণ্যভূমি, এক সংস্কৃতিতে বাঁধা ভূমি ছিল অনাদি অতীত থেকে।
এবং এই ভারত আজকের খণ্ডিত ভারত নয় , ব্রিটিশ ও নেহেরু পরিববারের কৃত্রিম ভারত নয়। এই হচ্ছে অখন্ড ভারত যা আধুনিক বিভিন্ন ভৌগোলিক খন্ডকে সনাতন ধর্মের মেলবন্ধনে জুড়ে দিয়েছে সভ্যতার প্রথম সূর্যোদয় থেকে ।
পাপিয়া মিত্র (Papia Mitra)