ত্রিপুরার প্রতি মুজিবকন্যার অনুভূতি ন্যায়সঙ্গত

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গত পাঁচ দশকের মধ্যে এখন সর্বোচ্চ মাত্রা লাভ করেছে। দুদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। তবে একটা বিষয় দুদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে এসেছে যে, সম্পর্কের ক্ষেত্রে এতদিন মূল ‘নজর ছিল পশ্চিমবঙ্গে। দু’দেশের মধ্যে প্রথম বাস সার্ভিস চালু হয়েছিল ঢাকা-কলকাতার মধ্যে। এখন সরাসরি ট্রেন চলছে। দুদেশের মানুষের যাতায়াতও পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত পথে সবচেয়ে বেশি। গত বছরও পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতীতে গিয়ে বাংলাদেশ ভবন’-এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদী। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান প্রদানও ঐতিহ্যগতভাবে বেশি। তবে তিস্তা নিয়ে টানাপােড়েন আছে। বলা হচ্ছে আলােচনা চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে দিল্লি ও ঢাকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গের বদলে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের ‘নজর’ এখন ধীরে ধীরে ত্রিপুরার দিকে সরে যাচ্ছে। তাদের এ বক্তব্যের পক্ষে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের দেওয়া দুটি বক্তব্যের কথা বলছেন।
দিল্লি সফরশেষে ঢাকা ফিরে গত ৯ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ত্রিপুরা যদি কিছু চায় তাহলে তা আমাদের দিতেই হবে। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশের মানুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের বড় ঘাঁটি ছিল ত্রিপুরা, তারা ছিল আমাদের বড় শক্তি। ভারতকে ফেনী নদীর জল দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশে বিরােধীদের সমালােচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন। জল দেওয়ার পাশাপাশি কথা উঠেছে ত্রিপুরায় এলপিজি রপ্তানি এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার নিয়েও। শেখ হাসিনার এবারের দিল্লি সফরে লাভবান হয়েছে ত্রিপুরা।
গত ৫ অক্টোবর বিপ্লব দেব টুইট করেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উভয় দেশই উন্নতির শিখরে পৌঁছুবে। আপনাদের মধ্যে হওয়া আজকের বৈঠকের ফলে সর্বাধিক সুফল পাবে ত্রিপুরা। আমি ৩৭ লাখ ত্রিপুরাবাসীর পক্ষ থেকে আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দুই মন্তব্য থেকেই পরিষ্কার শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফর থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের সম্পর্ক আলাদা উচ্চতায় পৌঁছেছে। এলপিজি রপ্তানি, ফেনী নদীর জল কিংবা চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের এসওপি-সহ দুই দেশের মধ্যে যেসব সমঝােতা হয়েছে, হাসিনার এবারের দিল্লি সফরে ভারতের রাজ্যগুলাের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুফল পাচ্ছে। ত্রিপুরাই। শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক দিল্লি সফরের সময় ঘটা বেশ কিছু ঘটনার কথাও বলছেন বিশ্লেষকরা।
এক, শেখ হাসিনা যেদিন দিল্লিতে পা রাখেন (৩ অক্টোবর), সেদিন রাতেই তার সঙ্গে দেখা করেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব। দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের দেওয়া নৈশভােজে দুজনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘ আলােচনা হয়। অথচ শেখ হাসিনার এবারের সফরে আরেক সীমান্তবর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিল্লিতে দেখাই যায়নি। দুই, শেখ হাসিনা ও বিপ্লব দেবের মধ্যে আলােচনায় ঢাকা-আগরতলা সরাসরি বিমান চলাচল নিয়ে পর্যন্ত কথাবার্তা হয়েছে। যদিও দুইশহরের মধ্যে দূরত্ব মাত্র ১৩০ কিলােমিটার। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এখন সপ্তাহে ৬১টি ফ্লাইট চলে। আগামী বছরের মধ্যে তা দ্বিগুণ করার কথা বলা হয়েছে যৌথ বিবৃতিতে। নতুন ফ্লাইটগুলাের বেশিরভাগই চলবে আগরতলা-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন শহরের সঙ্গে। তিন, তিস্তা চুক্তির জটিলতা না কাটলেও বাংলাদেশ ফেনী নদী থেকে ত্রিপুরার সাব্রুম শহরকে পানীয় জল দিতে রাজি হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এর মাধ্যমে ঢাকা পশ্চিমবঙ্গ সরকারকেও পরিষ্কার বার্তা দিতে চেয়েছে। চার, তিস্তা চুক্তি যখন প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাধাতেই আটকে আছে, তখন ফেনীসহ আরও ৭টি অভিন্ন নদীর জলসম্পদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে ফ্রেমওয়ার্ক তৈরিতে দুই দেশই একমত হয়েছে। মনু, মুহুরি, খােয়াই, গােমতীর মতাে নদীগুলাের অধিকাংশই বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। পাঁচ, বাংলাদেশ থেকে যে বাল্ব এলপিজি আমদানি করে ত্রিপুরার বিশালগড়ে সিলিন্ডারজাত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটাও হয়েছে ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে রান্নার গ্যাস জোগানের কথা মাথায় রেখে। ছয়, চট্টগ্রাম বন্দর ভারতের ব্যবহার করার ক্ষেত্রে যে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়াের নির্ধারিত হয়েছে, তার সফলও সবচেয়ে বেশি পাবে ত্রিপুরা ও মিজোরাম। এখানেও ত্রিপুরাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। অথচ পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া বন্দর বাংলাদেশকে ব্যবহার করার প্রস্তাব নিয়ে তেমন কোনও অগ্রগতি হয়নি।
দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের প্রধান অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলেন, সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের ফ্রেমওয়ার্কে ত্রিপুরাই যেন এখন নতুন পশ্চিমবঙ্গ হিসেবে উঠে আসছে। তিনি বলেন, বন্ধুপ্রতিম একটা দেশের সঙ্গে ভারতের একটি সীমান্তবর্তী অঙ্গরাজ্যের সম্পর্ক আসলে ঠিক কেমন হওয়া উচিত ত্রিপুরাকেই যেন তার রােল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছে। এবং পশ্চিমবঙ্গকে দেখিয়ে নীরবে বােঝাতে চাওয়া হচ্ছে, সম্পর্কটা কেমন হওয়া উচিত।
প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক নীরজা চৌধুরী এর সঙ্গেই যােগ করছেন, বছর দেড়েক আগে ত্রিপুরায় প্রথমবারের মতাে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সচেতনভাবে এই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। অসমেও বিজেপির সরকার আছে। তবে এনআরসি-র কারণে যেহেতু অসম সম্পর্কে বাংলাদেশের কিছুটা অস্বস্তি আছে, তাই এখানে সচেতনভাবে বেছে নেওয়া হয়েছে ত্রিপুরাকেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থানের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি আরও বলেন, উল্টোদিকে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের কাছ থেকে কোনও সহযােগিতা তারা পাচ্ছে না, এর মাধ্যমে সেটাও বােঝাতে পারছে। ২০২১ সালে। পশ্চিমবঙ্গে যদি বিজেপি ক্ষমতায় আসে তখন হয়তাে ছবিটা পাল্টাতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশে দুদেশের সম্পর্ক নিয়ে যারা আলােচনা করেন তাদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তেবলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্রিপুরার সাব্রুমের মানুষের জন্যে ফেনী নদীর জল দিয়ে এটাই বােঝাতে চাইছেন, তিস্তার জল না পেলেও বাংলাদেশের আন্তরিকতার অভাব নেই। তিনি ৯ অক্টোবর সাংবাদিক সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেনও, সাব্রুমের মানুষের পানীয় জলের কষ্ট আছে, আমরা বুঝি। তাই জল দিতে আপত্তি করিনি। এই সাব্রুম তাে। একাত্তরে বাংলাদেশের শরণার্থীদের প্রবল চাপ সামলেছিল। মুক্তিযােদ্ধাদেরও বড় ঘাঁটি ছিল সাব্রুমে।
বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা আরও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ত্রিপুরার স্থান অবিস্মরণীয়। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ নামে কথিত মামলায় বাংলাদেশের জাতির জনককে গ্রেফতার করে। ফাঁসি দেওয়ার ষড়যন্ত্র এঁটেছিল পাকিস্তানি সামরিক সরকার, ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনে তা ভেস্তে যায়। মামলা প্রত্যাহার করে মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। তবে এটা ঠিক, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে যখন ভাবতে শুরু করলেন, তিনি তখনই স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছান ভারতের সাহায্য ছাড়া। এগােনাে সম্ভব নয়। তিনি আগরতলায় গিয়ে ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে গােপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। স্বাভাবিক ভাবে মুজিবকন্যার ত্রিপুরার প্রতি একটা আলাদা অনুভূতি থাকবে বলাই বাহুল্য। কিছুদিন আগে ত্রিপুরায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ভারী যন্ত্রপাতি নদীপথে আশুগঞ্জ হয়ে নিয়ে যাওয়ার কথাও উল্লেখ করতে হয়।
ঢাকা থেকে বিশেষ প্রতিনিধি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.