উঁচু করে পরা কমলা রঙের সুতির শাড়ি। পায়ে চটি। হাতে প্লাস্টিকের একগোছা কমলা রঙের চুরি। এই বেশেই দেশের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চটিতে উঠেছিলেন তিনি। দু’হাতে গ্রহণ করেছেন দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মান, পদ্মশ্রী। তিন দিন আগেই ওড়িশা থেকে দিল্লি গিয়ে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের হাত থেকে সে সম্মান গ্রহণ করেছেন ‘চাষার মেয়ে’ কমলা পূজারি।

হ্যাঁ, এই নামেই ছোটো থেকে সকলে তাঁকে ডাকছে বলে শুনেছেন, কোরাপুটের স্থানীয় এক জনজাতির মেয়ে কমলা। কৃষিকাজ অধ্যুষিত এই জনজাতির প্রতিনিধি হয়ে, তিনি রীতিমতো বিপ্লব এনেছেন কৃষিতে। তাঁর ভাণ্ডারে বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির শস্যের বীজের সংরক্ষণ দেখে রীতিমতো বিস্মিত কৃষিবিজ্ঞানীরাও।

কোরাপুটের কমলা পূজারির বয়স ৭০ বছর। স্থানীয় মাটিতে উৎপন্ন কালো তিল, কালো জিরে, ধনে, হলুদ এবং ১০০টির-ও বেশি ধানের প্রজাতির বীজ সংরক্ষণ করে অর্গানিক ফার্মিংয়ের দুনিয়ায় রীতিমতো কৃতিত্বের ছাপ রেখেছেন কমলা। হারিয়ে যেতে বসা ফসলের বীজ সংরক্ষণ করাই যেন নেশা হয়ে উঠেছে বৃদ্ধা কমলার। শুধু রোজগারের তাড়নায় নয়, ফসল বাঁচানোর তাড়নাও আজ তাঁর কৃষিকাজের মুখ্যতম উপজীব্য।

কমলার পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, খুব ছোটো থেকেই বাড়ির লোকজনের সঙ্গে খেতে চাষ করতে যেতেন তিনি। নানা রকম প্রশ্ন করে করে মাথা খারাপ করে দিতেন বড়দের। চাষবাসের চেয়েও, নানা রকমের ফসল, তার ধরন, তার সংরক্ষণ নিয়ে কমলার কৌতূহল ছিল কিশোর বয়স থেকেই।

পরে তিনি ওড়িশারই এমএস স্বামীনাথন রিসার্চ ফাউন্ডেশন থেকে ফার্মিং নিয়ে কিছু বেসিক কোর্স করেন। ট্রেনিং নেন ফসলের বীজ সংরক্ষণের। এর পরেই সেই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেন কমলা। মানুষকে জড়ো করেন, বোঝান, হারিয়ে যেতে বসা শস্যগুলো বাঁচানো জরুরি। এ জন্য বুঝেশুনে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম-প্রথম কেউই শোনেননি ‘চাষার মেয়ে’ কমলার কথা।

বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরতে শুরু করেন কমলা। রীতিমতো দোরে দোরে গিয়ে মানুষকে বোঝান তাঁর বক্তব্য। প্রথম সাফল্য পান নবরংপুর জেলার পত্রপুট গ্রামে। কমলার কথা শুনে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করেন কৃষকেরা। এবং বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেন, যে ফসলের উৎপাদন ক্রমেই কমে আসছিল, সেই ফসলই ফের ভরিয়ে দিয়েছে খেত। পত্রপুটের স্থানীয় কৃষিজীবী মহিলাদের নিয়ে একটি সিড-ব্যাঙ্ক তৈরি করেন কমলা। সাহায্য নেন স্বামীনাথন ফাউন্ডেশন থেকে। তাঁর এই প্রচেষ্টাকে বাহবা জানায় ফাউন্ডেশন।

এই কাজের জেরেই ২০০২ সালে জোহানেসবার্গে অর্গানিক ফার্মিং নিয়ে আয়োজিত একটি ওয়ার্কশপে যোগ দেওয়ারও সুযোগ পান কমলা। সারা দুনিয়ার তাবড় কৃষিবিজ্ঞানীদের সামনে সমাদৃত হয় কমলার প্রস্তাব ও প্রচেষ্টা। এর পরে ভুবনেশ্বরের ‘ওড়িশা ইউনিভার্সিটি অফ এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি’-র সঙ্গে জোড়ে কমলার নাম। ইকুয়েটর অফ ইনিশিয়েটিভ অ্যাওয়ার্ডও পান কমলা। ওড়িশা সরকার তাঁকে সংবর্ধনা জানায় সেরা মহিলা কৃষিজীবী হিসেব।

এ সবের মধ্যেই কমলার কাজ এগিয়ে চলে নিজের গতিতে। সংরক্ষিত হয় বহু বিলুপ্তপ্রায় শস্য। নিঃশব্দেই প্রায় বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেন তিনি। গত বছরের শেষের দিকে, অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল কমলা পূজারিকে। তখনই আসে খবরটা। পদ্মশ্রী পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। “আমি ওই সম্মানের কথা বিশেষ জানতাম না, আমি কেন পাচ্ছি, সেটাও প্রথমে বুঝিনি।”– বলেন কমলা পূজারি।

তাতে অবশ্য কিছু অসুবিধা হয়নি। ওড়িশা স্টেট প্ল্যানিং বোর্ডে তাঁর নাম উঠেছে প্রথম শস্যবীজ সংরক্ষণকারী আদিবাসী মহিলা হিসেবে। গত বছর মার্চেই ওড়িশার কৃষিক্ষেত্রের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পাঁচ সদস্যের একটি দলের সদস্য করা হয়েছে কমলা পূজারিকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.