আজ এই মধ্যপঞ্চাশে এক প্রাক মহালয়ার রাত্রির প্রথম যামে বসে শুধু স্মৃতিচারণ সম্বল

আজ একটা মন কেমন করা রাত।

ছোটোবেলায় মায়ের পাশে শুয়ে গুটিশুটি মেরে ভাইকে কোনমতে খামচে টামচে সরিয়ে দিতাম, রোজকার ব্যাপার। একপ্রস্থ বালিশযুদ্ধ, হাতাহাতির শেষ হতো বাবার চাঁটি বা গাট্টা ভাগ করে খেয়ে।
শুধু আজকের রাতটা বাদ।

কাল বাবা তর্পণপূজো করবে, ভোররাতে বাড়িশুদ্ধু লোক রেডিওতে পুজোর মন্তর শুনবে, আজ রাতে বেচাল হলে রক্ষে থাকবে না, রাত ন’ টা বাজতে না বাজতেই বিছানায়।

শেষরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেছে, তড়াক করে উঠে বসে ঘুমচোখে আধো ঘোরের মধ্যে গোটা পাড়ার ঘরে ঘরে বেজে চলা মন্দ্রধ্বনি শুনতে পেতাম, খানিক শুনতে না শুনতে ফের কখন তলিয়ে যেতাম গভীর ঘুমে, উঠতাম যখন , চারিদিকে রোদ ঝলমলে, বাবা পাশের ঘরে তর্পণে বসেছে, দ্রুতলয়ে সামবেদীয় রীতিতে প্রারম্ভিক আবাহন ,শুদ্ধিকরণ ইত্যাদি পাঠ শুরু হয়েছে।

সময় পাল্টায়। মিশনে ক্লাস এইটে উঠে অনেক কান্নাকাটি করে ফুলপ্যান্টে প্রমোশন পেয়েছি, সেই নাকের তলায় গোঁফের রেখা আর গালে কয়েকটা ব্রণ, গলায় খসখসে ভাঙ্গা স্বর, মনে সারাক্ষণ লুকিয়ে দেখে আসা শোলে, দীওয়ার আর মুকদ্দর কা সিকন্দর। মহালয়ার আগের দিনটাও যে বদলাবে, তাতে আর আশ্চর্য কি ?

পাড়ায় পাড়ায় তখন মহালয়ার আগের দিন রাত জেগে পিকনিকের ধুম। বড়োদের একটা পিকনিক হয়েই আসছে অনেক বছর ধরে, আমাদের ও তো বড়ত্বে প্রমোশনের সময় এসে গেলো, এবার তো আমাদের রাতভোর আমোদের আয়োজন না করলেই নয়।

ক্লাবঘর বড়োদের দখলে, সেখানে চান্স নৈব নৈব চ। একালে যেমনটি বারো থেকে বাষট্টি একসাথে গেলাস ঠোকাঠুকি করে চিয়ার্স করছে, সেসময় বিড়ি খেতে দেখলেও বড়োরা পিটিয়ে ছাল তুলে নিত।

কাজেই একটু আড়াল করে একটি তৈরী হতে থাকা বাড়ির ভেতরে প্ল্যান করা হল। একটি পেল্লায় সাউন্ড বক্স ভাড়া করা হল। উৎকট হিন্দি লারেলাপ্পা গানের ক্যাসেট বেছে বেছে নিতে গিয়ে দেখি একটি ” মহিষাসুরমর্দিনী” র ক্যাসেট । একটা কথা মনে আসতে ওটাও নিয়ে নিলাম।

তখন মুরগির মাংসের চল কারো বাড়িতেই ছিলো না, প্রশ্নই আসে না। এখন আর ভালো মনে নেই, মাংস তখন কুড়ি বাইশ টাকা কেজি। যা বাজেট , বড়জোর দেড় কেজি হতে পারে, খাবার মুখ জনা তেইশ। দু পিস করে হওয়াও অসম্ভব।

আমার হঠাৎ মনে পড়ল, শুনেছি খড়দা পুরনো বাজারে খুব কম দামে মাংস পাওয়া যায়। ব্যস ঘন্টাখানেক হাঁটতে হাঁটতে সোজা সেখানে। গিয়ে তো আত্মহারা। মাত্র দশটাকা কেজি ! তিন কেজি নিলাম। চাইতে চর্বি, মেটে বেশি বেশি করে দিয়ে দিল।

রাত দশটা থেকেই বক্স বাজিয়ে নাচাগানা চালু। টিফিন মুড়ি চানাচুর পেঁয়াজ কুচি। রাম্বা হো হো গোছের গান সব। বেজায় ভলিউমে কানে তালা লেগেছে আশপাশের বাড়িতে সবার।

সেবছরই পাড়ায় প্রথম দূর্গাপূজা শুরু হবে, পাড়াময় উৎসবের মরশুম, আবালবৃদ্ধবনিতার মনে মনে পুজোর ছোঁয়াচ লেগে গিয়েছে মাসখানেক ধরে, তাই সবাই এই লঙ্কাকান্ড মার্কা আনন্দকে একটু প্রশ্রয়ের নজরেই দেখেছিলেন, বিশেষ একটা আপত্তি টাপত্তি আর কেউই করেন নি।

এদিকে রান্নার আয়োজনে কয়েকজন শেফ খুব মনোযোগী, মশলা বাটা, ইত্যাদি চলছে, চাল ধুয়ে রাখা হচ্ছে, যা হয় টয় আরকি ।

সেবছর মনের আনাচে কানাচে উঁকি দেয় মেমসাব, রাখীর মায়াবী চাউনি। ক্লাবের পাশের বাড়ির দোতলায় থাকতো কেউ একজন ( নাম বলা অসম্ভব, এখন বিয়ে টিয়ে হয়ে গেছে, আমার ফেসবুকেই আছে, লেখায় নিজের নাম দেখলে ঝেঁটিয়ে বিষ ঝেড়ে দেবে ) , তার বন্ধ জানলার দিকে আমার চোখ ফিরে ফিরে আসছে, গান বাজছে, ” ও সাথী রে, তেরে বিনা ভি ক্যা জিনা ….”।

সে খুব পাগল করে দেওয়া কষ্টের রাত। সে যা হোক, আনন্দ আনলিমিটেড!

রাত আড়াইটে বাজল। মাংস নামেনি। সবাই মিলে চেপে ধরা হলো রান্নার দায়িত্বে থাকা হতভাগাকে, সে কাঁদো কাঁদো হয়ে নিবেদন করল, প্রায় সোয়া তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে, কড়াইয়ে আলু গলে পাঁক, মাংস তবু সেদ্ধ হবার নামটি নেই ।

গোলযোগ শুনে বড়োরা দু তিনজন ক্লাবঘর থেকে দৌড়ে এলো, সমস্তটা শুনে হো হো করে বাজখাঁই অট্টহাসি, খড়দা পুরনো বাজারের মাংস ! ওখানে সস্তায় ছাগলের মাংস বেচে, এ জন্মে সেদ্ধ হবার নয়!

এবার সবাই আমাকে চেপে ধরলো, বেগতিক দেখে আমি কড়াই থেকে দু টুকরো মাংস তুলে নিয়ে ফুঁ দিয়ে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বললাম, মোটামুটি হয়ে গেছে, ভাত দিয়ে দে, বসে পড়ি।

সে রাত ভোলবার নয়। বাড়ির বাইরে জীবনের প্রথম রাতজাগা , সে চুইংগামলাঞ্ছিত আধসেদ্ধ মাংস, সাংঘাতিক ঝাল ঝোল ! নাক মুখ চোখ দিয়ে সমানে জল গড়িয়ে পড়ছে, কান ভোঁ ভোঁ করছে, ঘেমে নেয়ে একশা সবাই। তবু চোখে চোখে কথা, হো হো করে হেসে ওঠা, আঙ্গুল চেটে চেটে তৃপ্তির ভান করা।

একসময় খাওয়া শেষ হল। আশ্চর্য, একমুঠো ভাত বা একটুকরো মাংস ও পড়ে নেই।

হাত টাত ধুয়ে সতরঞ্চিতে বসতে না বসতেই সেই কথাটা মনে পড়ে গেল।

মহিষাসুরমর্দিনীর ক্যাসেটটা ডেকে ঢুকিয়ে দিয়ে সুইচ টিপে দিলাম। তখন চারটে বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি ।

ফুল ভলিউমে চতুর্দিক প্রকম্পিত করে বাজতে শুরু করলো, ” আশ্বিনের শারদ প্রাতে ….”

পটাপট আশেপাশের বাড়িতে আলো জ্বলে উঠলো।

তারপরেই ঘটলো সেই আশ্চর্য ঘটনা। অনেকেই ঘরে যে যার রেডিওর সুইচ প্রাণপণে আকুল হয়ে ঘোরাচ্ছেন, ভাবছেন ব্যাপারটা কি হলো, রেডিওটা বোধহয় গণ্ডগোল করছে !

ঘড়িটার দিকে আর কেই বা দেখে।

খানিক বাদে আদ্ধেক পাড়ার লোক রাস্তায়। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চাঁদা করে ধোলাই দেবার জন্য। আমরা কাঁচুমাচু।

হঠাৎ আকাশ ফাটিয়ে হাসতে শুরু করলেন মজুমদার আঙ্কেল। রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। হাসতে হাসতে বললেন,” আরে ওরা তো দারুণ একটা কাজ করেছে। অকালবোধনের পুজোয় মহিষাসুরমর্দিনীর অকালবোধনটা ওরাই করে দিয়েছে। “

সবার মুখে তখন হাসির বাঁধ ভেঙেছে..।

আজ এই মধ্যপঞ্চাশে এক প্রাক মহালয়ার রাত্রির প্রথম যামে বসে শুধু স্মৃতিচারণ সম্বল।

কাল ঊষালগ্নে যথারীতি মহিষাসুরমর্দিনী বাজবে , কিন্তু সেই সুরে আলোর বেণু এই প্রৌঢ়কে আর দোলা দেবে না।

সুপ্রিয় চ্যাটার্জি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.