তাঁর পিতা শেঠ ছজুমল ছিলেন সে সময়ের এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তাঁর ব্যবসায়ের মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা। তাই নীরার পড়াশোনা শুরু হয়েছিল কলকাতায়। নীরা হিন্দি, ইংরেজি, বাংলার পাশাপাশি আরও অনেক ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক, সাহসী ও প্রবল আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্না একজন মহিলা।
নীরা আর্য্য ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টের সৈনিক।
ইংরেজ সেনাবাহিনীর পদস্থ অফিসার শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে হত্যার জন্য গুলি চালিয়েছিলেন।
সৌভাগ্যবশত সেই গুলি নেতাজির গাড়ীর চালককে বিদ্ধ করে। সেই মুহূর্তে সেখানেই উপস্থিত ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের ’রানি ঝাঁসি রেজিমেন্ট’-এর সদস্যা নীরা আর্য। জয়রঞ্জনকে তিনি দ্বিতীয় সুযোগ দেননি। চোখের পলকে শ্রীকান্তর পেটে বেয়নেট চালিয়ে তাঁকে হত্যা করেন। শুধু এটুকুই তাঁকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এখানে একটা অভাবনীয় চমক আছে। যাঁকে তিনি সেদিন হত্যা করেছিলেন, সেই শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন ছিলেন নীরা আর্যের স্বামী। হ্যাঁ। নেতাজি এবং স্বদেশের প্রতি এতটাই নিষ্ঠ ছিলেন তিনি যে ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বনকারী নিজের স্বামীকে হত্যা করতেও দ্বিধা বোধ করেননি। অভিভূত নেতাজি নীরাকে অভিহিত করেছিলেন ‘নাগিনী’ নামে। আজাদ হিন্দ ফৌজের বীর সেনানী নীরা আজও অমর হয়ে আছেন তাঁর এই অসামান্য কীর্তির জন্য।
তিনি ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম মহিলা গুপ্তচর, আজাদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসি রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ছিলেন লক্ষী সেহেগল। দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভুত মহিলা স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে ১৯৪৩ সালে গড়ে উঠেছিল এই রেজিমেন্ট। ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল ব্যাংকক, রেঙ্গুন ও সিঙ্গাপুর।
রেজিমেন্টের সবাইকে শিখতে হত মার্শাল আর্ট, মাইন পাতা, গ্রেনেড ছোড়া, আগ্নেয়াস্ত্র ও বেয়নেট চালানো। আজাদ হিন্দ ফৌজের ছিল শক্তিশালী গোয়েন্দা বিভাগ, যার সূচনা হয়েছিল নীরা আর্য্যকে দিয়েই, তিনিই ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম মহিলা গোয়েন্দা। তিনি ছাড়া ছিলেন সরস্বতী রাজমণি , মান্যবতী আর্য্য, দুর্গা মল্ল গোর্খা আরও অনেক বীরাঙ্গনা। তারা বিভিন্ন কাজের অছিলায় ব্রিটিশ অফিসারদের বাড়ি ও সেনাশিবিরে প্রবেশ করতেন তথ্য সংগ্রহের জন্য, তারপর তা নেতাজীর কাছে পাঠাতেন। এই কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়লে প্রথমে নথিগুলি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া ও পরে পিস্তল চালিয়ে আত্মহত্যা করতে হবে, এই নিয়ম তারা কঠোর ভাবে মেনে চলতেন।
একদিন এইকাজ করতে গিয়ে সামান্য অসতর্ক হওয়ায় ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ে যান দুর্গা মল্ল গোর্খা, আত্মহত্যা করার সুযোগটুকু পাননি। তার ওপর অমানুষিক অত্যাচার করে ব্রিটিশরা নেতাজীর সন্ধান জানতে চায়। এদিকে নীরা ও স্বরস্বতী দুজনে বৃহন্নলা সেজে ব্রিটিশ শিবিরে ঢুকে পড়ে নাচ ও গান করে সাহেবদের মনোরঞ্জন করে ও সুযোগ বুঝে তাদের সুরার পাত্রে আফিম মিশিয়ে দেন। অফিসাররা নেশায় আচ্ছন্ন হলে দুর্গাকে শিকল মুক্ত করে সেনাছাউনির বাইরে আসে, এক সেনা তাদের দেখে ফেলে ও গুলি চালায়, গুলি লাগে সরস্বতীর পায়ে, রক্তাক্ত সরস্বতীকে নিয়ে নীরা ও দুর্গা হারিয়ে যায় বিপদসঙ্কুল গভীর বনে। তারা জানতো যে কিছুক্ষণ পরেই সাহেবরা চিরুনি তল্লাশি করবে জঙ্গলে, তাই তারা একটু উঁচু গাছে উঠে পড়ে।
কিছু পরেই কানে ভেসে আসছিল ব্রিটিশদের জঙ্গল তোলপাড় করার আওয়াজ, কিন্তু গুলি বিদ্ধ এক নারী তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে উঁচু গাছে পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে, সেটা কল্পনাও করতে পারেননি, ব্রিটিশরা, তাই কিছু পরেই তারা হতাশ হয়ে ফিরে যায়। গাছের ওপর নীরাদের কেটেছিল তিনদিন, এই সময় তারা না খেয়ে ছিলেন। পালা করে ঘুমিয়ে নিতেন।
এদিকে নীরা ও দুর্গার চিন্তা বাড়তে লাগলো সরস্বতী কে নিয়ে , তার পায়ের ক্ষত ক্রমশ বিষিয়ে যাচ্ছিল, তাই তারা গাছ থেকে নেমে পড়েন, গভীর জঙ্গলে পথ হারানোর আশঙ্কা থাকে, কিন্তু এদের তিনজনের নেওয়া ছিল অরণ্যযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। কিছুদিন পর তারা আজাদ হিন্দ বাহিনীর গোপন ডেরায় পৌঁছন, এই কদিন বুনফল ও ঝর্ণার জল ছাড়া তাদের কিছুই জুটেনি, ক্যাম্পে শুরু হল সরস্বতীর চিকিৎসা , ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। নেতাজী এই কাজে ভীষণ খুশি হয়ে তাদের পুরস্কৃত করেছিলেন, সরস্বতী রাজমণি হয়েছিলেন ঝাঁসি বাহিনীর “লেফটেন্যান্ট” ও নীরা আর্য্য “ক্যাপ্টেন”।
দক্ষিণ এশিয়ার অক্ষশক্তির পরাজয়ের পর ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ। ধরা পড়েছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের হাজার হাজার সেনানী। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে লালকেল্লায় তাদের বিচার শুরু হয়, বেশির ভাগ সেনানী ছাড়া পেলেও নীরাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়, জাহাজে করে পাঠানো হয় আন্দামানের সেলুলার জেলে। সেখানে তার ওপর যে অমানুষিক অত্যাচার হয়েছিল তা সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
আন্দামানে নীরাকে রাখা হয়েছিল একটি ছোট কুঠরিতে, সেখানে বাকি বন্দিরা ছিল মুক্ত, কিন্তু নীরাকে বন্য জন্তুর মত প্রথমদিন বেঁধে রাখা হয়েছিল। গলায় বাঁধা ছিল চেন ও হাতে-পায়ে ছিল শেকল লাগানো বেড়ি। নীরাকে কিছু খেতে দেওয়া হয়নি প্রথম দিন। শোয়ার জন্য মাদুর কিংবা কম্বল কিছুই দেওয়া হয়নি প্রথমে। কুঠরির কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলেন পরিশ্রান্ত নীরা। মাঝরাতে এক প্রহরী কুঠরিতে ঢুকে গায়ের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছিল দুটো কম্বল। সকাল বেলায় প্রথম জুটেছিল খাবার, খেতে দেওয়া হয়েছিল ফুটন্ত খিচুড়ি।
এরপর একজন কামারকে সঙ্গে নিয়ে কুঠরির মধ্যে ঢুকে ছিলেন ব্রিটিশ জেলার। কামার কাটতে শুরু করেছিল হাতের বেড়ি, হাতের চামড়া কেটে উঠে এসেছিল। নীরা বুঝতে পারছিলেন ইচ্ছে করেই তাঁকে আঘাত করছে বিদেশী প্রভুভক্ত ভারতীয় কামার। তবুও অসহ্য যন্ত্রনা সহ্য করছিলেন দাঁতে দাঁত চিপে, কিন্তু যখন পায়ের বেড়ি কাটতে যায় তখন ইচ্ছে করেই হাতুড়ি দিয়ে পায়ে আঘাত করছিল, চিৎকার করে উঠেছিলেন নীরা। “তুমি কি অন্ধ, পায়ে হাতুড়ি মারছো কেন? কামার নীরার বুকের দিকে তাকিয়ে বলেছিল “দরকার হলে তোমার বুকেও মারতে পারি, তুমি কিছুই করতে পারবে না”। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নীরা বলেছিল, ” আমি জানি আমি তোমাদের ক্রীতদাস, তোমরা যা খুশি করতে পারো আমাকে নিয়ে”। এরপর একদলা থুতু কামারের মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলেন “মেয়েদের সম্মান করতে শেখো”।
ঘটনাটি উপভোগ করছিলেন জেলার। নীরার সামনে এসে বললেন–“নেতাজী কোথায় বলে দাও, আমরা তোমাকে ছেড়ে দেব”। ভাবলেশহীন মুখে নীরা বলেছিলেন–” সারা বিশ্ব জানে যে নেতাজী বিমান দুঘটনার মারা গেছেন” উত্তেজিত জেলার বলেছিল–“তুমি মিথ্যে কথা বলছো, সুভাষ বোস এখন জীবিত”। মাথা উঁচু করে নীরা সগর্বে বলেছিলেন–“হ্যাঁ নেতাজী বেঁচে আছেন আমার বুকে”। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে জেলার বলেছিলেন—” সুভাষ বোস যদি তোমার বুকে থাকে, তাহলে সেখান থেকে আমরা তাকে বের করে আনবো”। তার পর জেলার নীরাকে অমানুষিকভাবে মারতে শুরু করে ও তার জামা ছিঁড়ে দেয়, দুহাতে নীরার দুই স্তন মুচড়ে ধরে ইশারা করেছিলেন কামারের দিকে। কামার তার বাক্স থেকে বের করেছিলেন “ব্রেস্ট রিপার”।
নারীদের ওপর অত্যাচার করার মধ্যযুগীয় যন্ত্র। দেখতে অনেকটা সাঁড়াশির মতন, আগুনে গরম করে নারীদের স্তন উপড়ে নেওয়া হত। কামার “ব্রেস্ট রিপার” যন্ত্রটিকে নীরার ডান স্তনে বসিয়ে প্রবল চাপ দিতে শুরু করলো, নীরার ঘাড় দুইহাতে শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন জেলার। নীরার আর্ত চিৎকার বোধহয় শুনতে পেয়েছিল সেলুলার জেলে বন্দি থাকা সকল কয়েদি। বেস্ট রিপার দিয়ে কামার উপড়ে নিয়েছিল নীরার ডান স্তন। রক্তাক্ত নীরা জ্ঞান হারাবার আগে কানের কাছে শুনতে পেয়েছিল জেলারের কন্ঠ “আবার মুখে মুখে তর্ক করলে অন্য বেলুনটিও উপড়ে নেওয়া হবে, ধন্যবাদ দাও রানী ভিক্টরিয়াকে, যে ব্রেস্ট রিপারটি আগুনে গরম করা ছিল না”।
এরপরেও আরও অনেক পাশবিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে নীরাকে। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। তবুও মনে মনে স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন ভারতে সূর্যোদয় দেখবেন। এই মহান ত্যাগের সম্মান দেয়নি দেশ। নীরা আন্দামানে আসার একবছর পর স্বাধীন হয়েছিল দেশ। মুক্তি পেয়েছিলেন নীরা। এই আত্মত্যাগের সম্মান দেয়নি দেশ। অভিমানে সাধারণের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন অসাধারণ নীরা।
বহু বছর পর নীরা আর্য্যকে খুঁজে পাওয়া গেছিল হায়দ্রাবাদের ফলকনুমা এলাকায়। স্বাধীন ভারতে ফুল বেচে পেট চালাতেন তিনি। থাকতেন বস্তির এক চালা ঘরে। বস্তির লোকেরা তাঁকে ডাকতেন পেডাম্মা(ঠাকুমা) বলে। পরবর্তী সময়ে তাঁর পরিচয় জানা গেলে তাঁকে সরকারি পেনশন দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা ফিরিয়ে দেন।
সকলের অলক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের ২৬শে জুলাই উসমানিয়া হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছিলেন ৯৬ বছরের বীরাঙ্গনা এক অগ্নিকন্যা নীরা আর্য্য। না রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য হয়নি, জোটেনি গান স্যালুট। একজন সাংবাদিক তার শেষকৃত্য করেছিলেন, তিনিই দিয়েছিলেন ফুলের মালা, ফেলেছিলেন দু ফোঁটা চোখের জল। যে কুঁড়ে ঘরে নীরা থাকতেন কয়েকদিন পর সেটিও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, কারণ সেটি ছিল সরকারি জমির ওপর। সেদিনই বোধহয় নীরা বুঝতে পেরে ছিলেন যে মাটির জন্য তিনি রক্ত ঝরিয়ে ছিলেন সেই মাটিও তাঁর নিজের ছিল না।
তথ্যসূত্র:
1)First Lady Spy of INA by Tejpal Singh Dharma.
2) আজাদ হিন্দ কি পেহেলি জাসুস , মধু ধামা
3) অমর উজালা, নীরা আর্য্য উইকিপিডিয়া
4) The Telegraph.
COURTESY: Bishwapati Raychowdhuri.