“Divided India or destroyed India”….. Mohammed Ali Jinnah
উপরোক্ত কথাটি বলেছিলেন মহম্মদ আলী জিন্নাহ। 1946 সালের 16ই মে ব্রিটিশ সরকার ভারতে ক্যাবিনেট মিশনকে পাঠালো যাতে সুষ্ঠুভাবে ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পন্ন করা যায়। ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তর ত্রিস্তরীয় পরিকাঠামোয় করা হবে বলে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় অর্থাৎ ‘কেন্দ্র’, ‘প্রদেশসমূহ’ এবং ‘প্রদেশ’ এর প্রস্তাবনা গ্রহণ করা হয়। 1940 সালের লাহোর প্রস্তাব থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী এলাকা এবং পূর্ব ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম পৃথক দেশ গঠনের দাবি জানাতে থাকে মুসলিম লীগ। 1946 সালের ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ত্রিস্তর পরিকাঠামো সরাসরি মুসলিম লীগের দাবিকে সমর্থন করেই তৈরি করা হয়েছিল।
ভারতীয় গণপরিষদের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ। 16ই জুন ক্যাবিনেট মিশনের ভারত বিভাজনের প্রস্তাব দুই দলই প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করেছিল। মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও কোন কোন প্রদেশ ও অঞ্চল ভারত থেকে বিভক্ত হবে এই নিয়ে কংগ্রেস ও লীগ সহমত ছিল না কিন্তু ব্রিটিশ সরকার পরে এই নিয়ে উপযুক্ত আলোচনা হবে বলে আশ্বাস দেয় এবং অন্তর্বর্তী সরকার ও সংবিধান সভাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার কথা ঘোষণা করে। ব্রিটিশ সরকারের তরফে ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল এই আশ্বাস দিলে কংগ্রেস অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার উদ্দেশ্যে গণপরিষদে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়।
10 জুলাই 1946 সালে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নেহেরু ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করলেও প্রয়োজনে কিছু রদবদলের কথা উল্লেখ করেন এবং গণপরিষদের অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেবার কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু মুসলিম লীগ গণপরিষদে যোগ দেবে না বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং কারণ হিসাবে বলে যে পৃথক স্বাধীন এবং সার্বভৌম মুসলিম দেশের জন্য কংগ্রেস মুখে বললেও পরবর্তী সময়ে তারা তাদের সিদ্ধান্ত বদল করতে পারে। কংগ্রেসের মৌখিক প্রতিশ্রুতির উপর লীগ আস্থা রাখতে পারে নি। 29 শে জুলাই 1946,জিন্নাহ যেভাবেই হোক পাকিস্তান গঠনের দাবিতে অনড় থাকে এবং তার জন্য আক্রমণের পথ, লড়াইয়ের পথ বেছে নিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন নি। পৃথক রাষ্ট্রের দাবীতে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেন যাকে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ বলে উল্লেখ করা হয়। এবং 16 ই আগস্ট দেশব্যাপী এই দিন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের জন্য ডাক দেওয়া হয় এবং তা পালনের জন্য ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছিল।
ভারতের অন্যান্য মুসলিম প্রধান অঞ্চলে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে উপলক্ষ্যে যে ধর্মঘট পালিত হয়েছিল তাতে কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা যায়নি। অথচ শুধু মাত্র কলকাতাতেই এই বিশৃংখলা এক ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত হয়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ যেমন পাঞ্জাব, সিন্ধ এবং সেখানকার শহর যেমন করাচি, হায়দ্রাবাদ, ইসলামাবাদ, লাহোর, এই সব শহরে শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মঘট পালন করা হয়েছিল। কিন্তু কলকাতায় সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা গেল কেন? এর কারণ অবিভক্ত বাংলা প্রদেশে 1941 সালের আদমশুমারি অনুসারে 60% ছিল মুসলিম জনসংখ্যা এবং 40% হিন্দু জনসংখ্যা ছিল।এবং এখানে মুসলিম লীগের সরকার ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু বাংলার রাজধানী কলকাতায় হিন্দু ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রায় 73 শতাংশ। কলকাতা ছিল অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, প্রতিষ্ঠিত,স্বাবলম্বী এবং সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার ছিল রাজধানী কলকাতা। সেই কলকাতা পাকিস্তানের মধ্যে পড়বে কিনা সেই নিয়েৎছিল এক বিশাল টানাপোড়েন। কলকাতা ছিল ব্যবসা বাণিজ্যের ঘাঁটি যার মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল রাজস্থান, মাড়োয়ারি, গুজরাটি সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে। দীর্ঘ বহু বছর ধরে কলকাতায় বসবাস করার ফলে এদের হাতে ছিল কলকাতার অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি। এই অর্থনৈতিক জায়গায় অবাঙ্গালী মুসলিমদের প্রবেশের সুযোগ ছিল না বললেই চলে। সরাসরি প্রবেশ করতে না পেরে সেই সময় আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে একটি সমান্তরাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করতে শুরু করেছিল যার নিয়ন্ত্রণ ছিল অবাঙালি উর্দুভাষী মুসলমানদের হাতে। এবং বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ছিলেন এই অবাঙালি উর্দুভাষী মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি স্বরূপ নেতা। অশিক্ষিত গরিব কলকাতা পাকিস্তানের সঙ্গে থাকবে কিনা এই নিয়ে যতটা না লড়াই ছিল, তার থেকেও লড়াই ছিল কলকাতার অর্থনীতির দখল নেওয়া। আর সেই সুযোগটা চলে এলো 16 ই আগস্ট ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে ধর্মঘট পালন।
দুপুর নাগাদ শহীদ মিনারের ময়দান লাগোয়া এলাকায় কাতারে কাতারে মুসলিম মানুষের জমায়েত হতে শুরু করে। মঞ্চে খাজা নাজিমুদ্দিন ও সোহরাওয়ার্দীর জ্বলন্ত ভাষণ আর মিথ্যা বক্তব্যে টগবগ করে ফুটতে থাকে গরিব ও অশিক্ষিত মুসলমান সমাজের লোকজন। তাদের বারবার বলা হয় হিন্দুরা তাদের উপর আক্রমণ করেছে, তাদের ঘরবাড়ি লুট করে নিয়েছে, তাদের সমাজ ধ্বংসের মুখে। তাদের প্রতিশোধ নেবার সময় এসেছে। দুপুরের নামাজের পরে উত্তর কলকাতা রক্তে ভাসতে লাগলো। এই মিথ্যা ভাষণের ফলস্বরুপ বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী এবং স্থানীয় মানুষের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে হাজার পনের মানুষ যারা উত্তর কলকাতার বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দুরা থাকত তাদের মেরে ফেলা হয়। কিভাবে গলি থেকে রাস্তায় রাস্তায় মৃতদেহের স্তূপ তৈরি হয়েছিল, সেও এক ভয়ঙ্কর নির্বাক ইতিহাস। 1 লাখের উপর মানুষ গৃহহীন হয়ে ছিল। সোহরাওয়ার্দী ইচ্ছাকৃত ভাবে ব্রিটিশ পুলিশ এবং আর্মিকে তাঁদের দায়িত্ব পালনে বাধা দিয়ে এসেছিলেন। লালবাজারে প্রভাব খাটিয়ে, সেখানে উপস্থিত থেকে,নিজের লোকেদের সেখানে বসিয়ে রেখে পুলিশের কাজে বাধা দিয়েছিলেন। উপযুক্ত সময় মতন ব্রিটিশ বাহিনী যদি দায়িত্ব পালন করতো, তাহলে হিন্দুর জান-প্রাণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের এত ভয়ানক ক্ষতি হত না। এই যে “বিভাজন চাই নাহলে ধ্বংস করব” এই নীতি, এই ব্ল্যাকমেলিংয়ের রাজনীতি, এই চক্রান্তের রাজনীতি থেকেই ঠিক পরের বছর পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলো। কিন্তু 14 ই আগস্ট ভারতবর্ষ তিন টুকরোয় বিভাজিত হলো। মুসলিম লীগ তাদের দ্বিজাতি তত্ত্ব মেনে দেশকে ভাগ করার ঘৃণ্য চক্রান্ত করেছিল এবং তাতে তারা সফল হল। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং পরবর্তী সময়ে নোয়াখালী থেকে পূর্ব পাঞ্জাব পর্যন্ত যে ভয়ঙ্কর দাঙ্গায় কাতারে কাতারে হিন্দু মারা গেল, যাদের লেখা কোন ইতিহাসে হিন্দু গণহত্যার কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না, সঠিক ইতিহাস এখনো পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি, আসলে সেটাই তো বিভক্ত ভারতকে ধ্বংস করেছে। মানে ভারতে বসবাসকারী নাগরিক সমাজকে ধ্বংস করা, ভারতের অর্থনীতি বিপর্যস্ত করে দেওয়া, পাকিস্তান মুসলিম দেশ ঘোষণা হওয়ার পরও যে ভয়ংকর অত্যাচার, ধর্মীয় নিপীড়ন সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ভোগ করে আসতে বাধ্য হয়েছে, যে বর্বরতা নৃশংসতা তারা চোখে দেখেছে তার ফলে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান এবং অধুনা বাংলাদেশ থেকে ক্রমাগত হিন্দু ভারতবর্ষে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে। অর্থাৎ এই বিধ্বংসী মনোভাব তাদের কখনো বন্ধ হয়নি। তারা তাদের ধ্বংসলীলা চালিয়েছে যার ফলস্বরূপ বিপুল পরিমাণ শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। সেই সময়ের ইতিহাসের কথা আর বর্তমানে দেশের 75 তম স্বাধীনতা দিবস পূর্তির পরেও এই রাজ্যে হিন্দুদের অবস্থানটি একরকম। যে রাজ্য একসময় পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য রক্তস্নান করেছিল, সেই রাজ্য বিধানসভা ভোটের পর শুধুমাত্র বিরোধী রাজনৈতিক দল সমর্থন করা বা তাদের কর্মী হবার অপরাধে যে অত্যাচার, নিপীড়ন সহ্য করেছে, শাসকশ্রেণী যে হত্যালীলা চালিয়েছে, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এও অভূতপূর্ব। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন শাসনতন্ত্রের মধ্যে থেকে, আশ্রয়ে থেকে বিরোধী দলের কর্মী সমর্থকদের উপর নিপীড়ন চালায়, তখন তার ভয়াবহতা নিয়ে কোনো সংশয় থাকে না। প্রশাসন যখন স্থবির হয়ে বসে থাকে তখন অপরাধ জানানোর জন্য, কোন নালিশ জানানোর জন্য কোন জায়গা থাকে না। একটার পর একটা রাজনৈতিক কর্মী খুন হয়েছে, তাদের জব কার্ড, রেশন কার্ড কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যে সব বুথে বিরোধী রাজনৈতিক দল এগিয়ে থেকেছে বা জিতেছে, সেখানে কোভিডের ভ্যাকসিনের ইনজেকশন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। অত্যাচারের সীমা অপরিসীম। মাঠের পর মাঠে ধান কাটতে দেওয়া হয়নি, লুটপাট হয়ে গেছে দোকান ঘর, বাড়ি লুট হয়ে গেছে। মেয়েদের অত্যাচারের সব লিপিবদ্ধ করাও সম্ভব হয় নি।যে অত্যাচার এর বিবরণের কিছু অংশ আমরা হিউম্যান রাইটস কমিশনের 50 পাতার রিপোর্টে পেয়েছি, তার সঙ্গে পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশে হিন্দু নিগ্রহের অত্যাচারের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। আর এটা বড় দুর্ভাগ্যের বিষয়। কিন্তু তার থেকেও বড় দুর্ভাগ্য এই রাজ্যের জন্য লেখা থাকে যখন এই দুই অত্যাচারের ঘটনাকে একটি কমন দিন দিয়ে বেঁধে ফেলার জঘন্য চক্রান্ত করা হয়। শাসকদলের বিজয় উৎসব খুব স্বাভাবিক ঘটনা। বরঞ্চ গণতন্ত্রের সুষ্ঠু, সুস্থ স্বাভাবিক লক্ষণ মাত্র। কিন্তু সেই বিজয় উল্লাস যখন বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকদের অত্যাচার, তাদের যন্ত্রণার উল্লাসে পরিণত হয়, তখন বোঝা যায় এই সমাজে ধ্বংসকারী সেই ইন্ধন দাতা এখনো বহাল তবিয়তে বর্তমান হয়ত অন্য ভেষে, অন্য বেশে। 2021 সালের শাসকদলের বিজয় উৎসব তাই 16ই আগস্ট ‘খেলা হবে দিবস’ এবং মুখ্যমন্ত্রী নিজে তা ঘোষণা করেন। এবং সেই সাথে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এও প্রমাণ করে দিয়েছেন যে এই রাজ্যে আসলে সুষ্ঠ ও সুস্থ গণতন্ত্রের পরিবেশ নেই। এই রাজ্য সরকার গণতন্ত্র চায় না। গণতন্ত্রের শাসক ও বিরোধী দলের যে স্বাভাবিক যোগদান আছে তার বিরোধিতা করে একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করার প্রচেষ্টায়, অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে তিনি লিপ্ত হয়েছেন। 1946 সালের 16 ই আগস্ট হাজার হাজার হিন্দুর রক্ত ঝরেছিল দেশভাগের জন্য আর হাজার হাজার বিরোধী কর্মী ,সমর্থক গৃহহীন 2021 16 ই আগস্ট বিধানসভা নির্বাচনের পরে। হাজার হাজার হিন্দু অত্যাচারিত হয়েছিল এবং বিনিময়ে সেদিন পাকিস্তান গঠন হয়েছিল। এবার বিধানসভা নির্বাচন জিতে সরকার গঠন হলো। কিন্তু তার পিছনে এবারও কি তবে অন্যকিছু গঠন হতে চলেছে? বলবে ভবিষ্যত। আমরা শুধু অনন্ত অপেক্ষায় থাকি সংবিধান মেনে গণতন্ত্র ফেরার অপেক্ষায়।
দেবযানী হালদার