তাঁর হাতে তৈরি মাটির প্রদীপ নিয়ে বাংলার সীমানা পেরিয়ে দিল্লি বা মুম্বাইতে অনেক মানুষ দীপাবলির আলোর উৎসবে অংশ নেন। অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাওয়ার উৎসবে তাঁর হাতে তৈরি প্রদীপ অনেকের মনে উদ্দীপনা তৈরি করে। কিন্তু যিনি এই প্রদীপ তৈরি করেন, তিনি নিজেই ডুবে রয়েছেন অন্ধকারে।
শিলিগুড়ির চয়নপাড়া পালপাড়ার বাসিন্দা সাধন পাল। ৬৮ বছর বয়সী সাধনবাবু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। আট বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে তাঁর পা দু’টি অসাড় হয়ে যায়। কিন্তু তবুও থেমে থাকেননি তিনি। ঠাকুরদা, বাবার কাছে শিখে নেন মাটি দিয়ে প্রদীপ তৈরির কাজ। সেই থেকে আজও তিনি মাটির প্রদীপ তৈরি করে চলেছেন। এখন প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দু’হাজার প্রদীপ তৈরি করেন সাধনবাবু। আর প্রতিবছর আলোর উৎসবের আগে তিনি নিজেই যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে এক থেকে দেড় লক্ষ প্রদীপ তৈরি করেন। এবারও তাতে খামতি নেই। বরঞ্চ এবার প্রদীপের চাহদা আরও বেশি।এবার দুর্গোৎসব পর্বে উত্তরবঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক কারিগরই কম প্রদীপ তৈরি করছেন। ফলে বাজারে প্রদীপের চাহিদা তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ ভারত থেকেও অতিরিক্ত মাটির প্রদীপের চাহিদা তৈরি হয়েছে। গতবছর যেখানে এক হাজার মাটির প্রদীপের দাম ছিল চারশো সাড়ে চারশো টাকা, এবার তা হয়েছে হাজারে ছশো-সাতশো টাকা।শুধু দিল্লি বা মুম্বাইতে নয়, স্থানীয় এলাকায় ট্রাই সাইকেলে চেপে নিজের হাতে তৈরি প্রদীপ ফেরি করেন এই প্রদীপ শিল্পী। তবে তাঁর মূল সমস্যা অর্থনৈতিক সঙ্কট। এই কাজ করে তেমন পয়সা আসে না। তবু দিনের পর দিন এই কাজ করে নেশা হয়ে গিয়েছে, আর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হওয়ায় অন্য সব কাজও চট করে শিখে নিয়ে করা তাঁর পক্ষে সম্ভব না৷ তাই একাজটিই মন দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। তিনি বলেন, করোনার আগে দীপাবলির সময় চিনের আলো বাজার ছেয়ে ফেলেছিল। তাতে মাটির প্রদীপের ব্যবসা অনেকটা মার খেয়েছিল। করোনা শুরু হওয়ার পর চিনা আলোর বাজার কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। সেদিক থেকে মাটির প্রদীপের বাজার আবার একটু উঠেছে। প্রদীপ শিল্পী সাধন পাল তাঁর লড়াইকে জোরদার করতে ইদানীং অবশ্য মাটির প্রদীপের সঙ্গে সঙ্গে মাটির ধুপতি,কলস, ঘটও তৈরি করছেন।
সাধন পালের বাড়ির আশপাশে গোটা চয়নপাড়া পালপাড়া এলাকায় আরও অনেকেই মাটির কাজ করেন। প্রত্যেককেই বংশ পরম্পরায় মাটির বিভিন্ন কাজ বা শিল্প টিকিয়ে রাখতে অনেক লড়াই করতে হচ্ছে। কিন্তু দুই পা অসাড় হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও মাটি-শিল্পকে নিয়ে সাধন পালের লড়াইকে অনেকেই স্যালুট জানান।