এটা কে.ভি.এস. ম্যানিয়ানের কাহিনী। তিনি ছিলেন সিভিল এভিয়েশনের ডিরেক্টর জেনারেলের স্টেনোগ্ৰাফার। ১৯৪৯ সালে আরএসএসের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। কে.ভি.এস. ম্যানিয়ানের নাম আগে কখনও শুনেছেন?
আমি অন্তত শুনিনি।
কে.ভি.এস.ম্যানিয়ান হলেন সেইসব ভারতীয়দের আদর্শ, পরাধীনতার গ্লানি যাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তাই ম্যানিয়ান ভারতবর্ষের বুকে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। কে.ভি.এস.ম্যানিয়ানও ছিলেন একজন নিপাট ভদ্রলোক এবং সিভিল এভিয়েশনের ডিরেক্টর জেনারেলের অফিসের সামান্য বেতনভুক স্টেনোগ্রাফার। কাজের প্রতি তার আনুগত্য ছিল লক্ষ্য করার মতো।
কিন্তু সেটা ছিল ১৯৪৮ সালের ১২ই ডিসেম্বর আগে পর্যন্ত। তখনও নেহরু শাসনের কদর্য দৃষ্টি তাঁর উপর পড়েনি।
এটা তাঁর গল্প।
*আরএসএস নিষিদ্ধকরণ*
সনাতন সভ্যতা এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে স্বাধীন ভারতের ইতিহাস হল নেহেরু-শাসিত সময়ের এক অন্ধকার আখ্যান। ১৯৪৮ সালের ৩০ শে জানুয়ারী নাথুরাম গডসে যখন মোহনদাস গান্ধীকে হত্যা করলো তখনই সম্ভবত এই গল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল। নেহরুর সরকার তৎপরতার সাথে কিভাবে আরএসএসকে নিষিদ্ধ করেছিল সেই বহুলচর্চিত গল্পটির পুনরাবৃত্তি আর করবো না। কিন্তু যে ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা দরকার সেটা হ’ল: এইসময় জারি করা সমস্ত নিষেধাজ্ঞাগুলি যথাযথ নিয়ম না মেনেই জোর করে মানুষের উপর চাপানো হয়েছিল। গান্ধীহত্যা ছিল ক্ষমতা লোভী কংগ্রেস এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বিরোধী দলের দীর্ঘদিনের কাঙ্খিত ফলশ্রুতি।
এছাড়াও আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তখন উঠে এসেছিল। একটা বড় রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বাধীন সরকারের জারি করা নিষেধাজ্ঞাগুলি আবারও প্রমাণ করে দিয়েছিল যে তথাকথিত “সংখ্যালঘু” মুসলিম সম্প্রদায়ের চাপের মুখে পড়ে রাষ্ট্রের প্রাচীন, অবিভক্ত সভ্যতার ভৌগোলিক অবস্থানের কাটাছেঁড়া করা হচ্ছে এবং যারা শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে একটা নতুন রাষ্ট্রের পত্তন করেছে।
আচার্য আর.সি. মজুমদার সম্ভবত এই বিষয়ে সেরা বিশ্লেষণ করেছিলেন:
জিন্নাহ’র লড়াই ভারতের স্বাধীনতার জন্য ছিল না বরং সেটা ছিল সম্পূর্ণভাবে মুসলিম সম্প্রদায়কে স্বাধীন করার লড়াই এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে তিনি এই লড়াই জিতেছিলেন। আর মজার ব্যাপার হল যে সহিংসতার পুজারীদের সম্মতিতেই পুরো বিষয়টি ঘটেছিল। তাহলে এবার প্রশ্ন হল যে ভারতের স্বাধীনতার পিছনে গান্ধীজি কিভাবে তাঁর অহিংস আন্দোলনে কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন? তবে এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে পাকিস্তানের উৎপত্তির পিছনে মূল কারিগর ছিল সহিংসতার নগ্ন ও বর্বরোচিত রূপটি।
তবুও, ভারত “স্বাধীনতা” অর্জনের পরে, এই বিশেষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব অন্যায়ভাবে আরএসএসকে নিষিদ্ধ করে দেয়। পরাধীন ভারতের বুকে গড়ে ওঠা এই সংগঠনটি তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছিল বঙ্গভঙ্গ রদ করার, দেশের প্রতিটি প্রান্তের হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করে ভারতবর্ষের সভ্যতার অখন্ডতা এবং সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করার।
আরএসএসকে নিষিদ্ধ করাটাই যদি একমাত্র সমাধান ছিল তাহলে স্বাধীন ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে গান্ধীবাদী গুন্ডারা মহারাষ্ট্রের চিতপাবনে ব্রাহ্মণদের উপর অকথ্য অত্যাচার করে যে হত্যালীলা চালিয়েছিল সেই ঘটনার কোনো যথাযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে কী? যদিও এটা অন্য গল্প।
কংগ্রেস এবং তার অনুগামীরা প্রায় আঠারো মাস ধরে এই নিষেধাজ্ঞার কঠোরভাবে বলবৎ করেছিল। এটাকে আমি “গ্রেট নেহেরুভিয়ান পার্জ” বলে থাকি , যা পরবর্তী ছয়/ সাত দশক ধরে একটা বিভীষিকা তৈরী করে দিয়েছিল। এই ঘটনাটি কল্পনা দিয়ে গড়া কোনো গল্পকথা নয়। বরং এমনই নির্মম বাস্তব যার সাক্ষী ছিলাম আমি নিজে। তাই এরজন্য কোনো যুক্তি, তর্ক, নীতিকথার প্রয়োজন নেই। এটা হল রাজনীতির নামে রমরমিয়ে চলা এমন এক নোংরামি যা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে।
*আরএসএস এজেন্ট*
এটা ছিল সেইসময়ের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তকমা। তাবড় তাবড় বিদ্বানরাও সেইজন্য ভয়ে পীঠ বাঁচিয়ে চলতো এবং বিভিন্ন জনসমাবেশের বিতর্কসভায় মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ছিল এমনই এক সংগঠন যাঁরা তৎকালীন কংগ্রেসের পার্টির মুখ বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতো। যুথিষ্ঠির যেভাবে জয়দ্রথকে ক্ষমা করে দিতেন নেহেরুর শাসনকালে গান্ধীজির ভূমিকাও সেই একই রকম ছিল। নেহেরুর সময় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সাথে যোগাযোগ রাখাটা ছিল দন্ডনীয় অপরাধ এবং শাস্তির তালিকায় যে কেবল কারাবাস ছিল তা নয়, মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত দেওয়া হতো। সাধারণ মানুষ সবসময় ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতো। শুধুমাত্র সন্দেহের শিকার হয়ে কত মানুষ যে নির্যাতিত হয়েছিল তার কোনো ইয়াত্তা নেই। আর এইভাবেই প্রশাসনিকভাবে এবং আমলাতন্ত্রে নেহেরুর সরকার সাফল্য অর্জনকরেছিল। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি হয়ে উঠেছিল ভয়াবহ। রাতারাতি জারি করা নির্দেশিকা সমস্ত সরকারী কর্মচারীদের ভীয়ে সন্ত্রস্ত করে দিয়েছিল। তাদের আরএসএসের জন্য সহানুভূতি থাকুক বা না থাকুক, তারা জাতীয়তাবাদী হোক বা না হোক, কিন্তু তারা সবাই মনেপ্রাণে দেশকে ভালবাসত।
সরকার কীভাবে আরএসএস-বিরোধী কর্মকাণ্ড চালাতো তার একটি সরকারী নমুনা দেওয়া হল।
১৯৪৮ সালের ৮ই এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্থাপনা বিভাগে লেখা একটি চিঠির উদ্ধৃতাংশ:
২৮.১২.৪৮ তারিখে মুখ্য কমিশনার [ অফ পুলিশ]- এর পক্ষ থেকে কিছু সরকারী কর্মচারীদের একটি তালিকা আমাদের কাছে পাঠানো হয়, সেখানে আরএসএসের কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকার অপরাধে সেইসব সরকারী কর্মচারীদের গ্রেপ্তার ও দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এইসব কর্মচারীদের বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থাগ্ৰহন করার জন্য কর্মচারীদের নাম এবং বিবরণগুলি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।
আমার মনে হয় এর বেশী বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন নেই।
তবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের বিরোধিতা করার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতিটি বোধ হয় ছিল দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে কঠোরভাবে জন সুরক্ষা আইন বলবৎ করা।
১৯৪৮ সালে ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে, দিল্লিতে ম্যানিয়ানের বাড়ির আশেপাশে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের তরফে একটি শান্তিপূর্ণ সত্যগ্রহের আয়োজন করা হয়েছিল। এরপরের ঘটনা ম্যানিয়ানের বয়ানেই শুনুন:
সময়টা ছিল ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরের ৫ বা ৬ তারিখ। দুপুরবেলা আমি নিজের বাড়িতে বসে শর্টহ্যান্ড প্র্যাকটিস করছিলাম। হঠাৎ বাইরে গোলমালের শব্দ শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। ঠিক সেইসময় আমার ছোট মেয়ে খেলা ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে আসে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে দেখি যে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করেছে। আমার সন্তানের অবস্থা দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগছিলো, সেইজন্য আমি সেখানে থাকা এক পুলিশ অফিসারকে এই গ্যাস ব্যবহারের ক্ষতিকারক দিকগুলোর কথা জানিয়ে প্রতিবাদ করি। কিন্তু সেই অফিসার ভেবে বসেন যে আমি তার কাজে হস্তক্ষেপ করছি। সেইজন্য আমাকে তার সাথে থানায় (ফাইস বাজার) নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে আমাকে এক রাতের জন্য আটক করে রাখা হয় … পরদিন সকালে আমাকে যথারীতি আদালতে হাজির করা হয়। আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে পুরো ঘটনা বিস্তারিতভাবে বললাম এবং আমি কোন পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ করেছিলাম সেটাও জানিয়েছিলাম। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য আমাকে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছিল এবং পুলিশ অফিসারের কাজে হস্তক্ষেপ করার জন্যই শুধুমাত্র আমি ক্ষমা চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি কোনোভাবেই [আরএসএস] আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার বিষয়টি স্বীকার করি নি।
সিভিল এভিয়েশনের ডিরেক্টর জেনারেলের অফিসের স্টেনোগ্রাফার কে.ভি.এস ম্যানিয়ানকে পাঞ্জাব জননিরাপত্তা আইনের ১৯ ধারা অনুসারে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে আদালত তাকে ক্ষমা করে দেন এবং সিআরপিসির ৫৬২ ধারা অনুসারে তাকে এইরকম কাজ আর দ্বিতীয়বার না করার জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয় এবং ১৯৪৮ সালের ১৩ ই ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান।
কিন্তু আসল দুঃসময় শুরু হয়েছিল এরপর।
১৯৪৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর, দিল্লির পুলিশের মুখ্য কমিশনার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে কিছু সরকারী কর্মচারীদের একটি তালিকা পাঠিয়েছিলেন। এই তালিকায় “আরএসএসের কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকার অপরাধে গ্রেপ্তার ও দোষী সাব্যস্ত হওয়া” কর্মচারীদের নাম ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই তালিকায় ম্যানিয়ার নাম ছিল এবং পুরো ঘটনাটির একটা হাস্যকর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে আদালত যখন ম্যানিয়ানকে মুক্তি দিয়েছে তার মানে সে অভিযুক্ত। কিন্তু শুধুমাত্র দোষী সাব্যস্ত হওয়াটাই তার উপযুক্ত শাস্তি হতে পারে না। বরং ম্যানিয়ানকে কাজ থেকে বরখাস্ত করাটাই হবে তার অন্যায়ের উপযুক্ত শাস্তি।
এই ঘটনাটির সাথে জড়িত ছিল বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রকের আমলারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের যুগ্ম-সচিব থেকে শুরু করে গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী, পুলিশ কমিশনার, যোগাযোগ মন্ত্রক— কে ছিলেন না এই তালিকায়। সমস্ত তথ্য, প্রমাণ, স্বৈরাচারী শাসনের গোলকধাঁধায় হারিয়ে গিয়েছিল।
যদিও, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক “বেনিফিট অফ ডাউটস্”-এর সুবিধা দিয়ে ম্যানিয়ানকে পুনর্বহালের আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন কিন্তু নির্লজ্জ, ক্ষমতালোভী আমলা’রা সেই সুযোগটুকুও কেড়ে নেন। ১৯৪৯ সালের ৩রা মার্চ কে.ভি.এস. ম্যানিয়ানকে সিভিল এভিয়েশনের ডিরেক্টর জেনারেলের তরফে একটা মেমো পাঠানো হয়। সেখানে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে “রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার জন্য তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হল”।
ঘটনার আকস্মিকতায় ম্যানিয়ান অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়েন এবং সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য একটি বিনীত আবেদন করেন। সেই আবেদনের কিছু অংশ নিচে দেওয়া হল:
আমিই আমার পরিবারের একমাত্র নির্ভরতার জায়গা এবং আপনাদের এই সিদ্ধান্তের ধাক্কা আমার পক্ষে কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব। তাই আমি প্রার্থনা জানাচ্ছি যে মামলার পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তটি দয়া করে যদি পুনরালোচনা করেন।
কিন্তু ডি.জি. ছিলেন নির্বিকার।
যাইহোক, ম্যানিয়ান এরপর সরাসরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানান। যদিও তাতে সিদ্ধান্তের বিশেষ কিছু রদবদল ঘটেনি। আমলাতন্ত্রের গোঁড়া মনোভাব ম্যানিয়ানকে দ্বিতীয়বার আর ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়নি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সাথে যোগাযোগ রাখার অভিযোগে ম্যানিয়ানের জীবন ও জীবিকা দুই’ই প্রশ্নচিহ্নের মুখে এসে পড়ে। ম্যানিয়ানের চাকরি জীবনের এই বড় সিদ্ধান্তের পেছনে থাকা একজন প্রবীণ এবং শক্তিশালী আমলা যে ধরনের ভাষার ব্যবহার করেছিলেন, তার একটি নমুনা এখানে দেওয়া হল।
১নং নমুনা:
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে এরপর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে বলা হয়, “[এ জাতীয়] মামলায় কোনও প্রকার আবেদনে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না” এবং “আদালত লঘু শাস্তি দিলেও, অভিযুক্তকে কর্মক্ষেত্রে পুনর্বহালের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমরা আমাদের মতামত জানালাম। চাকরি থেকে বরখাস্ত করাই হল ম্যানিয়ানের উপযুক্ত শাস্তি ”। সরকার পক্ষের উদ্দেশ্য ছিল যেকোনোভাবে এটা “প্রমাণ” করা যে ম্যানিয়ান আসলেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সাথে যুক্ত ছিল।
১৯৪৯ সালের ৪ঠা মে জেলা প্রশাসক আর.দয়ালের লেখা চিঠির কিছু অংশ তুলে ধরা হল:
আর.এস.এস. এর কর্মকান্ডের সাথে শ্রী কে.ভি.এস. ম্যানিয়ান জড়িত ছিলেন। সরকারি তরফে যেহেতু রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়েছে তাই একজন সরকারী কর্মচারী হয়েও এই নিষিদ্ধ এই সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা এবং সংগঠনের সমর্থক হিসাবে সরকার বিরোধী কাজের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ম্যানিয়ানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
গল্পের গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল: ১৯৪৮ সালের ২৮শে ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের ৩রা মার্চ, এইসময় ম্যানিয়ান প্রথম “নেহেরুভিয়ান পার্জের” শিকার হন এবং ১৯৪৯ সালের ৪ঠা মে আমলাতান্ত্রিক “রায়” ঘোষণা করা হয়।
যাইহোক, ১৯৪৯ সালের ২৬ শে মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক প্রবীণ আধিকারিকের চিঠিতে এই ঘটনার চূড়ান্ত পরিণতির ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে:
[ম্যানিয়ানের] বিচার প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং আপনি জানেন যে এইসব ঘটনার কোনো প্রমাণ রাখা হয় না। জনগণকে বলা হয়েছিল যে অভিযুক্ত মিছিলে সামিল হয়ে সরকার বিরোধী স্লোগান দিচ্ছিলেন।
আমরা জানি না এরপরে ম্যানিয়ানের সাথে কী হয়েছিল। তাঁর জীবনের এই গল্প জাতীয় সংরক্ষণাগারে রাখা আছে।
ম্যানিয়ান শুধুমাত্র একজন সামান্য স্টেনোগ্রাফার নন, তিনি ছিলেন নেহেরুর দেশগঠনের নাটকে বলি হওয়া অসংখ্য নিরীহ জনগণের মধ্যে একজন। ম্যানিয়ানের এই করুণ কাহিনীর বিষয়বস্তু শুধু তাঁর চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়া নয়, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কথাও নয় বরং এমন একজন রাজনৈতিক নেতার যিনি নতুনভাবে দেশকে সাজানোর নামে, দেশ “গঠন”-এর নামে দেশের সংষ্কৃতি, ঐক্যতা এবং নৈতিকতাকে গলা টিপে খুন করেছিলেন।
গবেষকরা এইরকম হাজার হাজার নিরীহ, অত্যাচারিত ম্যানিয়ানদের খুঁজে পাবেন, যাঁরা আজও মাটির নিচে অধীর অপেক্ষায় আছেন তাদের উপর হওয়া লাঞ্ছনা, বঞ্চনার কথা সেইসব মানুষদের বলার জন্য যারা অন্তত একটু ধৈর্য আর সহানুভূতি নিয়ে তাদের কথা শুনবেন।