প্রান্তিক মানুষের জীবনগাথা বড় মায়াময়। ওরা মানুষের পরিচয় নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়। অনেক স্বপ্ন আর প্রত্যাশা নিয়ে একটা ছোট্ট সংসারের আশায় বুক বাঁধে। জীবনের জন্য ওদেরও অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের দরকার হয়। এসবের কারণেই ওরা পাড়ি দেয় দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ওরা পরিযায়ী শ্রমিক। এরাজ্যে কাজ নেই। নীতিহীন আদর্শ ও দেশপ্রেমহীন প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠীর তাণ্ডবে সবধরনের কারখানা আজ বন্ধ। কারখানার মালিকরা দিনের পর দিন ‘ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ শুনে শুনে ক্লান্ত, বিরক্ত। তারা চলে গেছে অন্য রাজ্যে। এ রাজ্য হয়েছে শিল্পবন্ধ্যা। পশ্চিমবঙ্গের সুলভ কর্মক্ষম শ্রমিক আজ নিজভূমে পরবাসী। ভিন রাজ্যে ওরা কেউ গহনা শিল্পে, কেউ নির্মাণ কাজে, কেউ হোটেলে আবার কেউ বা দরজির কাজের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে বউ-বাচ্ছা নিয়ে একটা ছোট্ট আলো আঁধারি ঘরে দিনপাত করে। সারাদিন প্রানপাত পরিশ্রম করে ঘরে ফিরে দুটো রুটি মুখে দিয়ে সকালের অপেক্ষায় একটু গড়িয়ে নেয়। এভাবেই চলছিল অস্বচ্ছল শান্তির জীবন। বাধ সাধল করোনা ভাইরাসের সর্বনাশা অভিঘাত। স্পর্শ করলে এবং শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে একজন থেকে বহুজনের মধ্যে। সঠিক সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা না হলে জীবনের আশা হয় ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। আর সেই চিকিৎসা নির্ভর করে সরকারের বদান্যতা এবং সহযোগিতার ওপর। অতিমারির এই কালবেলায় প্রাথমিক চিকিৎসা হল প্রতিরোধমূলক সতর্কতা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যার অন্যতম অনুষঙ্গ। সেই ধারাবাহিকতায় বন্ধ হয়ে গেল দোকানপাট, স্তব্ধ হয়ে গেল গণপরিবহণ পরিষেবা। বেচারা শ্রমিকগুলো প্রায় দু’মাসকাল কর্মহীন হয়ে পড়ল। ফলে অতিকষ্টে গচ্ছিত সামান্য অর্থও শেষ হতে চলল। এভাবে বেঁচে থাকা বিষম দায় হয়ে পড়ল ওদের। গুজরাট, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, নয়দা থেকে দলবদ্ধ শ্রমিকেরা বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে রাজ্যে ফিরিয়ে আনার জন্য কাতর প্রার্থনা জানিয়েছে। তারা বারংবার জানিয়েছে তাদের টাকাকড়ি নিঃশেষিত, বাড়ী ফেরার মত সম্বল নেই। একবেলা আধপেটা খেয়ে কোনরকমে বেঁচে আছেন। তারপরেও আমাদের শাসক নিশ্চুপ, নির্বিকার! নির্মম হৃদয়হীনতার পরিচয় দিয়েছেন। অনোন্যপায় হয়ে হতাশা আর গ্লানির ধোঁয়ায় চোখ জ্বালিয়ে বউ ছেলে নিয়ে ওরা নেমে এল পথে। গ্রীষ্মের দাবদাহ উপেক্ষা করে দাঁতে দাঁত চেপে যাত্রা শুরু করল। নিজের জন্মভিটের উদ্দ্যেশে। একমাত্র অভিলাষ, যেমন করেই হোক নিজের ঘরে ফিরতে হবে। দিল্লী (Delhi) -উত্তরপ্রদেশ (Uttar Pradesh) -বিহার (Bihar) -পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) , কমবেশি দুহাজার কিলোমিটারের হাঁটাপথ! বিবস্ত্র ছলনার সংলাপে মুখ্যমন্ত্রী যখন রাজনীতির দড়ি টানাটানিতে আত্মমগ্ন, তখন অভুক্ত শ্রমিকের দল রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে পথ চলছে। ওরা ধূসর বাস্তবের রুক্ষতা দেখেছে, আজ ওরা সরকার, প্রশাসন কিছুরই পরোয়া করে না। ওরা শুধু বাঁচতে চায়। ওর হাঁটছে কখনো উত্তপ্ত পিচগলা রাজপথে, কখনো বা কোমর অবধি জলের মধ্যে দিয়ে। ওরা এগিয়ে চলেছে গহীন অরন্যের বুক চিরে। ওদের বাঁচতেই হবে নিজের জন্যে, পরিবারের জন্যে, দুধের বাচ্চাটার জন্যে। সমভাবে গুজরাট, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ থেকে হাজারে হাজারে ঘরমুখী মানুষের ঢল। ওরা মানসিকভাবে নিপীড়িত, এমনকি শারীরিক ভাবেও নিশেষিত। যোগীরাজ্যে সরকারি আহারে শরীরটা একটু সবল হয়ে উঠলে আবার শুরু পথ চলা। এই দুরূহ অভিযাত্রায় পুলিশবাহিনী অনেক সহযাত্রীর গতিরোধ করেছে। তারা খালি পেটে দু-তিন দিন একই জায়গায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। যখন মুক্ত হয়েছে আবার শুরু করেছে পথ চলা। সারাদিন একটানা পথ চলার ফলে শরীর ও মনে একটা অবিচ্ছিন্ন বিষাদের ছাপ স্পষ্ট। আমরা দেখেছি বাচ্ছা শিশুকে ট্রলি সুটকেসের উপর শুইয়ে রেখে কিংবা বৃদ্ধা মাকে কাঁধে করে পথ হাঁটছে ক্লান্তিহীন শ্রমিকের দল। চলার পথে দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে বেশ কয়েকজন পরিযায়ী শ্রমিক মারা গেছে। একদিকে ঘাম অশ্রুমিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর দোলায় চেপে দোল খাচ্ছেন। নানান অজুহাতে ওদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি প্রতিহত করেছেন, এড়িয়ে গেছেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হৃদয়হীন নির্মমতার সাক্ষী হয়ে রইল। সূর্য ওঠে, অস্তও যায়। ওদের পথ যেন শেষ হয় না। প্রসাশনের নিদারুন অবহেলা আরে অপমানকে পাথেয় করে ওরা পথ চলছে। ওদের জীবনে নেই আলো, আছে শুধু আলেয়ার হাতছানি।
পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজের রাজ্যে ফিরিয়ে আনার প্রতি এই অদ্ভুত অনীহার দুটো কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রথমত ফিরে আসার পর কয়েকলক্ষ শ্রমিককে প্রাথমিক চিকিৎসা ও কয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করার মত পরিকাঠামো সরকারের নেই। দ্বিতীয়ত তাদের নিখরচায় রেশন ব্যবস্থা চালু করার মত গণবন্টন ব্যবস্থার অভাব আছে। এই না থাকার কারনে করোনা পীড়িত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ার সমূহ সম্ভবনা থেকেই যায়। তাই স্থির করে ফেললেন ওদেরকে আনা যাবে না। বাস্তবে সুশাসনের যখন অভাব রয়েছে, দুর্নীতি যেখানে ছায়াসঙ্গী সেখানে এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। অথচ এইসব গরিব-মধ্যবিত্ত পরিবারই নির্বাচনে জিতে আসার আদর্শ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। পরিতোষের বিষয় কেন্দ্র সরকারের চাপাচাপিতে কিছু শ্রমিক বিলম্বে হলেও নিজভূমে ফিরতে পেরেছেন। এখনও অসংখ্য শ্রমিকের ঘরে ফেরা বাকী। অনেকে হাঁটছে, অনেকে স্টেশনে বা বাস টারমিনাসে রাত কাটাচ্ছে। ওরা এখনও জানে না ওরা কবে ঘরে ফিরবে, আদৌ ফেরা হবে কিনা! ওদের চরম দুর্দশার কৃষ্ণগহ্বর থেকে মুক্তির কোন সুস্পস্ট পথরেখা এখনও দৃশ্যমান নয়। জীবন ও মরনের দ্বান্দ্বিক বাস্তবে ওরা মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। আমরা স্মরণে রাখতে চাই সমাজের সুবিধাবিহীন ও অধিকারবঞ্চিত মানুষজনেরও মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকা আবশ্যক। পিছিয়ে পড়া বিশাল জনগোষ্ঠীকে পিছনে রেখে দেশ কখনই এগিয়ে যেতে পারে না। প্রসঙ্গত কবিগুরুর কবিতার সেই লাইনটি বিশেষভাবে প্রাণিধানযোগ্য –‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে, পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’। তাই আমরা বিশ্বাস করি, মানুষ হিসেবে সুখে থাকা ও শান্তিতে থাকা ওদেরও শ্বাশ্বত অধিকার।

নিশীথ কুমার দাশ (Nishith Kumar Das)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.