ভাবতে হবে স্বাধীনতার শতবর্ষ পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য কী হবে? : দত্তাত্রেয় হোসবলে

আজ যখন দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে, তখন দেশের প্রতিটি নাগরিক এই উপলক্ষে উচ্ছ্বসিত। আমাদের দেশ ৭৫ বছরের দীর্ঘ যাত্রায় সমস্ত বাধা ও সংকটকে অতিক্রম করেছে। এই যাত্রা স্বাভাবিকভাবেই রোমাঞ্চকর। আজ যখন আমাদের দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে, তখন দেশের এযাবৎ অভিজ্ঞতা , আমরা কি করতে পেরেছি ও আগামীদিনে আমাদের সামনে কি ‘চ্যালেঞ্জ’ – তা আমরা জানি । আমরা জানি – কিভাবে একটি জাতি স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশভাগের ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হয়েছিল এবং দেশভাগের ফলে সৃষ্ট সহিংসতার শিকার হয়েছিল। এরপরই সীমান্তে হামলার সম্মুখীন হতে হয় , কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ আমাদের জাতির শক্তিকে পরাজিত করতে পারেনি। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমাদের দেশ তার গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করে চলেছে। আজ আমরা ভাবলে আশ্চর্য হই যে কিভাবে আমাদের দেশের নাগরিকরা দেশভাগ ও বিদেশী আক্রমণ সত্ত্বেও ১৯৫২ সালে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব উদযাপন করেছিল এবং ভারতে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল।
এটি ছিল ভারতের জনগণের সেই সামর্থ্য ও ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ যা ১৯৪৭ সালের পরে – গোয়া, দাদরা এবং নগর হাভেলি, হায়দ্রাবাদ এবং পুদুচেরিকে আবার ভারতের মাটিতে পুনরায় একত্রিত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে এবং অবশেষে অসামরিক উপায়ে সেই লক্ষ্য অর্জন করে। অনেক সময় প্রশ্ন জাগে – যে জাতি মাত্র কয়েক বছর আগে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছে তারা এত তাড়াতাড়ি কিভাবে এতকিছু করতে পারলো? এটা বুঝতে হলে ভারতের সমাজকে বুঝতে হবে। ভারতের সমাজ সব ধরনের আক্রমণ ও সংকট সত্ত্বেও তার ঐক্যের সূত্র ভুলে যায়নি। আমরা যদি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে দেখতে পাবো যে, শহর, গ্রাম, বন, পাহাড়, উপকূল সর্বত্রই সংগ্রামের পদচিহ্ন পাওয়া যায়। সাঁওতালদের বিদ্রোহই হোক বা দক্ষিণের বীরদের সশস্ত্র সংগ্রাম, সব সংঘর্ষই হোক সর্বত্র একই ভাব পাবেন ; সমস্ত সংগ্রামে আপনি একই অনুভূতি পাবেন। সকল মানুষ যে কোন মূল্যে স্বাধীনতা চেয়েছিল এবং তারা এই স্বাধীনতা শুধু নিজেদের জন্য নয়, তাদের সমাজ ও সমগ্র জাতির জন্য চেয়েছিল।
স্বাধীনতার জন্য ভারতীয় সমাজের আকাঙ্ক্ষা এতটাই ছিল যে তারা সমস্ত ধরণের ত্যাগ স্বীকার করতে এবং সমস্ত ধরণের পথ অনুসরণ করতে প্রস্তুত ছিল। এই কারণেই ভারতের স্বাধীনতার জন্য দেশের বাইরে – লন্ডন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান সর্বত্র প্রচেষ্টা ছিল। লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউস ভারতের স্বাধীনতার প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এতটাই  ব্যাপক ছিল যে তা সমস্ত ভৌগোলিক,  অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভাজনের উর্ধ্বে গিয়ে ভারতের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এর জন্য আলাদা করে কারো নাম বলা  অপ্রয়োজনীয় হবে কারণ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অসংখ্য মানুষ  প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। এর মধ্যে মাত্র কয়েকজনের  নাম আমরা জানি কিন্তু অনেকের নাম জানি না। এটি ছিল এমন একটি আন্দোলন যার সঙ্গে অসংখ্য বীর যুক্ত ছিলেন । কিন্তু প্রত্যেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর একই লক্ষ্য ছিল।  

এই কারণেই স্বাধীনতার পর দেশকে চূড়ান্ত গৌরবের দিকে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা দেশের মানুষের মনে ছিল এবং এর জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। এই কারণে জরুরি অবস্থা জারী করে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর আঘাত হানার চেষ্টা করা হলে দেশের জনগণ তা প্রতিরোধ করতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন ।

আজ যখন আমরা স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ করছি, তখন আমাদের ভাবতে হবে স্বাধীনতার শতবর্ষ পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য কী হবে? আজ যখন সারা বিশ্ব করোনা এবং বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন জাতি হিসেবে আমাদের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত? কোনো সন্দেহ নেই যে বিগত এক দশক ভারতের জন্য প্রাপ্তি ও সমৃদ্ধিতে ভরপুর। স্বাস্থ্য সহ ভারতের নাগরিকদের মৌলিক সুবিধা প্রদানের বিষয়, আবাসন এবং আর্থিক সুযোগ – সুবিধার বিষয় যাই হোক না কেন এসব থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে যে ভারতের সমাজ এবং নাগরিকরা সক্ষম হচ্ছে। এটা ভারতের মেধা , যা করোনার সময়ে সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে সস্তা এবং নিরাপদ ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। এভাবেই ভারত সারা বিশ্বকে সাহায্য করেছে এবং কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে।
এই সমস্ত সাফল্য সত্ত্বেও, ভারতীয় সমাজ এবং একটি জাতি হিসাবে, আমাদের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক আরো অনেক সংকটের মুখোমুখি হতে হবে এবং সেসবের সমাধানও খুঁজতে হবে। ভারতকে এখনও সম্প্রীতির জন্য আরও প্রচেষ্টা করতে হবে কারণ সমাজ যত বেশি ঐক্যবদ্ধ হবে, তত শক্তিশালী হবে। তাই এ বিষয়ে আরও কাজ করতে হবে। আজ ভারতীয় অর্থনীতি নানবিধ সংকটের মধ্যে দিয়েও অগ্রসর হচ্ছে, তবে ভারতের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আকাঙ্খা পূরণের জন্য এটিকে আরও দ্রুত অগ্রসর হতে হবে। এর জন্য আমাদের ভারতীয় শিল্প ও উদ্যোগের প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। এছাড়া আমরা ভারতের কর্মসংস্থানের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব না। ভারত তখনই সত্যিকারের ক্ষমতাসম্পন্ন হবে যখন ভারত আত্মনির্ভর হবে ।
যেহেতু ভারতবর্ষ আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ করছে, এটা আমাদের বিবেচনা করা দরকার যে দেশের নীতি- নির্ধারণ বর্তমান ভারতের আকাঙ্খা ও প্রত্যাশার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা। আজকে আমরা এমন অনেক ক্ষেত্র দেখতে পাই, যেখানে একজন সাধারণ মানুষ নিজেকে অসহায় এবং অক্ষম মনে করে, সেটা আজকের বিচার ব্যবস্থা হোক বা রাজনৈতিক ব্যবস্থা। কিভাবে একজন সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে এসব ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা সহজে পৌঁছানো যায়, তা ভেবে দেখা দরকার।
ভারত তখনই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে যখন তার আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী হবে এবং এই আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক বা কেবলমাত্র সামাজিক ক্ষমতায়নের দ্বারা হতে পারেনা । ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার শক্তি অর্থনৈতিক ও সামাজিক উভয় প্রকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মধ্যেই নিহিত।

দত্তাত্রেয় হোসবলে
সরকার্যবাহ , রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.