অত:পর, হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা উল্টো সুর ধরলো, আর ইঁদুরের নয়, এবার দলে দলে মানুষের বাচ্চা তাকে যন্ত্রবৎ অনুসরণ করে পাহাড়ের গহ্বরে মিলিয়ে গেলো

আফগানিস্তানের পরিপ্রেক্ষিতে ডান-বাম নির্বিশেষে সব নেতাদের বলতে শুনলাম : ধর্ম দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার|
তাহলে কি অধর্ম দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল?
Colonial hangoverটা সকলেরই মনে কমবেশী আছে সেটা চেপে গেলে চলবে? আপনি মনে মনে ইংল্যান্ড বা আমেরিকার রাষ্ট্রব্যাবস্থাকে আদর্শস্থানীয় মনে করবেন আর আপনার রাষ্ট্র এবং সমাজের দশা তাদেরই মতো হবেনা এই ভন্ডামিটা কিকরে সযত্নে মনের মধ্যে লালন করেন?
নিচের ছবিটা একটু দেখে নিন, আপনার রাজ্যের একটি প্রথম সারির দৈনিকে প্রকাশিত, এই হচ্ছে আপনার সমাজের অবস্থা, আপনার ছেলে কি হাতভাঙা? দরজা বন্ধ করে লিপস্টিক লাগায়? তাহলে আপনার বাড়িতে ডাকাত পড়লে কিকরে আশা করবেন সে প্রতিরোধ করবে?
আপনার মেয়ে টমবয় বলে আপনি গর্বের হাসি হাসেন? সে কি ‘নিজের জীবন নিজের ইচ্ছা’ প্রকল্পে নাম লিখিয়েছে?
তাহলে কোনোদিন কোনো আলাউদ্দিন খিলজিকে জামাই হিসেবে পেলে আফসোস করবেন না তো?

আপনার ধারণাও নেই যে আপনার বিচারধারা একটি নির্দিষ্ট মতবাদের দ্বারা অজান্তেই পরিচালিত হয়, এই ধরুন আপনারই ঘরের ছেলে তমাল বা স্মরজিৎ মুখার্জি তালিবানদের আচরণে ‘খারাপ কিছু’ পায়নি|
কি করে পাবে? স্মরজিৎ বা তমালের কাছে যেকোনো জ্ঞানেরই উৎস direct experience, তাদেরকে তালিবানরা হত্যা করেনি, অতয়েব নিশ্চয় কাউকেই করছেনা

কিন্তু মুস্কিলটা হলো এটাকেই যদি জ্ঞানের একমাত্র প্রামাণ্য ভিত্তি বলে ধরে নিতে হয় তবে –
⚫পিতা মাতা কে ডিএনএ পরীক্ষা ব্যাতীত বাবা মা বলা উচিত হবেনা
🔵দাদু বা প্রপিতামহের অস্তিত্ত্ব সম্পর্কেও সন্দিহান হতে হবে
⚫জামাকাপড় পরেন তো? যেটা পরেন সেটা আদৌ জামা তো? প্লাস্টিকের ত্রিপল নয় তো? কি করে বোঝেন? দোকানদারের কথা তো কোনো বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ নয়, তা ছাড়া আপনি তো জ্ঞানের উৎস হিসেবে অন্যের কথায় ভরসাই করেন না তো দোকানদারের বক্তব্যে আস্থা রাখবেন কোন যুক্তিতে?
🔵ছোট থেকে মায়ের হাতে খেয়ে মানুষ তো? পরীক্ষা করে দেখতেন তিনি সত্যিই খাবার দিচ্ছেন না বিষ দিচ্ছেন?
প্রমাণ ছাড়া কিছুই গ্রহনযোগ্য হওয়া উচিত নয়!

বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণের তুলনায় আবার দরকারমতো ব্যাক্তিগত অনুভূতি বসিয়ে নেন না তো? ওটার কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণের নিরিখে কোনো মূল্য নেই

এপিস্টেমোলজি(Epistemology) শব্দটার সঙ্গে হয়তো অনেকেই পরিচিত নয়, সেখানে বিশ্বাস(belief) আর তার ঔচিত্য(justification) এই দুটি নিয়ে বহু চর্চা হয়েছে| এবং এই প্রসঙ্গে যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ত্ব পায় তা হলো জ্ঞানের উৎস|

আপনি হয়তো ইরাকের টাওয়ার অফ ব্যাবেল দেখেননি, সে ক্ষেত্রে আপনার কাছে দুটো উপায় আছে : ১) সেটির অস্তিত্ত্বকে অস্বীকার করা
২) যে দেখেছে তার বক্তব্যে ভরসা করা

ধরে নেওয়া যাক আপনি জ্ঞানের উৎস হিসেবে শুধু নিজের বুদ্ধি বা পরীক্ষালব্ধ ফলে আস্থা রাখেন, তা ওপরে যে প্রশ্নগুলি করলাম তার মীমাংসা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে করতে আপনাকে হবেই, নচেৎ কোনো বাহ্যিক উৎসকে জ্ঞানের প্রামাণ্য উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে – একেই বলে reliabilism

তমাল বা স্মরজিৎ যে দেশের ফসল তার সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে scriptural reliabilismকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে আশ্রয় করে টিকে ছিলো, কম্যুনিস্টরা এ দেশে এসে প্রথম ধাক্কাও খেয়েছিলো এখানেই, তারা দেখে এই দেশের সংস্কৃতিকে সরাতে এসে রতনলাল ব্রাহ্মণের মতো নেতা গজিয়ে ওঠে যার শাস্ত্রের ওপর ভক্তি কোনোমতেই টলে না| সেইজন্য শুরু হলো হিন্দু এপিস্টেমোলজিকে ধাপে ধাপে বদনাম দিয়ে বেড়াল বিদায় করা, জলের অপর নাম জীবনের বদলে যদি এফিডেভিট করে ‘রোগবাহী জীবানুর ভান্ডার’ করে দেওয়া যায় তবে আর সে জল কেউ ছোঁবে না

বলা হলো শাস্ত্র মিথ্যা, মনুষ্যসৃষ্ট , অতয়েব তার ইচ্ছেমাফিক পরিবর্তনশীল|
প্রামাণ্য কি? মার্ক্সবাদ, কারণ তা ‘বিজ্ঞানসম্মত’, সোভিয়েত ইউনিয়নের যে কাঁসি এখন ফেটে চৌচির হয়ে গেছে তা সশব্দে বাজিয়ে রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চর তথা আর্থিক মদতপুষ্ট দালালকে মুখ বানিয়ে প্রচার করা হলো “দেখো, তোমার শাস্ত্রের জীর্ণ, ক্ষয়িষ্ণু তালপাতায় কিস্যু নেই, পিপলস সায়েন্স কংগ্রেস আমার, বিজ্ঞানসমিতি আমার, প্রকারান্তরে বিজ্ঞানই আমার, অতয়েব আমিই নির্ভরযোগ্য, আমার বক্তব্যই প্রামাণ্য”

এবং এই ধারার বিপুল সমর্থন মিললো তৎকালীন শাসকবর্গের কাছ থেকে, ইংরেজ শাসনে তারা স্বেচ্ছাচারের স্বাদ পেয়ে গেছে, কোন ছেঁড়াখোঁড়া স্মৃতিশাস্ত্রের পুঁথিতে কি লেখা আছে তা মানতে তাদের নাভিশ্বাস ওঠে| তবে হ্যাঁ, বাবু তার ভৃত্যদের আর আগের মতো বলে বলে চাবকান না, তিনি ইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নামক যন্তরমন্তর ঘর নিয়ন্ত্রন করেন, গণমাধ্যমের মালিক, লেখক, প্রকাশকও তিনিই, আর কিসের দরকার? হেঁ হেঁ, শুধু সবাইকে বোঝালেই হলো তারা যা করছে নিজের ইচ্ছা ও বুদ্ধিবলে করছে, এতে সবার অহমিকা অটুট থাকবে কিন্তু কেউ বুঝতেও পারবে না

“অত:পর, হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা উল্টো সুর ধরলো, আর ইঁদুরের নয়, এবার দলে দলে মানুষের বাচ্চা তাকে যন্ত্রবৎ অনুসরণ করে পাহাড়ের গহ্বরে মিলিয়ে গেলো”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.