ভারতীয় অর্থনীতি বর্তমানে ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে। কর কাঠামো সম্পূর্ণ পাল্টানো হচ্ছে, নতুন কৃষিবিল গঠন করা হচ্ছে, শ্রম আইনে বদল ঘটানো হচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলি পর্যালোচনা করলে আমরা সরকারের একটি সুস্পষ্ট নীতি দেখতে পাব,যা একান্তই স্বকীয়। মার্ক্সবাদ বা পুঁজিবাদের সাথে এই নীতিগুলো মিল নেই।বস্তুতঃ, ভারতীয় অর্থনীতি তথা সমাজ
মহান চিন্তাবিদ দত্তপন্থ থেঙ্গারীর দেখানো পথে হাঁটতে আরম্ভ করেছে।এই পথ ‘তৃতীয় পন্থা’ নামে পরিচিত। দত্তপন্থ জী র মতে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে এটি তৃতীয় পন্থা নয়;একমাত্র পন্থা।
মার্ক্সবাদ ও পুঁজিবাদ অর্থনীতির প্রধান দুই শাখা। স্যার এডাম স্মিথ এর ‘ওয়েলথ অফ নেশনস’ (1776) ক্যাপিতালিসম এর ভীত। যার মূলে আছে, চাহিদা ও যোগান কে সরকার অনিয়ন্ত্রিত বাজার প্রদান করা।এর ফলে, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য কম থাকবে ও শিল্পপতিরা নতুন আবিস্কারে উৎসাহ দিতে বাধ্য থাকবে।শিল্পপতিদের জন্য উন্মুক্ত বাজার তীব্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করবে,যা এই বাজারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হবে। চাহিদা ও যোগানের সম্পর্ক এই ক্ষেত্রে ব্যস্তানুপাতিক। যোগান বৃদ্ধি পেলে চাহিদা হ্রাস পায়।তাই, শিল্পগোষ্ঠী গুলি সর্বদা যোগানকে নিয়ন্ত্রণ করে চাহিদা বজায় রাখে। অগাস্ট ল্যস এর ‘সর্বোচ্চ মুনাফা তত্ব’ অনুসারে কোনো মনোপলি বাজারের আকৃতি থাকে বৃত্তাকার।প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তা ষরভূজ আকৃতি ধারণ করে। এই তত্বের মূল উদ্দেশ্য দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন। আবার, আলফ্রেড ওয়েবার তাঁর তত্বে পরিবহন খরচ ও শ্রমিকের খরচ কমিয়ে মুনাফা বৃদ্ধির কথা বলে।বলা হয়েছে একক উৎপাদন খরচ কমাতে। অর্থাৎ,সরাসরি শ্রমিক শোষণের কথা বলা হয়েছে।ক্যাপিতালিসমের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, “সামর্থ্য অনুযায়ী শ্রম এবং পুঁজি অনুসারী উপার্জন”। এর ফলে, ধনী তার বিনিয়োগের মাধ্যমে ধনীতর হয়ে ওঠে,গরিব হয় গরিবতর।
ইউরোপে শিল্পবিপ্লব ক্যাপিতালিসমের যে নগ্ন রূপ দেখিয়ে ছিল, তার থেকে উত্থান মার্কসবাদের। কার্ল মার্ক্সএর ‘দাস ক্যাপিটাল'(1867)কে এই ধারণার ভিত্তি বলা যেতে পারে।মূল বক্তব্য,”সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ ও উৎপাদিত দ্রব্যের সম বন্টন।” তবে, লেনিন এই ধারণা সামান্য পরিবর্তন করে প্রয়োগ করেন। অন্তর্ভুক্তি ঘটান “ভ্যান গার্ড পার্টি”র,যারা রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনা করবে। সর্বাত্মক রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে সম্পদ উৎপাদন ও বন্টন করবে, এই ধারণা পরবর্তী সময়ে এক নায়ক তন্ত্রের জন্ম দেয়। USSR ভাঙার সেটা অন্যতম কারণ। মাওবাদ মার্কস এর মতবাদ থেকে অনেকটাই আলাদা। মার্ক্সবাদ শিল্প ভিত্তিক তত্ব, মাওবাদ কৃষি। ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ এই ধারণা মাওবাদের গ্রহণযোগ্যতা কমিয়েছে। এরফলে, বিশ্বের সামান্য কয়েকটি দেশে মার্ক্সবাদের অস্তিত্ব দেখা যায়।মার্কসবাদের বর্তমান রূপও বিভ্রান্তিকর।মার্ক্সবাদ বর্তমানে বিবর্তিত হয়ে কোথাও সমাজতন্ত্র, কোথাও ধনতন্ত্রর রূপ নিয়েছে। মোট কথা, এটি একটি ব্যর্থ তত্ব।
জন মায়নার্ড কেইনস ফ্রি মার্কেটের বদলে ক্যাপিতালিসমকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলেন।বলেন, নির্দিষ্ট সময় অন্তর মন্দা চক্রের কথাও।রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে পুঁজিবাদ একটি বিভ্রান্তিকর বিষয়। আমরা চীনের মত কমিউনিস্ট দেশেও এখন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ দেখে থাকি। অথচ, সুইডেনের মত সমাজতান্ত্রিক দেশে প্রায় উন্মুক্ত বাজার লক্ষ্য করা যায়। তাই, কেইনস তত্ব পুঁজিবাদের স্বরূপকেই বিকৃত করেছে বলা যায়।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে দুটি তত্বের গ্রহণযোগ্যতাই খুব কম।তবে উপায়! তৃতীয় পন্থা রূপে সমাজতন্ত্রও আলোচিত হয়। তবে সমাজতন্ত্রর মূলরূপ সুস্পষ্ট নয়। USSR, নাজি সসালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি, নেহেরুর ভারত, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলি.. প্রত্যেকেই নিজেদের সমাজতান্ত্রিক মনে করে। অথচ প্রত্যেকের স্বরূপ আলাদা। উঠে আসে মুসলিম অর্থনীতির ধারণা। কিন্তু, সুদহীন এই অর্থনীতি বাইরের থেকে ক্রমাগত সম্পদের আগমন না ঘটলে বর্তমান সময়ে টিকে থাকতে পারবে না।বেকারত্ব দূরীকরণের ক্ষমতাও এই অর্থনীতির নেই।আলোচিত হয়, ক্রিশ্চান অর্থনীতিও; সাম্রাজ্যবাদ ছাড়া যার টিকে থাকা অসম্ভব।বহু চিন্তাবিদ তৃতীয় পন্থার উদ্ভাসনের চেষ্টা করেছেন।তাঁদের মধ্যে অন্যতম দত্তপন্থ থেঙ্গারী। তাঁর তত্বের মূল ভিত্তি integral humanism। যাঁর মূল বক্তব্য, “সম্পদ উৎপাদনের মাধ্যমে সমাজের সর্বাঙ্গীন বিকাশ”।এই তত্ত্ব একই সঙ্গে মার্ক্সবাদ ও পুঁজিবাদের বিরোধী। কিভাবে? ক্যাপিতালিসম হোক, বা মার্কসীসম! দুটি তত্বই increasing value economic model; অর্থাৎ, দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বাড়তে হবে। নইলে ক্যাপিতালিসমে মুনাফার ঘাটতি হবে, মার্ক্সবাদে শ্রমিক কম মজুরি পাবে।এই দুই তত্বই দ্রব্য ও পরিষেবাকে টাকায় রূপান্তরিত করে economic growth পরিমাপ করে। তৃতীয় পন্থা উৎপাদিত দ্রব্য ও পরিষেবার মূল্য নির্ণয় করে না।এখন প্রশ্ন হল, পদ্ধতি দুটির তফাৎ কি?মনে করুন, ভারতে কোনো বছর 100টি পেন তৈরি হল।ক্যাপিতালিসম ও মার্কসীসম বলবে প্রতিটা পেন 5টাকা করে হলে মোট 500 টাকার সম্পদ আছে। পরের বছর উৎপাদন দ্বিগুণ করা হলো।তখন, যোগান বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম কমে 2টাকা হল। অর্থাৎ, 200টি পেন 400 টাকা। অর্থাৎ, উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও উপরের তত্ত্ব দুটি মনে করবে সম্পদ কমে গিয়েছে।কিন্তু, তৃতীয় পন্থা মনে করবে, উৎপাদন দ্বিগুন হওয়ায়, সম্পদও দ্বিগুন হয়েছে।
তৃতীয় পন্থা decreasing value economic model; বিপুল উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য কমান এর লক্ষ্য। এর মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য সাধারণের নাগালে থাকবে ও কোম্পানিগুলি রপ্তানি বাড়াতে বাধ্য হবে। উৎপাদন ক্ষেত্রে জাতীয় প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সমাজে উৎপাদিত সম্পদ বা পরিষেবা কোনোটারই অর্থমূল্য পরিমাপ করা হয়না, কারণ অর্থমূল্য আপেক্ষিক।আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের মন্দা, সম্পর্কের অবনতি টাকার দামকে প্রভাবিত করে। তাই, মোট উৎপাদিত সম্পদ এই তত্বে হিসাব করা হয়। দ্রব্যমূল্য কমান লক্ষ্য হওয়ায়, যোগান বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট মন্দা এই তত্বের আদর্শ অর্থনৈতিক অবস্থা। বিপুল জাতীয় সম্পদ উৎপাদন ও রপ্তানির মাধ্যমে সমাজের সবার উন্নতি এই তত্বের মুখ্য লক্ষ্য।সম্প্রতি ভারতীয় অর্থনীতি মহান চিন্তাবিদ দত্তপন্থ থেঙ্গারির দেখানো তৃতীয় পথেই হাটতে আরম্ভ করেছে। আধুনিক শিক্ষানীতি,কৃষিবিল, শিল্পবিলে তৃতীয় পন্থার প্রভাব স্পষ্ট।
1990 সালে অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে ভারতীয় অর্থনীতি নব্য ক্যাপিতালিসম এর দিকে হাটতে আরম্ভ করে। যার মূল নীতি Liberalisation- Privatisation- Globalisation বা LPG। ভারতের বাজারে ঝাঁপিয়ে পরে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি। হেড এন্ড সোল্ডার এর মত আন্তর্জাতিক সংস্থাও 50 পয়সা বা এক টাকার পণ্য তৈরি করে ভারতের গরিব মানুষের পকেট কাটতে থাকে। যোগান বৃদ্ধির জন্য নতুন চাহিদা তৈরি করা হয়। বর্তমানেও বিদেশি কোম্পানিগুলি ‘servant economie’ তৈরি করার প্রচেষ্টায় আছে। যেখানে, সমস্ত ভোগ্যপণ্য আমাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।যাঁরা পৌঁছে দিচ্ছেন, তাঁদের মাইনেও যথেষ্ট কম দেওয়া হয়, আবার আমাদের এই অভ্যাসের দাস বানিয়ে বহুজাতিক অনলাইন সংস্থা গুলি নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধি করে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
ক্যাপিতালিসম আমাদের চাহিদাকে নিজের হাতের পুতুল বানিয়ে ছেড়েছে। বিস্কুট,শ্যাম্পু, এলোপ্যাথিক ওষুধের মত আন্তর্জাতিক পণ্য কে অত্যাবশ্যক পণ্যে পরিণত করেছে। দারিদ্র সীমার নীচে থাকা মানুষেরাও পুষ্টিকর খাবারের আগে এই চাহিদাগুলি পূরণে বাধ্য হয়। নব্বইয়ের দশকে USA গোটা পৃথিবীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে,”Capitalism is the only way, there are no alternatives.”
মাও সে তুঙ এর একটা বিখ্যাত মন্তব্য, ‘আধুনিকীকরণ মানেই পশ্চিমীকরণ নয়।’ অথচ, বিশ্বের বৃহত্তম অংশ যেন পশ্চিমী সভ্যতা থেকে অর্থনীতি সবকিছুই অন্ধভাবে অনুকরণ করে চলেছে।আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়।এরফলে, আমাদের দেশের অর্থ -সামাজিক প্রেক্ষাপটে পশ্চিমীসভ্যতার ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 2008 সালের বিশ্বব্যাপী মন্দা ক্যাপিতালিসম সম্পর্কে চিন্তাবিদদের পুনর্মূল্যায়নে বাধ্য করে।তৃতীয় পন্থা রূপে একাধিক তত্ব উঠে এসেছে। তারমধ্যে, সোসালিসম ও থেঙ্গারী তত্বদ্বয় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। বস্তুত:, মার্ক্সবাদ ও ক্যাপিতালিসম উভয়ের পতন আসন্ন, থেঙ্গারী তার নিখুঁত ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন। বলেছিলেন, এদের অন্তদ্বন্দ্বই এদের পতনের কারণ হবে। জন কেইনসও নির্দিষ্ট সময় অন্তর তীব্র মন্দা চক্রের নির্দেশ করেন। এছাড়াও, যে ব্যবস্থা ক্রমাগত ধনবৈষম্য বৃদ্ধি করতে থাকে, তা কিভাবে জনগণের জন্য ভালো হতে পারে!মার্ক্সবাদ হোক, বা পুঁজিবাদ, ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে প্রকৃত পক্ষে শোষণ করে সাধারণ জনগণকে।বাড়তে থাকে অনাবশ্যক পণ্য সম্ভার,প্রকৃতি হতে থাকে নিঃস্ব ,রিক্ত.. অথচ,আমাদের দেশ দীর্ঘ কয়েক শতক বিশ্ব অর্থনীতিকে শাসন করেছে প্রবহমান উন্নয়নের মাধ্যমেই।কখনোই প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
তৃতীয় পন্থা পুঁজিপ্রধান শিল্পের পরিবর্তে শ্রম প্রধান শিল্প স্থাপনের কথা বলে। শ্রমিকই হবে শিল্পের লভ্যাংশের মালিক।এরফলে,বিপুল উৎপাদনের মাধ্যমে শ্রমিকরা তাঁদের উপার্জন বৃদ্ধি করতে পারবে। আবার, যোগান বৃদ্ধি দ্রব্যমূল্য দেশের জনগণের নাগালের মধ্যে রাখবে।উদবৃত্ত সম্পদ রপ্তানির মাধ্যমে দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করবে। দেশের প্রয়োজন অনুসারে সম্পদ আহরণ,উৎপাদন, ব্যবহার এবং বন্টন হবে। ‘Nature is efficient to meet Man’s need, not greed.’অথচ ক্যাপিতালিসম সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের জন্য প্রকৃতির অনিয়ন্ত্রিত শোষণে বিশ্বাসী।তৃতীয় পন্থার মতে প্রকৃতি আমাদের মাতৃসমা।মুনাফার প্রয়োজনে এর শোষণ অন্যায়।বর্তমান প্রয়োজন মেটাতে যেটুকু সম্পদ সংগ্রহ করা প্রয়োজন, কেবলমাত্র সেইটুকু সংগ্রহ করা উচিত।বর্তমান ভোগকে নিয়ন্ত্রণ করে, ভবিষ্যতের জন্য সম্পদ সংরক্ষণই sustainable development। সনাতনী ভারতীয় সংস্কৃতির এই ধারণা আজ সমগ্র বিশ্বে মাদৃত।তৃতীয় পন্থা নিয়ন্ত্রিত সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে বহতা উন্নয়নের ধারণার সমার্থক।
ঐতিহাসিক উইল ডুরান্ট এর মতে, “After all, when one tries to change institutions without having changed the nature of men, the unchanged nature will soon resurrect those institutions.” তৃতীয় পন্থা কোনো সামাজিক প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত করতে গেলে জনসাধারণের মানসিকতা হতে হবে জাতীয়তাবাদী , মানবিক এবং প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। পাশ্চাত্য দর্শনগুলিতে মানুষকে দুটি বর্গে ভাগ করা হয়েছে। যথা,বিত্তশালী ও বিত্তহীন।মার্কসের মতে,এই দুই বর্গের মধ্যে নিরন্তর সংগ্রাম চলতে থাকে। কিন্তু, ভারতীয় সংস্কৃতিতে এই দুই বিভাগ ও তাদের সংগ্রাম দেখা যায়নি। জাত,ধর্ম, বর্ণে বিভক্ত ভারতে অর্থনৈতিক সংগ্রাম কখনও গুরুত্ব পায়নি। বৈদিক ভারতে চাকরির অস্তিত্ব থাকলেও অধিকাংশ মানুষের রোজগার ছিল স্বনির্ভরতা বা self -employment। পুঁজিবাদে surplus value বা মুনাফা পুঁজিপতিদের কাছে যায়। মার্ক্সবাদে রাষ্ট্র এই লাভ গ্রহণ করে। কিন্তু, ভারতে এই মুনাফা সরাসরি সমাজের কাছেই পৌঁছনো উচিত।সমাজ এই ক্ষেত্রে পুঁজিপতির ন্যায় আচরণ করবে।এটা তখনই সম্ভব যদি গোটা সমাজের বিকাশ সঠিক ভাবে হয়।পুঁজিবাদের মত অল্প মানুষের উন্নতি নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষের সার্বিক উন্নতি এই ব্যবস্থার লক্ষ্য।Labour intensive শিল্পের মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে মুনাফা পৌঁছে দিতে হবে।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে হতে হবে কার্যকরী।পাশ্চাত্যর জ্ঞান ও প্রযুক্তিকে প্রাচ্যের আঙ্গিকে গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমাদের সনাতন ঐতিহ্যর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। “Nothing can be tought, everything is to be learn. ” ঋষি অরবিন্দর এই বানীকে স্মরণ করে শিক্ষা ব্যবস্থা হওয়া উচিত কর্মমুখী। জাপানী শিক্ষা ব্যবস্থা যেমন জাতীয় অস্মিতাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রযুক্তি কে গ্রহণ করেছে,আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনুরূপ হওয়া উচিত। আশার কথা, NEP র মাধ্যমে প্রস্তাবিত শিক্ষা ব্যবস্থা দত্তপন্থ জী প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থা হতে চলেছে।
মানবাধিকার/ মানবতাবাদ এই শব্দগুলি পশ্চিমী সভ্যতার দান।ইউরোপের ইতিহাস ঘাঁটলে বার বার বিজ্ঞান ও ধর্মের সংঘর্ষ দেখা যায়। ধর্ম বার বার বিজ্ঞান কে বাঁধা দানের চেষ্টা করেছে। কিন্তু, ভারতের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। ভারতে ধর্ম ও বিজ্ঞান সহাবস্থানে চলেছে। বিজ্ঞানের উন্মেষ অধিকাংশ ভারতীয়র বৌদ্ধিক স্তরকে উন্নত করেছে। সমাজ হয়ে উঠেছে, ব্যক্তির থেকে বৃহত্তর। তাই, human এর অধিকারের,তুলনায় গোষ্ঠীর অধিকার আমাদের সংস্কৃতিতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।ব্যক্তি এখানে সমাজের অংশ।বেদের উক্তিই যেন শেষ কথা বলে,”All things are part of man,all thinks are for man.” কিন্তু, মধ্যযুগেও পাশ্চাত্য দুনিয়ার নৃশংসতা আমাদের স্তম্ভিত করে দেয়। তাই, Church centric humanism এর গুরুত্ব ভারতীয় উপমহাদেশে নেই। কারণ, পাশ্চাত্য বলে ‘god is kind’; কিন্তু, আমাদের কাছে ‘ kindness is god’ ।
মার্ক্সবাদ মালিক ও শ্রমিক দ্বন্দ্বের কথা বলে। নিরন্তর সংঘর্ষের মাধ্যমে ক্যাপিতালিসম থেকে সোসালিসম এর মাধ্যমে মার্কসীসমে সমাজ বিবর্তনের কথা বলে। তৃতীয় পন্থাও সমাজ পরিবর্তনের কথা বলে।তবে, সেই পরিবর্তনে বিপ্লব ও সংঘর্ষ তত্ব স্বীকার করেনা। সমাজ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া হবে Progressive Unfoldment of Consciousness ।অর্থাৎ, বীজ থেকে যেভাবে ধীরে ধীরে গাছ সৃষ্টি হয়, সেই ভাবে সমাজও বিবর্তিত হবে। পরিবর্তনই সমাজের ধর্ম। গাছে যেমন পুরান পাতা ঝরে গিয়ে নতুন পাতা জন্মায়, একই রকম ভাবে সমাজও পুরান অর্থনৈতিক অভ্যাস ছেড়ে নতুন অর্থনৈতিক অভ্যাস গ্রহণ করবে। সেটা হবে, মালিক-শ্রমিক সমন্বয়ের মাধ্যমে,সংঘর্ষের মাধ্যমে নয়।
শিল্পর ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ভূমিকা হবে, একাধারে মালিক, শ্রমিক ও সহয়কের। এই ক্ষেত্রে আমরা আমূল বা লিজ্জত পাঁপড় কে উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারি।শিল্প জগতে এই সংস্থা দুটি বিপ্লব এনেছে। অপারেশন ফ্লাড প্রকল্পের চারটি পর্যায়ে আমূল সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদন করে চলেছে। অথচ, অমুলের অধিকাংশ মালিকানা গোয়ালাদের কাছে। তৃতীয় পন্থা কোম্পানির এই রূপকেই স্বীকৃতি দেয়।
বর্তমানে প্রাযুক্তিক বিবর্তন লক্ষণীয়। Artificial Intelligence ভবিষ্যতে শিল্পে শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তাকে প্রভাবিত করবে।এই প্রেক্ষাপটে তৃতীয় পন্থা পরিবর্তনকে সাদরে গ্রহণ করে। তৃতীয় পন্থার অন্যতম বিশ্লেষক সি কে সাজি নারায়নান এর মতে সমাজ ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়। বিবর্তন পথে আসা প্রাযুক্তিক উন্নতি তখনই সমাজের পক্ষে কল্যাণকর হয়ে উঠবে, যদি সেই প্রযুক্তির সাথে নৈতিকতা যুক্ত থাকে। প্রযুক্তির অনৈতিক ব্যবহার সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে। বস্তুত:, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যে বিপুল প্রাযুক্তিক উন্নতি ঘটে, তা মানব সমাজের জন্য কল্যাণকর ছিল না।যে প্রযুক্তি সমাজের কল্যাণকর প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম,তা তৃতীয় পন্থায় গৃহীত হবে।এই তৃতীয় পন্থার হাত ধরে ভারতীয় অর্থনীতি আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করুক।
সুমন চক্রবর্তী