মাছে-ভাতে বাঙালি। ঈশ্বরী পাটনি দেবী অন্নপূর্ণার কাছে বরদান চেয়েছিলেন, “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।” সেই ভাত তৈরির জন্যই ধানচাষ। আর সেই ধানচাষেই বাংলার অর্থনীতি পরিপুষ্ট হয়ে এসেছে দীর্ঘদিন। বাংলার ধানের কতই না ধরন- তুলাইপাঞ্জি, জলকামিনী, জামাইশাল, কবিরাজশাল, ঝিঙাশাল, আলতাপাটি, রূপশাল, সীতাশাল, দাঁড়শাল, রাবণশাল, বোরমাসা, রক্তশালী, খেজুরছড়ি, তিন সতীন, ফুলমতি। সবকটিই এক একটি ধানের নাম। বাংলার দেশি ধান যেমন সুস্বাদু, তেমনই পুষ্টিকর। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কম সময়ে বেশি ফলন পাওয়ার আশায় চাষিরা ঝুঁকে পড়েছিলেন রাসায়নিক সারযুক্ত হাইব্রিড ধানের দিকে। যে বাংলায় একসময় প্রায় ৫০০ প্রজাতির দেশি ধানের চাষ ছিল, সেই বাংলায় দেশি ধান হয়ে পড়েছিল ব্রাত্য। এযুগের আম বাঙালি জানেই না বাংলার দেশি ধানের নাম, তার ইতিহাস। তাদের স্বাদ গ্রহণ করা তো দূরের কথা। তবে সময় আবার বদলাচ্ছে। খাবারের পুষ্টিগুণ নিয়ে মানুষ সচেতন হচ্ছেন, ডাক্তাররাও সেই পরামর্শ দিচ্ছেন। ফলে রাসায়নিক-মুক্ত দেশি চালের চাহিদা আবার বাড়ছে। সেসব চালের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হল সুস্বাদু ও পুষ্টিকর মোহন চাল।
এই ধানগাছের উচ্চতা মাঝারি। মোহন ধান চাষ করা হয় খুবই কম জলে। মোহন চাল লম্বা এবং সরু আকারের হয়ে থাকে। এটি সুগন্ধহীন সিদ্ধ চাল। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে মোহন ধানের বীজ বপন করা হয় এবং ধান কাটা হয় নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। ধানের বীজ রোপন আর ধান কাটার মধ্যে ১২০ থেকে ১৩০ দিন সময় অতিবাহিত করা হয়। মোহন ধান চাষের জন্য শুধুমাত্র গোবর সার ব্যবহার করা হয়। কাজেই চালটি সম্পূর্ণ রাসায়নিক-মুক্ত। এই চালের ভাত অত্যন্ত সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। ভাত ছাড়াও মোহন চাল দিয়ে পোলাও, পায়েস আর ফ্রায়েড রাইসও তৈরি করা যায়।
মোহন ধান ঝাড়াই করার পর ধানগুলিকে ভাপানো হয়। তারপর সেই ধানকে সারারাত জলে ভিজিয়ে রাখা হয়। তারপর সেই ধানকে দু’দিন ধরে রোদে শুকানো হয়। প্রথমদিন অল্প শুকিয়ে তুলে রাখা হয়। দ্বিতীয়দিন ভালো করে রোদে শুকিয়ে, তারপর সেই ধানকে মিলিং করে তৈরি হয় মোহন চাল। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর এবং বর্ধমানের কিছু অঞ্চলে এই ধানের চাষ এখন ব্যাপক ভাবে হচ্ছে।
রাসায়নিক-যুক্ত এবং কীটনাশক দিয়ে চাষ করা চাল থেকে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ দীর্ঘমেয়াদি ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যেমন- হার্ট, কিডনি, লিভার, ত্বক, স্নায়ু। শিশু ও বয়স্কদের ওপর কীটনাশকের প্রভাব বেশি হয়। তাই চিকিৎসকরাও এখন রাসায়নিক বিহীন খাদ্য গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এছাড়া রাসায়নিক সারে আশঙ্কা থাকে পরিবেশ দূষণেরও। রাজ্যের কৃষি দপ্তরও এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে। কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজ্যের প্রায় ৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে এখন দেশি ধানের চাষ করা হয়, সম্পূর্ণ জৈবিক পদ্ধতিতে। চাষিদের ধানের বীজ দেওয়া হয়, চাষের পদ্ধতি শেখানো হয় এবং সরকারের তরফ থেকে স্বল্পসুদে কৃষিঋণ দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশি ধানে ভালো দাম পাওয়ার কারণে চাষিরাও এইসমস্ত ধান চাষে উৎসাহী হয়েছেন। প্রসঙ্গত, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলায় কালোনুনিয়া, মালশিরা, উত্তর দিনাজপুরে কাটারিভোগ ও তুলাইপাঞ্জি, বর্ধমান–বাঁকুড়া–বীরভূম ও হুগলিতে গোবিন্দভোগ, বাদশাভোগ, রাধাতিলক, উত্তর ২৪ পরগণা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় তালমুগুর, হোগলা, দুধেশ্বর, কেরালাসুন্দরী, বহুরূপী, বর্ধমান-বাঁকুড়া জেলায় মোহন ধানের চাষ হচ্ছে।
ধান আমাদের সাংস্কৃতিক সম্পদ। অম্বুবাচী থেকে হালপুণ্য, গোছপুণ্য, কাদাসারা, হালাকাটা/ধান্যচ্ছেদন/মুড়িকাটা, বেনাকি পুজো, সারবীড়া, নেড়া পোড়ানো, রান্নাপুজো, আউলি বাউলি পিঠে পুলি উৎসব, নবান্ন; বঙ্গের সমস্ত লোকায়ত যাপন আর ঐতিহ্যকে ঘিরে থাকে ধান। বাংলার দেশি ধান হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু বাংলার অর্থনীতির ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াই নয়, বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়াও বটে। তাই বাংলার দেশি ধানকে বাঁচিয়ে রাখা সব বাঙালিরই কর্তব্য।