মহালয়া থেকে সূচনা হয় যে উৎসবের বস্তুত তার সমাপ্তি দেওয়ালিতে কার্তিক মাসের অমানিশায় মহাকালীর পূজার শেষে শুক্লা দ্বিতীয়ায় ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিনে। বঙ্গজীবনে যত পূজা অনুষ্ঠান যা উৎসব আছে, তার মধ্যে অনন্য এই ভাইফোঁটা। ভাইফোঁটা দৃঢ় করে সবরকম পারিবারিক বন্ধনকে। সমাজ জীবনকেও দেখায় এক নতুন দিশা। ভাইফোঁটা শাশ্বত এক মধুর সম্পর্কের প্রতীক। শুধু বঙ্গদেশ নয়, সারা ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল প্রভৃতি দেশেও পালিত হয় ভাইফোঁটা। অঞ্চল ভেদে এই অনুষ্ঠানের নাম ভিন্ন হলেও সব জায়গাতেই এর মূল লক্ষ্য এক। এর মধ্য দিয়েই অস্তিত্বের শিকড় যেন হয় বহু শাখা-প্রশাখায় পরিব্যাপ্ত। সেই সঙ্গে একটি সম্পর্ক সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে নব নব প্রাণরসে। বঙ্গদেশে যে অনুষ্ঠানের চলতি নাম ভাইফোঁটা, সাধু ভাষায় তাকেই বলা হয় ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। দক্ষিণ ভারতে এটি বিশেষভাবে পরিচিত যম-দ্বিতীয়া নামে। উত্তর ভারতে দিনটি পালিত হয় ভাইদুজ হিসেবে। মহারাষ্ট্রে দিনটিকে বলা হয় ভাউবীজ বা ভাববীজ। নেপালে উৎসবটির নাম ভাইটিকা।এমনি সব নামাবলিতে আবরিত এই অনুষ্ঠানটির অন্তরবীণা বাজে একই সুরে। ভাই আর বােন। এই শব্দবন্ধের উদ্ভাসে প্রােজ্জ্বল যে সম্পর্ক, সবকিছুর বিচারে তা অতুলনীয়। একই গর্ভ সম্ভব সহােদর-সহােদরা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এমন এক আত্মিক বন্ধনে যুক্ত— সেখানে মুহুর্তের স্বার্থের মলিনতাও শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে পারে না। ফল্গুধারার মতেই স্নেহ ভালােবাসা এবং এক ধরনের অনুভব সবসময়ই ক্রিয়াশীল এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে। পরিবার বা সমাজ গঠনের স্বাভাবিক নিয়মেই মেয়েদের সব ছেড়ে যেতে হয় পতিগৃহে। সাময়িক ভাবে ভাই-বােনের মধ্যে নেমে আসে অদর্শনের যবনিকা। কিন্তু পিতৃগৃহে ছেড়ে আসা ভাই বা দাদাদের ভুলতে পারে না বােনেরা কোনাে সময়েই। সেই না ভােলার সূত্রেই শারদীয়ার রেশ ধরেই হেমন্তের শুরুতে আয়েজন করা হয় ভাইফোঁটার। দাদা বা ভাইদের মঙ্গল বা কল্যাণ কামনায় বােন বা দিদিদের এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে যােগ নেই কোনাে পূজা বা যাগযজ্ঞের। এতে দরকার পড়ে না কোনাে পুরােহিত বা ব্রাহ্মণের। সম্পূর্ণ ঘরােয়া বা পারিবারিক এই অনুষ্ঠানে সব বর্ণের বােনেরাই আন্তরিক স্নেহ, ভালােবাসা ও শ্রদ্ধায় ভাই বা দাদার কপালে ঘি-চন্দন-কাজলের ফোঁটা বা তিলক দেন নিজেরাই একটি মন্ত্র পড়ে। এ মন্ত্র পুরােটাই বাংলায় অনেকটা ছড়ার মতােই। কপালে ফোঁটা দিয়ে কোথাও কোথাও প্রদীপের আলােয় বরণ করা হয় ভাইকে। ছােটো ভাই বা দাদাদের দীর্ঘ জীবন কামনায় মেয়েলি ব্রতের ধারায় সাধারণত একটি ছড়া কাটা হয়। দেশ বা জেলা ভেদে এ ছড়ার দু-একটি শব্দে কিছু কিছু পার্থক্য দেখা যায়।
তবে সব মন্ত্র বা ছড়ারই সুর এক। সবগুলিতেই ভাইদের নিরাপদ, সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন প্রার্থনা করেন বােনেরা।
ভাইরাও ধান দুর্বা দিয়ে প্রণাম বা আশীর্বাদ করে প্রতিবচনে প্রার্থনা করেন বােনেদের সুখ-শান্তি-দীর্ঘজীবন। ভাইফোঁটার প্রজ্বলিত মন্ত্র বা ছড়াটি হলাে—
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
যম দুয়ারে পড়ল কাটা
আজ থেকে ভাই আমার যম
দুয়ারে নিম তিতা।
যমুনা দেয় যমরে ফোঁটা,
আমরা দিই ভাইরে ফোটা
স্বর্গে হুলুস্থুল মর্তে ফুল
আজ থেকে ভাই আমার না যাইও দূর।
কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় হয় ভাইফোটা। কোথাও কোথাও অবশ্য প্রতিপদেও ফোঁটা দেওয়ার রীতি আছে। দ্বিতীয়ার সময়-কাল জানা ছাড়া এক্ষেত্রে পঞ্জিকা বা পুঁথির কোনাে ভূমিকা নেই। পশ্চিমবঙ্গের কোথাও কোথাও শনি বা মঙ্গলবারে ফোটা দেওয়া হয় না। স্থানীয় লােকাচারে শনি বা মঙ্গলবারকে বলা হয় খর বার। তাই ওই দিন দুটিতে কোনাে শুভকাজ, প্রতিমা বিসর্জন প্রভৃতি কোনাে কাজ করা হয় না। অবশ্য অন্যরা বলেন, কার্তিকের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিটি ভাইয়ের মঙ্গল কামনার জন্য প্রশস্ত। তাই বার যাই হােক, ফোঁটা ওই দিনই দেওয়া কর্তব্য। ভাই দূরে থাকলে বা আসতে না পারলে বহু জায়গাতেই দেওয়াল বা খুঁটিতে ফোঁটা দিয়ে প্রার্থনা করা হয় ভাইয়ের মঙ্গল। আদিতে যা ছিল সম্পূর্ণভাবেই ঘরােয়া পারিবারিক অনুষ্ঠান, কালে তারও ঘটে সংস্কৃতায়ন। দিনটিকে চিহ্নিত করা হয় যম বা চিত্রগুপ্তর পূজার দিন হিসেবে। আর সেই সূত্রেই ব্রাহ্মণ পুরােহিতরাও যুক্ত হন এই অনুষ্ঠানে। এখন ফোঁটা দেওয়ার মন্ত্রটিরও দেখা দেয় সংস্কৃত রূপ। ছড়ার মূল ভাবটি বজায় রেখেই রচিত হয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রটি। সেই মন্ত্রটি হলাে—
“ভ্রাতস্তব ললাটে হি দদামি তিলকং শুভ।
অতঃপরং যমদ্বারে ময়া দত্তং হি কণ্টকম্।
একই ভাবে ভাইকে খাওয়ানাের জন্য পাটপাতা ভাজা-সহ যে ঘি-ভাত দেওয়া হয়, সেটি কোথাও কোথাও অমন্ত্রক আবার কোথাও বলা হয়, ‘ভ্রাতস্তবানুজাতহং ভুক্ষ ভক্তমিদং শুভং। প্রীতায় যম রাজস্য যমুনায়া বিশেষতঃ। দিদিরা “ভ্রাতস্তবানুজাতাহং’-এর পরিবর্তে ‘ভ্রাতস্তবাগ্রজাত’শব্দটি ব্যবহার করেন।
সম্পূর্ণ ভাবেই একটি পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও ভাইফোঁটার উৎস হিসেবে দুটি পৌরাণিক কাহিনির উল্লেখ করা হয়। একটি কাহিনির সঙ্গে যুক্ত মৃত্যুর দেবতা যম ও তাঁরই যমজ বােন যমুনা এবং
অন্যটিতে রয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর বােন সুভদ্রা। সূর্যের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বিশ্বকর্মার মেয়ে সংজ্ঞার। স্বামীর প্রচণ্ড তেজ ক্রমেই সংজ্ঞার পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠতে থাকে। সূর্যতেজে ঝলসে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দূরে দূরেই থাকতেন সংজ্ঞা। যমজ
সন্তান যম এবং যমুনার জন্মের পর তিনি আর থাকতে পারলেন না। নিজেরই অনুরূপ ছায়াকে সূর্যগৃহে রেখে আত্মগােপন করেন সংজ্ঞা। যাওয়ার আগে ছেলে-মেয়ে দুটিকে কোনােরকম অযত্ন না করার নির্দেশ দেন ছায়াকে। দিন যায়। ক্রমে বিমাতার রূপ নিতে থাকেন ছায়া। নির্যাতন করতে থাকেন যম-যমুনাকে। শেষে নিজের সন্তান জন্মাবার পর তিনি সূর্যকে দিয়ে বিতাড়িত করেন যম ও যমুনাকে। বিতাড়িত যম হন মৃত্যুর দেবতা- আর যমুনা ক্ষোভে দুঃখে নদী হয়ে বইতে থাকেন মর্তে। দিন যায়। বােনের জন্য মন কেমন করতে থাকে যমের। শেষে তিনি একদিন চলে আসেন যমুনার বাড়িতে। সেটা ছিল দেওয়ালির দুদিন পরের ঘটনা। দেওয়ালির জন্য ঘরদোর সাজানােই ছিল। ভাইকে পেয়ে আনন্দিত যমুনা তাকে বরণ করে কপালে টিকা পরিয়ে দেন মঙ্গল কামনা করে। খাওয়ান বেশ যত্ন করে। যমুনার এইভাবে বরণ ও ফোঁটা দেওয়ার ঘটনা থেকেই উদ্ভব হয় ভাই ফোঁটার— এমনই বলে থাকেন পৌরাণিকরা।
দ্বিতীয় কাহিনী, নরকাসুরকে বধ করার পর শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েন। মন ভালাে করার জন্য তিনি তাই তাঁর বােন সুভদ্রার বাড়িতে যান। বহুদিন পরে দাদাকে আসতে দেখে সুভদ্রা ভারী খুশি। তাড়াতাড়ি দাদাকে বরণ করে ঘরে নিয়ে আসেন। কপালে এঁকে দেন তিলক। কোনােরকম অমঙ্গল যাতে তাকে স্পর্শ করতে না পারে তারই জন্য দাদার কপালে ওই ফোঁটা দেন তিনি। তারপর দুজনে মিলে খাওয়া-দাওয়া এবং গল্পে মেতে ওঠেন। নরকাসুরকে হত্যা করে শ্রীকৃষ্ণের বােনের বাড়িতে আসার দিনটি ছিল কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া। শ্রীকৃষ্ণকে তার বােন সুভদ্রার এই ফোঁটা দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই চালু হয় এই ভ্রাতৃদ্বিতীয় বা ভাইফোঁটার অনুষ্ঠন।এই সংসারে ভাই-বােনের সম্পর্ক হলাে সবচেয়ে মধুর। সেই মধুরতার স্বাদ নিতেই আয়ােজন করা হয় ভাইফোঁটার। আর সে কারণেই কোনােরকম ধর্মীয় অনুষ্ঠান না করেও ভাইফোঁটার দিনটির জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে থাকেন সব ভাই ও বােন। শুধু আপন ভাই নয়, সমস্ত তুতাে-ভাই এমনকী পাড়াতুতাে ভাই-দাদাদের ফোঁটা দেন বােনেরা। আর এর মধ্যে দিয়েই বিশ্বভ্রাতৃত্ব এবং সৌভ্রাতৃত্বের এক সুমহান আদর্শ তুলে ধরা হয় সকলের সামনে। ভাইফোঁটা তাই সমাজ ও পারিবারিক জীবনের এক অতি স্মরণীয় ও বরণীয় দিন।
তরুনকান্তি