অযোধ্যায় (Ayodhya) রাম মন্দিরের (Ram temple) জন্য বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সংগ্রাম ১৯৮৩ সালে নয়‚ বরং তার ১৯ বছর আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রথম পর্যায়কালটি‚ অর্থাৎ ১৯৬৪ সালে তার প্রতিষ্ঠাবর্ষ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত সময়কাল দেখলে উপলব্ধি করা যায় যে এই বিশাল বিশ্বব্যাপী সাংগঠনিক কাঠামো ঠিক কিভাবে তৈরি হয়েছিলো।
- অরুন আনন্দ
অযোধ্যার রাম মন্দিরের ভূমি পুজো আসলে ছিলো বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) প্রায় ছয় দশকের প্রচেষ্টার ফলাফল।
১৯৮৩ সালে রামজন্মভূমি আন্দোলনের শুরু থেকেই সংগঠনটি এই আন্দোলনের অগ্রগণ্য সৈনিক ছিলো। কিন্তু অনেকেই যেটা জানেনা‚ যে এর ১৯ বছর আগে থেকেই তারা এই মন্দির প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি গণআন্দোলনের জন্য নীরব প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রথম পর্যায়কালটি‚ অর্থাৎ ১৯৬৪ সালে তার প্রতিষ্ঠাবর্ষ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত সময়কালটি দেখলে উপলব্ধি করা যায় যে এই বিশাল বিশ্বব্যাপী সাংগঠনিক কাঠামো ঠিক কিভাবে তৈরি হয়েছিলো। এই সাংগঠনিক কাঠামোই শেষ পর্যন্ত সাহায্য করেছিলো অযোধ্যার রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্যে অভূতপূর্ব গণআন্দোলনটি তৈরী করতে।
প্রতিষ্ঠা –
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মূল স্থপতি ছিলেন শিবশঙ্কর আপ্তে ওরফে দাদা সাহেব আপ্তে নামের একজন প্রবীণ আরএসএস প্রচারক। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল কারণ ছিলো দুটো –
১) ১৯৫৬ সালে নিয়োগী কমিটির রিপোর্ট‚ যাতে দেখা যায় যে মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদের মধ্যে খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা ধর্মান্তকরণের সংখ্যা বহুগুনে বেড়ে গেছে।
২) ১৯৫০-এর দশকে ভারত সফরে আসা ত্রিনিদাদের সাংসদ ড.শম্ভুনাথ কপিলদেওকে নেহেরু সরকারের তিরস্কার।
এই শম্ভুনাথ কপিলদেও চেষ্টা চালাচ্ছিলেন ত্রিনিদাদ ও ভারতের বাইরে বসবাসরত হিন্দুদের সাংস্কৃতিক পরিচয় শক্তিশালী করে তুলতে। কিন্তু তার এই প্রচেষ্টা নেহেরুকে ক্ষুদ্ধ করে তোলে ও তার সরকার শম্ভুনাথের প্রতি বিরুপ আচরণ করে।
তখন শম্ভুনাথ কপিলদেও দেখা করেন দ্বিতীয় আরএসএস সরসংঘচালক এম.এস. গোলওয়ালকারের সাথে। গোলওয়ালকারজীর সাথে তিনি কথা বলে নিজের উদ্বেগগুলি তুলে ধরেন। আরএসএস বুঝতে পেরেছিলো যে ভারতের বাইরে থাকা হিন্দুদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ধরে রাখতে চাইলে তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা প্রয়োজন।
আপ্তেকে একটি একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়‚ যার সাহায্যে ভারত ও ভারতের বাইরের হিন্দুধর্মাবলম্বী সমস্ত সম্প্রদায়কে একত্রিত করে‚ হিন্দু সমাজকে সামাজিক সংস্কারের এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় ও হিন্দুদের মধ্যে সচেতনতার বিস্তার ঘটে এবং সমাজের প্রান্তিক শ্রেনীগুলি বৈষম্যের শিকার হয়ে ধর্মান্তরিত হরে বাধ্য না হয়।
এই লক্ষ্যে আপ্তে নয় মাস ধরে বিস্তৃত সফর চালান, ২০০ জন ধর্মীয় নেতার সাথে যোগাযোগ করেন, তিন ডজনেরও বেশি দেশে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং বিভিন্ন বিশিষ্টব্যক্তিকে কমপক্ষে ১৫০টি চিঠি লেখেন।
ফলশ্রুতিতে মহারাষ্ট্রের মুম্বাইতে‚ স্বামী চিন্ময়ানন্দের সন্দীপনি আশ্রমে ১৫০ জন নেতৃত্বের উপস্থিতিতে ১৯৬৪ সালের আগস্ট মাসে শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমীর শুভ দিনে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। আপ্তে ও গোলওয়ালকার ছাড়াও এই সভায় উপস্থিত ছিলেন মাস্টার তারা সিং‚ জ্ঞানী ভূপিন্দর সিং( শিরোমণি আকালি দলের প্রেসিডেন্ট )‚ স্বামী শংকরানন্দ সরস্বতী এবং ড. কে.এম.মুন্সি। ৮ই জুলাই‚ ১৯৬৬ তে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ
আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত হয়। আপ্তে এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নিযুক্ত হন।
সংগঠনের বিস্তার ( ১৯৬৪-১৯৮৩)
প্রতিষ্ঠার পরে প্রথম দুই বছরের মধ্যেই, ভারতের কোনায় কোনায় ভিএইচপি ছড়িয়ে পড়ে। দিল্লি, কর্ণাটক, কেরল, রাজস্থান, বিহার, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব এবং আসাম সহ এক ডজনেরও বেশি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে প্রাদেশিক ইউনিট স্থাপন করা হয়।
মি. আপ্তে ১৯৭১‚ ১৯৭২‚ ১৯৭৫‚ ১৯৭৭ ও ১৯৭৯ সালে বিদেশের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সফর চালান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড, ত্রিনিদাদ, সুরিনাম, গায়না, পশ্চিম জার্মানি‚ নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, হংকং, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর এবং বেশিরভাগ দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশসহ ৩০ টিরও বেশি দেশে ভিএইচপির বিদেশী ইউনিট স্থাপন করেন।
এই সময়‚ ভিএইচপি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীকে নিয়ে কাজ করার জন্য তার বিভিন্ন শাখাও স্থাপন করে। এর মধ্যে রয়েছে নারী, মন্দির এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান‚ সমাজসেবা ও ধর্মীয় প্রধানদের জন্যে আলাদা আলাদা শাখা। এছাড়াও প্রতিষ্ঠা করা হয় হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে ধর্মপ্রসার বিভাগ নামে পরিচিত একটি শাখা।
কুম্ভ মেলা উপলক্ষে প্রয়াগরাজে দুটি বিশাল বিশ্ব হিন্দু সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রথমটি হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ২২-২৪ শে জানুয়ারী। আর দ্বিতীয়টি হয়েছিল ১৯৭৯ সালের ২৫-২৭শে জানুয়ারী। প্রথম সম্মেলনটিতে আমেরিকা এবং প্রধান প্রধান ইউরোপীয় ও দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলো থেকে ৭৫‚০০০ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান এই সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে একটি শুভেচ্ছাবার্তা প্রেরণ করেন। এই সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ও
ভারতীয় জন সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভাই শ্রী রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
দ্বিতীয় সম্মেলনে ভারত ও বিদেশ থেকে এক লাখেরও বেশি প্রতিনিধি অংশগ্রহণ নিয়েছিলেন। এটির উদ্বোধন করেছিলেন দলাই লামা। তিনি সেখানে বলেছিলেন “তিব্বতে যে বৌদ্ধধর্ম বিকশিত হয়েছিল, তা আসলে ছিলো ভগবান বুদ্ধের দ্বারা স্থাপিত একটি ভারতীয় ধর্ম।”
এদিকে, ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে বিদেশে‚ বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট আন্তর্জাতিক হিন্দু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ভিএইচপির কাজ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে এবং এর সাংগঠনিক নেটওয়ার্কের প্রসারণ ঘটাতে ১৯৬৫ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েক ডজন হিন্দু সম্মেলনের আয়োজন করেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের গুরুত্ব বুঝতে পেরে‚ ভিএইচপির প্রথম হিন্দু সম্মেলনটি ১৯৬৬ সালে গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত হয়। এটি হয়েছিলো মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন‚ ২রা অক্টোবরে। আর দক্ষিণের দিকে কর্ণাটকের উদুপিতে প্রথম এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়‚ ১৯৬৯ সালের ১৩-১৪ই ডিসেম্বর।
এদিকে, ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে রামজন্মভূমির জন্য বিভিন্ন ‘যাত্রা’ পরিচালনার অনেক আগেই, ১৯৮২ সালে কেরালায় “জ্ঞান রথম” এর দ্বারা পদ্ধতিটি পরীক্ষা করার মধ্যে দিয়ে ভিএইচপি যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করে। ১৯৮৩ সালে এই কেরালাতেই আবার অনুষ্ঠিত হয় ধর্মযাত্রা। আরো যেটা গুরুত্বপূর্ণ‚ ১৯৮৩ তে অনুষ্ঠিত হয় একাত্ম যাত্রা।
একাত্ম যাত্রার লক্ষ্য ছিলো ভারত মাতা (মাদার ইন্ডিয়া) এবং গঙ্গা মাতার (মা গঙ্গা) প্রতীকের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি। এই কার্যক্রমের অধীনে সারা দেশে প্রায় ৩১২ টির মতো ছোট ছোট যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৭.২ মিলিয়ন মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেন। ১.৫ লাখেরও বেশী ভিএইচপি কর্মী তাদের সংগঠিত করার জন্য সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। সব মিলিয়ে মোট ৮৫‚৮৭৪ কিলোমিটার পথ তারা পরিভ্রমণ করে।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পক্ষ থেকে তখন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং এর সাথেও সাক্ষাৎ করা হয়। তারা এই যাত্রার উদ্দেশ্য সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেন। মূলত এই কার্যক্রমের মাধ্যমেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নাম সাধারণ মানুষের মধ্য জনপ্রিয় হয়। তারা স্বাধীন ভারতের সবথেকে বড় আন্দোলনের জন্য তৈরী হয়ে ওঠে। আর সেই আন্দোলনের সাফল্য আসে এই বছরের ৫ই আগস্ট‚ রাম মন্দির নির্মাণ শুরুর মধ্যে দিয়ে।
(উপরে তথ্যগুলি ভিএইচপি আর্কাইভ থেকে নেওয়া হয়েছে)
(লেখক আরএসএসের সাথে জড়িত। তিনি আরএসএসকে নিয়ে দুটি বই এবং রাম মন্দির আন্দোলন সম্পর্কিত একটি বই লিখেছেন। এছাড়াও তিনি দিল্লি-ভিত্তিক চিন্তন শিবির বিচার বিনিময় কেন্দ্রের গবেষণা পরিচালক)