বাঙালির সকাল মানেই চায়ের দোসর পাউরুটি টোস্ট। অবিশ্যি আমাদের আবোল-তাবোলের স্রষ্টা সুকুমার রায় পাউরুটির সঙ্গে-সঙ্গে ঝোলা গুড়ও সাজেস্ট করেছিলেন। ওদিকে সেই ইংরেজি কেতার পেলিটি বা গ্রেট ইস্টার্ন সেকালে আর ক’জনের ঘরে ঢোকার সুযোগ পেত! চারুলতায় আমরা দেখেছি মন্দার বউঠানকে পেলিটির কেক খাওয়ানোর প্রস্তাব রেখেছেন তাঁর আদরের দেওর। কিন্তু রোজকার সকাল-বিকেল চায়ের আড্ডায় মাটির ভাঁড়ের সঙ্গে পেলিটি তো আর আসে না! সেখানে দরকার সস্তায় সুন্দর বিস্কুট আর রুটি। সেই ভাবনার পথ ধরেই এল নানারকম বেকারির বিস্কুট। সেই বেকারির সঙ্গত সব বাঙালির জীবনের আজও নিত্যদিনের সঙ্গী। শুধু কি তাই! সেই আগুন যুগের সময় স্বদেশি কালেও অবদান রাখল এই বেকারি কালচার। তাই সঙ্গেও জড়িয়ে আছে স্বদেশি আন্দোলনের দামামা। বিদেশিদের প্রিয় খাবার দেশীয় কায়দায় তৈরি করে দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়াই ছিল এক অন্যধরনের স্বদেশি আন্দোলন। আর সেই আন্দোলনে এগিয়ে আসেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের মন্ত্রশিষ্য শরৎচন্দ্র ঘোষ। প্রতিষ্ঠা করলেন দেশীয় বেকারি ‘আর্য বেকারি এ্যান্ড কনফেকশনারী’।
দেশজুড়ে তখন চলছে বিদেশি দ্রব্য বর্জন আর স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণের আন্দোলন। বিদেশি মিলের কাপড় ছেড়ে দলে দলে মানুষ গ্রহণ করছে খাদি কাপড়। এমনকি, ব্রিটিশ সিগারেটের বদলে শুরু হয়েছে দেশীয় বিড়ির প্রচলন। ঠাকুরবাড়ির উদ্যোগে তৈরি করা হয়ছে স্বদেশি ভাণ্ডার। যেখানে দেশীয় পোশাকের সঙ্গে একই ছাদের তলায় পাওয়া যাবে আলতা, সিঁদুর ইত্যাদি। এমতাবস্থায় নেতাজী ঘোষণা করলেন কলকাতায় আয়োজিত শীতকালীন জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-এর ঘোড়াসাওয়ার, মোটরসাইক্লিস্ট, সাইক্লিস্ট এবং পদাতিক বাহিনীর ছেলেমেয়েদের দেওয়া হবে স্বদেশি বেকারির পাউরুটি, কেক-পেস্ট্রি। ডাক পড়ল আর্য বেকারি অ্যান্ড কনফেকশানারী-র উত্তরাধিকারী সুধাংশুকুমার ঘোষের। শুধু খাবারই নয়, থাকবে স্বদেশি পোশাক, খাবার ও নানা স্বদেশি উপাদানের প্রদর্শনীও। সেখানেও স্টল লাগল আর্য বেকারির। বেকারির খাদ্যদ্রব্য ভূয়সী প্রশংসা পেল। নেতাজি ও বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স এর তরফ থেকে দেওয়া হল শংসাপত্র। তাতে লেখা হল “I am glad to certify…” S. C. Bose, G. O. C, Bengal Volunteers. এখানেই সীমিত রইল না। কলকাতা ও দমদমের জেলে বন্দি স্বদেশিরাও দাবি তুললেন, তাঁরা আর্য বেকারির পাউরুটি ও কে সি বোসের বার্লি ছাড়া আহার গ্রহণ করবেন না। ব্রিটিশ সরকারও নতি স্বীকার করলেন এবং ডাক দিলেন সুধাংশুচন্দ্র ঘোষকে। স্বদেশি আন্দোলনের উন্মাদনায় হু হু করে বিক্রি হতে লাগল আর্য বেকারির পাউরুটি, কেক, পেস্ট্রি
।
আর্য বেকারির প্রতিষ্ঠাতা শরৎচন্দ্র ঘোষ ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের শিষ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশ স্বাধীন করার জন্য আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে হবে দেশীয় ব্যবসা। তিনি বেকারি শিল্প সম্পর্কে দেশবাসীকে জানাতে একটি বই লেখেন – ‘পাশ্চাত্য পাকপ্রণালী ও বেকারী দর্পণ’। এই বইয়ে তিনি বেকারি সম্পর্কে নানা তথ্য দেন। তিনি বলেন, ‘যদি পাউরুটি তৈরি করার জন্য ইস্ট ও হপস না পাওয়া যায় তাহলে খাঁটি স্বদেশি তাড়িও ব্যবহার করা যেতে পারে।’ এরপর তিনি বেকারি শিল্প নিয়ে শুরু করেন নিজস্ব বেকারি ব্যবস্থা। নিজের বাড়িতে চার আনা ময়দা এনে পরীক্ষামূলক ভাবে তৈরি করেন পাউরুটি। সফল পরীক্ষার পর নিজের বাড়িতেই একটি জার্মানি ‘হাবাম্ফা’ মিক্সিং মেশিন এবং দুটো ছোট ছোট ফায়ারব্রিকের তৈরি তন্দুর নিয়ে শুরু করেন বেকারি ব্যবসা।
শরৎচন্দ্র এই ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্ব দেন বড় ছেলে সুধাংশুচন্দ্র ঘোষের উপর। দেশীয় বেকারির কথা দেশবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শুরু হয় ব্যান্ডপার্টি নিয়ে হ্যান্ডবিল বিলি করে প্রচার। এখানেই থেমে না থেকেও শরৎচন্দ্র দেশবাসীকে স্বনির্ভর করার জন্য চক্রবেড়িয়ায় ১৯৩৪ সালে একটি ‘মিক্সার’ ও দু্টি তন্দুর নিয়ে তৈরি করলেন ‘বেকারি ট্রেনিং কলেজ’। বাকিটা ইতিহাস…