দেবী দুর্গা শাক্ত মার্গের সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবী, বৈষ্ণব মার্গে তাঁকে ভগবান বিষ্ণুর অনন্ত মায়া হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয় এবং শৈব মার্গে দুর্গাকে শিবের শক্তি পার্বতী হিসাবে অর্চনা করা হয়। বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনিই কেনোপনিষদে বর্ণিত হৈমাবত দুর্গা হিসাবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে; ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের যোগমায়াকে দুর্গা আখ্যা দেওয়া হয়েছে যিনি হরি সহায়িনী তথা হরিভক্তিপ্রদায়িনী। এইসমূহ ছাড়াও দুর্গাদেবীর বর্ণনা মহাভারতের বিরাট পর্ব ও অন্যান্য পুরাণে পাওয়া যায়। 

প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা।

বৃন্দাবনে চ সৃষ্ট্যাদ্যৌ গোলকে রাগমণ্ডলে।

মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মণা সা দ্বিতীয়তঃ।

ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা।।

ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেন শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা চ।

তুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী।।

তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দ্রৈর্দেবৈশ্চ মুনিমানবৈঃ।

পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভূব সর্ব্বতঃ সদা।।

কোথাও তিনি প্রস্তর খোদিত মূর্তি, ধাতুনির্মিত কাষ্ঠ নির্মিত বা কেবলমাত্র বৃক্ষে , শিলায় উপাসিতা হন। তাঁর পূজাকে ঘিরে নানান অনুষঙ্গের অভাব নেই। তিনি অলৌকিক থেকে লৌকিকে এসেছেন , মানুষের বিশ্বাসে মিশে জেগে আছে তাঁর অপার মাতৃমহিমা। এই পর্যায়ে এক ব্যতিক্রমী দেবী আদ্যাশক্তির রূপ বনদুর্গা প্রসঙ্গ নিয়ে এই আলোচনার অবতারণা। লৌকিক রূপে জনপ্রিয় দেবীচণ্ডী নির্ভয়পুর অঞ্চলে কিয়াসিনী নামে উপাসিতা হন। দেবীর অভিজাত নাম #কিরাতবেশিনী_দেবী।  নানা কিংবদন্তি, জনশ্রুতির রহস্যে , বিশ্বাসের মায়ায় ও লোকসংস্কৃতির স্বতন্ত্র ক্রিয়ার এই দেবী রাঢ় অঞ্চলের লোকদেবীর ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ।

কিয়াসিনীদেবী নিয়ে যেমন লোকশ্রুতি আছে , তেমন তাঁর পূজা নিয়েও এই অঞ্চলে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। জনশ্রুতি আছে যে , পূজারী সমস্ত পূজার সামগ্রী নিয়ে জলে ডুব দিতেন। কাঁসাইয়ের স্রোতের  নীচে কোথাও একটি গুহা আছে। সেই গুহা পর্যন্ত পথ একটি মাছ দেখিয়ে নিয়ে যেতেন। গুহার ভিতরে কোনো জল থাকত না। গুহার অভ্যন্তর ছিল রাঢ়বঙ্গের মাটির মতোই রুক্ষ শুষ্ক। সেখানে দেবী স্বর্ণময়ী চরণ যুগল রূপে অবস্থান করতেন। পূজারী সেখানে বসে দেবীর পূজা করে পুনরায় মাছের দেখানো পথে ফিরে আসতেন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, দেবীর পূজায় শস্ত্র প্রদর্শন একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার ছিল। কোনো কারণে একবার পূজারী একটি তরবারী দেবীর গুহায় ফেলে আসেন। পরে সেটি সংগ্রহের জন্য পূজারী পুনশ্চঃ পূজা স্থলে ফিরে যান। শোনা যায়, সেই সময় নাকি দেবী প্রসাদ ভক্ষণ করছিলেন।

পূজারী অবাক হয়ে দেবীকে দেখতে লাগলেন। শ্যামবর্ণাদেবীর তেজে গুহা আলোকিত হয়ে আছে। দেবী তরবারীটি নিয়ে জলের উপর ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, ” যাও বাবা, তোমাদের আর এত নীচে এসে পুজো করতে হবে না। এই তরবারী যেখানে পড়বে সেই থানকেই আমায় উৎসর্গ করে পূজা করবে।” দেবীর ছোঁড়া তলোয়ার গিয়ে পড়ল নদীর দক্ষিণ কিনারে। সেই থেকে আজও ওই দক্ষিণ কিনারে দেবী পূজিতা হন। কিয়াসিনী দেবীর নাম অনুসারে এখানে একটি শবর পল্লী গড়ে উঠেছে। সেই পল্লীর নাম #কিয়াইচকা এবং নদীর ঘাটের নাম কিয়াসিনীর ঘাট।

দেবীর পূজারী হবার অধিকার কেবলমাত্র সিংহ মুণ্ডা বংশের ( পরে পাতর উপাধি) প্রথম পুত্রদের থাকত। যেমন – ধর্মনারায়ণ সিংহের প্রথম পুত্র ধর্মনারায়ণ, ধর্মনারায়ণের প্রথম পুত্র সায়ম্ভ , তাঁর প্রথম পুত্র আদিত্যনারায়ণ , তাঁর প্রথম পুত্র বিশ্বম্ভর। এইভাবে দিগম্বর, সিংহদেব সারজু, বাঘরাই সিংহ। সিংহ মুণ্ডা বংশে তথা রাঢ়বঙ্গের ইতিহাসে এই বাঘরাই সিংহের নাম স্বর্ণাক্ষরে খচিত আছে। বাঘরাই একজন সুপুরুষ , বুদ্ধিমান , রাজনৈতিক বিচক্ষণ ব্যক্তিই ছিলেন না, তিনি একজন বীর যোদ্ধাও ছিলেন। লাউসেন, কালুরায় প্রমুখ নামের সঙ্গে বাঘরাই সিংহের নাম উচ্চারিত হয়। লোকে বলে বাঘরাই নাকি বাঘের মতো বিশাল এবং শক্তিশালী ছিলেন। 

বাঘরাই সিংহের সময়ে পঞ্চকোট রাজদরবার হতে রাজ কর্মচারীরা কৈড়া গ্রামে এসেছিলেন। তিনি বাঘরাই সিংহকে দেখে এবং তাঁর বীরত্বের কথা শুনে রাজকর্মচারী বিস্মিত হন। তাঁরাই পঞ্চকোটে ফিরে গিয়ে খবর দিলেন , বীর বাঘরাই সম্পর্কে। রাজা নিজে সুসজ্জিত ঘোড়া পাঠিয়ে বাঘরাই সিংহকে পঞ্চকোট রাজদরবারে ডেকে পাঠালেন। 

ঘোড়ায় চেপে বাঘরাই সিংহ মুণ্ডা যখন রাজদরবারে উপস্থিত হলেন তাঁকে ডেকে দরবারের সকলে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। রাজা বাঘরাই সিংহ মুণ্ডাকে রাজকার্য পরিচালনার জন্য প্রধান সহচর হিসাবে রাখেন এবং পরে সৈন্যাধক্ষের পদে নিযুক্ত করেন। 

কোনো এক প্রবল ঝড়বৃষ্টি দুর্যোগের রাত্রিতে বাঘরাই সহ আরও কিছু যোদ্ধা রাজপ্রাসাদের দ্বার রক্ষার কর্মে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু প্রবল দুর্যোগের মুখে কোনো প্রহরী, কোনো যোদ্ধা টিকে থাকতে পারলেন না। একমাত্র বাঘরাই সারা প্রাসাদ বেষ্টনী ঘুরে ঘুরে প্রাসাদ রক্ষা করে রাখলেন। পরের প্রভাতে রাজা ঘুম থেকে উঠে দেখলেন ঝড়ের প্রলয়ঙ্করী তাণ্ডবে চারিদিক বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। তখনও প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে এবং তার মধ্যে বাঘরাই তরবারী মুষ্টিতে শক্ত করে ধরে প্রাসাদ পাহাড়া দিচ্ছেন। রাজা জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলেন, বাঘরাই ব্যতীত সেই রাত্রে অন্যকেউ দুর্যোগের সমানে দাঁড়াতে পারেনি। 

রাজা বাঘরাই সিংহকে ডেকে পাঠালেন। ভরা সভায় পঞ্চকোট রাজা বাঘরাই সিংহ মুণ্ডাকে রাজপুরীর রক্ষার একমাত্র পাত্র বলে সম্বোধন করে #পাত্র উপাধি দান করলেন। কিন্তু গাঁ ঘরে , লোকমুখে সেই পাত্র উপাধি উচ্চারণ বিকৃত হয়ে পাত্তর হল। পরে তাও পরিবর্তন হয়ে পাত্তর থেকে হল পাতর। এরপর থেকে সিংহ মুণ্ডা বংশ কেবলমাত্র সিংহ পাত্তর বা সিং পাতর উপাধি ব্যবহার করতে শুরু করেন। আমার রচনার তথ্যসূত্র এই সিংহ মুণ্ডা বংশের বংশধর শ্রী মোহন সিং পাতরের রচনা হতে গৃহীত হয়েছে। উনি দেবী কিয়াসিনীর পূজারীও বটে। 

বাঘরাই সিংহের নানা গুণের কথা রাজবাড়ীর অন্দরে গিয়ে পৌঁছল। পঞ্চকোটের রাণী বাঘরাই সিংহের গুণমুগ্ধ হয়ে উঠলেন। পরিচারিকাগণের নিকট তিনি জানতে পারলেন বাঘরাই একজন রূপবান বা যোদ্ধা ব্যক্তি নন , তিনি মহামায়া কিয়াসিনীর পূজারী। তাঁর নানা দৈব গুণ আছে। রাণী বাঘরাই সিংহকে দর্শনের নিমিত্ত উতলা হয়ে উঠলেন। বাঘরাই এই সংবাদ পেয়ে প্রশ্ন করে পাঠালেন , ” তিনি আমাকে কিরূপে দেখতে চান? আমি তাঁকে মারূপে সম্মান করি এবং মা বলে ডাকি। আমি আমার বীর্য , রূপ, বুদ্ধি দেখানোর জন্য নির্লজ্জ্ব ভাবে রাজবাড়ীর অন্দরে প্রবেশ করব না। এতে আমার দৈব গুণ নষ্ট হবে। ” রাণী শুনে বললেন, ” গিয়ে বল , আমি বাঘরাইকে আমার পুত্ররূপে দেখতে চাই। তিনি যেন আমার ঠাকুরঘরে এসে দেখা দেন। “

বাঘরাই সিংহের নিকট পুনরায় দাসী সংবাদ নিয়ে গেল। বাঘরাই শুনে রাণীর সঙ্গে দেখা করতে রাজী হলেন। কিন্তু পঞ্চকোট রাজার অনুমতি ব্যতীতই উনি রাজঅন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। রাজগৃহের ঠাকুর ঘরে রাণীর সঙ্গে বাঘরাই সাক্ষাৎ করলেন। রাণীর বাঘরাইকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করতে গেলে বাঘরাই রাণীকে মা বলে ডেকে উঠলেন। বাঘরাই সিংহের মার্জিত সুন্দর স্বভাব, জ্ঞান, বুদ্ধিতে রাণী মুগ্ধ হয়ে বললেন, ” পরের জন্মে তুমি আমার সন্তান রূপে এস।” 

এদিকে রাজার নিকট খবর গেল যে , বাঘরাই সিংহের এত সাহস যে বিনা অনুমতিতে রাজ অন্তঃপুরে প্রবেশ করে রাজরাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন দীর্ঘ সময় ধরে। হয়তো বাঘরাইয়ের প্রতি রাজার অনুগ্রহে ক্ষুব্ধ কোনো রাজকর্মচারী রাজার কাছে বিষয়টি নোংরাভাবে উত্থাপন করেছিল। ফলে, রাজামশাই অতিশয় এতে রেগে গেলেন এবং বললেনযে “বাঘরাই সিংহকে আমি নিজের হাতে গুলি করে মারব”। বাঘরাই সিংহের অনুপস্থিতিতেই বাঘরাইয়ের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হল।  

মৃত্যুদণ্ডের সংবাদ বাঘরাইয়ের কানে পৌঁছল। তিনি রাজদরবারে মাথা উঁচু করে প্রবেশ করে বললেন, ” ঠিক আছে। আপনি কাশীপুর পঞ্চকোট মহারাজ। আপনার পদতলে সকল মালভূমি অঞ্চলের রাজারা অবস্থান করেন। আপনার দণ্ড আমার শিরোধার্য। আপনি আমাকে গুলি করবেন। তবে আজ নয় , কাল। মৃত্যুর পূর্বে আমি আমার বংশের কুলদেবতা ব্যাঁইড়া এবং কুলদেবী কিয়াসিনীর পুজো করতে চাই। তারপর আমি শেষ বারের জন্য একটি খেলা খেলব। সেই খেলা খেলার সময় রাজা আমাকে গুলি করবেন।….” 

তারপর কি হল? কি খেলা খেললেন বাঘরাই? রাজার দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কি কার্যকর হল? 

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যসূত্র – শ্রী মোহন সিং পাতর , কৈড়া – পুঞ্চা এবং ব্যাঁড়ার থান ও কিয়াসিনী পূজারী বংশধরগণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.