নির্ভয়পুরের কথা – তৃতীয় পর্ব

পূর্বেই বলেছিলাম মাতা শক্তিশ্বরী সকল কিছু হারিয়েছিলেন ,কিন্তু ধর্মকে ত্যাগ করেন নি। সপ্তপুত্র এবং কুলদেবতা ও দেবীকে সঙ্গে করে পিতার গৃহত্যাগ করে এসেছিলেন। নির্ভয়পুরে যখন নতুন বাস শুরু করলেন তখন সেখানেই তাঁদের পূজার্চনা করতেন। কৈড়াতে আপন রাজ্য স্থাপনের পর দেব, দেবীকে নির্ভয়পুর থেকে মূল বাটীর সামনে আনার জন্য একদিন প্রভাতে কাঁসাই নদীর স্রোতে স্নান সম্পন্ন করে মাতা শক্তিশ্বরী তাঁদের আনতে যাবার মানস করলেন, সঙ্গে ছিলেন সপ্তভ্রাতা। 

কিংবদন্তি আছে , সকলে কাঁসাইয়ের স্রোতে স্নান করে উঠে দেখলেন নদীর তীরে বনের ধারে এক কালোকোলো অপূর্ব সুন্দরী ষোড়শী দণ্ডায়মান হয়েছেন। তাঁর চারিপাশে বনের যত শ্বাপদ, নিরীহ পশু, পক্ষী , পতঙ্গ, সরীসৃপ ঘিরে আনন্দ নৃত্য জুড়েছে। সেই ষোড়শীর বামহস্তে তীরধনুক, ডানহস্তে পশু ,পক্ষীদের আদর করে দিচ্ছেন। কখনো নিজেও আনন্দ নৃত্যে সামিল হচ্ছেন। ষোড়শীর মাথায় বনফুল, পলাশ , শিমুলের বেড়া। হাতে গলায় কানে বুনো ফুল, লাল, হলুদ, সাদা পলাশ, শিমুলের অলঙ্কার সুশোভিত হয়ে বনপ্রান্ত রাঙিয়ে তুলেছে। পায়ে পলাশ, শিমুল, কুন্দের বেড় নৃত্যের তালে তালে কম্পিত হয়ে উঠছে। শিকারিনী ষোড়শী ঝনকঝঙ্কারে হেসে হেসে  বৃক্ষ, পুষ্প, পত্র, জীব, জন্তুর সঙ্গে কথা বলছেন।

এমন দৃশ্য দেখে বড় ভ্রাতা সরযু বললেন, ” মাতা, দেখ দেখি… এই ভোর সক্কালে এমন নির্জন ঘন জঙ্গলে একটি ছোট্ট মেয়ে খেলা করছে, গান করছে। ভয়ডর নেই। এ কাদের মেয়ে? জানতে হবে।”

সিক্ত বস্ত্রে গিয়ে সরযু সিংহ মুণ্ডা ষোড়শীকে প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করলেন , ” মা গো, কে তুমি ? এমন গভীর জঙ্গলে এমন শিকারিনী বেশে সকলের সাথে খেলা করছ। ” ষোড়শী ক্রমশঃ জ্যোতির্ময়ী দশভুজা মহামায়ার রূপ ধারণ করলেন। বললেন, ” তোমরা আমাকে চিনতে পারলে না বাবারা? আমিই যে তোমাদের উপাস্য কুলদেবী। আমার প্রসাদে তোমাদের মাতা শক্তিশ্বরীর জন্ম। আমি এই জলে, জঙ্গলে, মেঘে, সূর্যের রশ্মিতে থাকি। আজ আমার বড় কিরাত বেশ ধারণ করে বনে খেলা করতে ইচ্ছে করছিল। তাই খেল ছিলাম। ” সরযু মাকে বললেন, ” দেখা যখন দিয়েছ ,আর তোমাকেই যখন আনতে যাচ্ছিলাম , তবে চল আমাদের গৃহে চল। সেখানে তোমার রোজ ভোগারতি দেব। ”  দেবী বললেন, ” আমিই বনদেবী। আমিই কুষ্মান্ডা। আমিই কোটি ব্রহ্মাণ্ডের মাতা। আমাকে গৃহে বেঁধে রেখ না। আমাকে এই প্রকৃতির মধ্যেই উপাসনা কর। যেমন তোমার পূর্বমাতৃকুল পূর্ব পূর্ব সময় করে এসেছিলেন।  আমি এই কাঁসাইয়ের স্রোতের নীচে প্রস্তরে অবস্থান করব। তোমরা এখানেই আমাকে উপাসনা করবে। “

মাতা শক্তিশ্বরী ও তাঁর সপ্তপুত্র ভক্তভরে কাঁসাইয়ে তীরে দেবীর পূজা করলেন বনের পুষ্প, পত্র, ফল ও কাঁসাইয়ের জল দিয়ে। প্রতি বৎসর পূজা হতে লাগল। কাঁসাইয়ের স্রোত বড় হতে লাগল। কিরাতবেশিনী দেবীর নাম গাঁ ঘরের উচ্চারণে #কিয়াসিনী হল। এখনও দেবী কিয়াসিনী নামেই পূজিতা হন। এরপর সপ্ত ভ্রাতা ও মাতা শক্তিশ্বরী কুলদেবতা ব্যাঁইড়াকে আনতে গেলেন ,তখন তিনিও বললেন , ” দেবী মহামায়া বনদুর্গা রূপে যেখানে অবস্থান করবেন আমিও সেই প্রকৃতির মাঝে অবস্থান করব। আমি লোকালয়ে যাব না।” তিনিও রয়ে গেলেন প্রকৃতির মাঝে, বৃক্ষের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে মিশে। 

প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, ব্রহ্মার মানসপুত্র বশিষ্টদেব সাধন ক্রিয়ার জন্য কামরূপে পাড়ি দেন কিন্তু কামরূপের সাধনার মার্গফল করা সম্ভব নয় দেখে তিনি অঙ্গদেশ ত্যাগ করেন। এরপর তিনি সাধন পদ্ধতির জন্য রাঢ় বাংলায় পাড়ি দেন। রাঢ়দেশে অন্তর্গত বক্রেশ্বরের ঈশান কোন অবস্থিত দ্বারকা নদীর পূর্ব তীরে শ্মশানে প্রতিষ্ঠিত এক পঞ্চমুন্ডির আসনে তিনি গভীর তপস্যায় বসেন এবং সিদ্ধিলাভ করেন। তিনি দেবী উগ্রতাঁরার মাতৃরূপ দর্শন করেন। পরে একই আসনে সিদ্ধিলাভ করেন সাধক বামাক্ষ্যাপা । সেই সিদ্ধস্থানই তারাপীঠ এবং কিরীটেশ্বরী নামে সুপরিচিত। 

আদিদেব পশুপতি শিবের উপাসনা হত এই প্রাচীন বঙ্গে। বৌদ্ধ জাতকের গল্পে বর্ধমান এবং মেদিনীপুর অঞ্চলে শিবি এবং চেত নামক দুই রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। এই দুই রাষ্ট্রেই শিবপূজার প্রচলনের কথা জানা যায়। এই সব পূজাই হতো প্রাচীন বৃক্ষতলে। রামায়ণ , মহাভারত , পুরানাদিতে , তন্ত্রে নানাভাবে বঙ্গ সহ তার নানা স্থানের উল্লেখ আছে।  রাঢ় অঞ্চলের নানা স্থানে ত্রিকালজ্ঞ মুনি ঋষিদের আশ্রম ছিল এরূপ প্রবাদ আছে। জলন্দার গড়ের কিছু দূরে আঙ্গোরা নামক স্থানের ঋষি অঙ্গীরার আশ্রম ছিল। মুলুকের নিকটবর্তী শিয়ান গ্রামে ঋষ‍্য‍শৃঙ্গ মুনির আশ্রম ছিল । মুলুকের অনতি উত্তরে ঋষ‍্যশৃঙ্গের পিতা বিভান্ডকের আশ্রম ছিল বলে কিংবদন্তি আছে আর বক্রেশ্বরে ছিল ঋষি অষ্টবক্রার আশ্রম। 

রাঢ় দেশ একসময় শৈব এবং শাক্ত গণের লীলাস্থান বলে গণ্য ছিল। তার কারণ ৫১ পীঠের মধ্যে এই রাঢ় বঙ্গেই ৯ টি ডাকর্ণব পীঠ অবস্থিত। কুঞ্জিকাতন্ত্রের ৭ ম পটলে কর্ণসুবর্ণ বা কর্ণস্বর্ণ ,ক্ষীরগ্রাম , বৈদ্যনাথ , বিল্বক , কিরীট , অশ্বপ্রদ বা  অশ্বতীর্থ , মঙ্গলকোট ও অট্টহাস এই আটটি সুপ্রাচীন সিদ্ধপীঠের উল্লেখ আছে।

তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থে বহুলা, উজাণী, ক্ষীরখণ্ড , কিরীট, নলহাটী , বক্রেশ্বর , অট্টহাস, মন্দিপুর এই ৯ টিকে মহাপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।  শিব চরিত সংগ্রহ গ্রন্থে অট্টহাস, নলহাটী ও মন্দিপুর উপপীঠ বলে গণ্য হয় এবং সুগন্ধা , রণখণ্ড ও বক্রনাথ মহাপীঠ বলে গণ্য হয়। যা হোক এসব ক্ষেত্রে কুঞ্জিকাতন্ত্রকেই প্রামাণ্য হিসাবে ধরা হয়। সুপ্রাচীন কাল থেকে রামায়ণ , মহাভারত , পুরণাদি এবং মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যগুলির দিগবন্দনায় নানা দেবদেবীর বন্দনা থাকে। এর মধ্যে কোনো দেবী বা দেবতা লৌকিক নামে, লৌকিক ভাবে এবং লৌকিক রূপে পূজিত হলেও তাঁদের উল্লেখ ও বন্দনা লেখা থাকে। দুর্গাপুজো বিষয়ক নানা পুঁথি, গ্রন্থেও গ্রাম, লৌকিক, আঞ্চলিক এবং দেশবাসিনী দেবীদের কথা উল্লিখিত হয়েছে। 

মহাষ্টমী বা মহানবমীর পুজোর সময় সর্তোভদ্র মণ্ডলের পুজোর পরে আঞ্চলিক, লৌকিক, কুলদেবী এবং দেশবাসিনী দেবীদের পূজার বিধান আছে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি দেশবাসিনী দেবী বলতে অখণ্ড এবং বৃহত্তর ভারতবর্ষের প্রাচীন পীঠস্থানগুলির শাক্তদেবীদের বোঝানো হয়েছে।  এসকল দেবীদের মধ্যে অখণ্ড বঙ্গের কয়েকটি প্রাচীন পীঠস্থানের নাম উল্লেখ হয়েছে।  যার মধ্যে শ্ৰীহট্ট, রাঢ়বঙ্গ, পুন্ড্রবর্ধন , গোকর্ণ এবং খণ্ডপুর বা শ্ৰীখণ্ডের নাম উল্লিখিত হয়েছে।

অজয়- কুনুর তীরবর্তী উজানি মঙ্গলকোটের #চন্ডী_সংস্কৃতি_ও_তন্ত্র_মার্গের প্রবাহ সমগ্র রাঢ় বঙ্গকে প্রভাবিত করেছিল । কেতু রাজবংশের রাজধানী #বহুলানগর তথা আজকের কেতুগ্রামের সতীর যুগ্ম পীঠ যথা – বহুলাক্ষী ও ফুল্লরা শাক্তধর্মের এক বিরল তীর্থস্থান ।কাটোয়ার শাঁখাই ঘাট থেকে দাঁইহাট  ভাউসিং পর্যন্ত ভাগীরথীর পশ্চিম তীর বরাবর প্রসারিত ইন্দ্র, ইন্দ্রেশ্বর ও ইন্দ্রানীকে নিয়ে একদা গড়ে উঠেছিল এক সর্বভারতীয় তীর্থনগরী #ইন্দ্রানী…এর প্রাণকেন্দ্র ছিল বর্তমান বিকিহাট, বেড়া ও দাঁইহাট।

আরো কত শত শাক্তস্থান আছে, তা এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে তার উল্লেখ সম্ভব নয় । এইরূপ যে সকল শৈব কীর্তি আছে তন্মধ্যে বৈদ্যনাথ এবং বক্রেশ্বর সর্ব প্রাচীন ও প্রধান। 

সেই কারণেই রাঢ়বঙ্গে লৌকিকভাবে নানা স্থানে সিনি দেবীর উপাসনা দেখতে পাবেন। সিনি দেবীরা মহামায়ারই নানারূপ, এবং লৌকিকভাবে পূজিতা হন। যেমন – দুয়ারসিনি, পাহাড়সিনি ইত্যাদি। আরণ্যক মানুষজন – হো , মুণ্ডা, বাগদী, সাঁওতাল সিনি শব্দটি দেবী অর্থে ব্যবহার করেন। সিনিদেবীরা গ্রামের কুলদেবী হিসাবে অবস্থান করেন। গ্রামদেবতা, দেবী বা গরামকে কেন্দ্র প্রতিবৎসর একবার কি দুবার বাৎসরিক পূজা , উৎসব পালিত হয় প্রতি গ্রাম বা অঞ্চল ভিত্তিতে। 

কেবলমাত্র আরণ্যক মানুষজন নয়, রাজপুত সামন্ত নৃপতিরাও সিনি পুজো করে থাকেন। অন্যান্য লৌকিক দেবতাদের তুলনায় পল্লি সমাজের মধ্যে সিনি দেবতা অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন। ভক্তদের বিশ্বাস সিনি দেবী শস্যদাত্রী, তিনি গ্রাম রক্ষা করেন। তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই যেকোন রকম বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব। শস্য বা কৃষি দেবী রূপে, মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায়, বৃষ্টির আশায়, দুর্ভিক্ষ নিবারণ, হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে রক্ষা, গ্রামের সার্বিক কল্যাণ ইত্যাদি নানা আকাঙ্খায় সিনি দেবী পুজো করা হয়। অধিকাংশ সিনি পুজোর স্থান থান গাছতলা,নদীর পাড়, খোলা প্রকৃতি, পাহাড়ের কোল। 

রাঢ়বঙ্গের জেলাগুলিতে সিনি অন্তে বহু গ্রামের নাম রয়েছে। যেমন – পুরুলিয়ার দুয়ারসিনি। গাছতলাতে, পাহাড়ের কোলে ‘সিনি’ মায়ের স্থান। সিনি দেবী বনদুর্গা। তিনি কুষ্মান্ডা। তিনি প্রকৃতি মাতা। 

ব্রহ্ম বিষ্ণু শিবাদীনা মহমাদ্যাপরাৎপরা ।

সগুণা নির্গুণাচাপি বরা স্বেচ্ছাময়ী সদা।। 

নিত্যানিত্যা সর্ব্বরূপা সর্বকারণ কারণা । 

বীজরূপাচ সৰ্ব্বের্ষাং মূলপ্রকৃতিরীশ্বরী॥ 

পুণ্যে বৃন্দাবনে রম্যে গোলোকে রাসমণ্ডলে । 

রাধা প্রণাধিকাহঞ্চ কৃষ্ণস্য পরমাত্মনঃ॥

 অহং দুর্গা বিষ্ণুমায়া বুদ্ধ্যধিষ্ঠাতৃদেবতা । অহং লক্ষ্মীশ্চ বৈকুণ্ঠে স্বয়ং দেবী সরস্বতী॥

সাবিত্রী বেদমাতাহং ব্রহ্মাণী ব্ৰহ্মলোকতঃ । অহং গঙ্গা চ তুলসী সৰ্ব্বাধারা বসুন্ধরা ॥

অর্থাৎ – রাজা সুরথকে মহেশ্বরী ৺দুর্গাদেবী বললেন , তুমি আমাকে বিষ্ণু, শিবাদির আদ্যা, পরাৎপরা, নির্গুণা, সদা স্বেচ্ছায়ী ও পরমাপ্রকৃতি বলিয়া জানিবে, কেবল কার্য্যকালে আমি সগুণা হইয়া মূৰ্ত্তি ধারণ করিয়া থাকি৷ জ্ঞানিগণ আমাকে নিত্যা অথচ অনিত্যা, সর্ব্বরূপা, সর্ব্বকারণের কারণ, সকলের বীজরূপা মূলপ্রকৃতি ও ঈশ্বরী নামে কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। গোলোকধাম মধ্যগত পবিত্র বৃন্দাবনে রমণীয় রাসমণ্ডলে আমিই পরমাত্মা কৃষ্ণের প্রাণাধিকা শ্রীমতী রাধিকারূপে অধিষ্ঠিতা আছি। আমি দুর্গা, বিষ্ণুমায়া ও বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রীদেবী, সরস্বতীদেবী আমা হইতে ভিন্ন নহে, বৈকুণ্ঠে আমিই লক্ষ্মীরূপে বিরাজমান রহিয়াছি। আমি ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মাণী ও বেদমাতা সাবিত্রীরূপে অবস্থান করি, গঙ্গা, তুলসী ও সর্ব্বোধারণকারিণী বসুন্ধরা (পৃথিবী) আমারই রূপভেদ মাত্র।

আচ্ছা এই সিংহ মুণ্ডাদের কুলদেবী কিয়াসিনীর কিভাবে পূজা হতো? আরও কি কিংবদন্তি ঘুরে বেড়ায় নির্ভয়পুর, কৈড়া র বাতাসে? 

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যসূত্র – শ্রী মোহন সিং পাতর , কৈড়া – পুঞ্চা এবং ব্যাঁড়ার থান ও কিয়াসিনী পূজারী বংশধরগণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.