জ্ঞানভূমি, কর্মভূমি,পুণ্যভূমি ও মোক্ষভূমি আমাদের এই ভারতবর্ষ।ভারতবর্ষ আমাদের মাতৃ স্বরূপা, বন্দনীয়। ভারতের প্রাচীনত্ব এবং প্রতিভা সর্বজনবিদিত। প্রাচীন বৈদিক প্রতিভা, আধ্যাত্বিক প্রতিভা,বিদ্যা প্রতিভা, সামরিক প্রতিভা, রাজনৈতিক প্রতিভা, বিজ্ঞান প্রতিভা,চিকিৎসা প্রতিভা, প্রযুক্তি প্রতিভা প্রভৃতি এক অতুলনীয় সম্পদ। এত বিশালতা ও প্রতিভা সত্বেও ভারতবর্ষ কোন দিন অন্য কোন জাতি বা রাজ্যকে আক্রমণ করেনি।দীর্ঘ ইতিহাসে কোথাও এমন কোনো প্রমাণ মেলে না যে, ভারতবর্ষ কোন দেশকে আক্রমণ করেছে।বরঞ্চ ঈর্ষান্বিত হয়ে বহু লুঠেরা বার বার ভারতবর্ষকে কলুষিত করার চেষ্টা করেছে লুঠ করেছে। ভারতের ঐতিহ্য, ইতিহাস ,পরম্পরা ,সংস্কৃতি জানতে হলে অবশ্যই বেদ-এর জ্ঞান জরুরি। কিন্তু বেদ কোন একটি বইমাত্র নয়, এটি একটি আস্ত লাইব্রেরি বটে।বেদ হল সম্পূর্ণরূপে বিজ্ঞান। বেদ,বেদান্ত (উপনিষদ) পুরান ,গীতা, স্মৃতি, তন্ত্র, রামায়ণ ,মহাভারত প্রভৃতি হল সনাতন ভারতের মূল্যবান ধর্মগ্রন্থ সমূহ। এবং এই গ্রন্থ গুলি এক একটি হীরের খনি। বিশালতাই এর বৈশিষ্ট্য।আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর পূর্বে যখন বেদ-বেদান্ত রচিত হচ্ছিল তখন পৃথিবীতে অন্য কোন সভ্যতার কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। সারা বিশ্বের মধ্যে প্রথম ধর্মীয় গ্রন্থ ও ধর্মচর্চা ভারতবর্ষের মাটিতেই হয়েছিল।সে দিক থেকে সারা বিশ্বকে যদি একটি পরিবার মনে করা হয় ,তাহলে তার ঠাকুর ঘরটি কিন্তু ভারতবর্ষেই। তাই প্রাচীনকাল হতেই ডাকাত, লুঠেরা, বেনের দল ভারতের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল,এবং এখনো আছে।মধ্যযুগে যখন লুঠেরার দল ভারতে প্রবেশ করল ,তারা প্রথমে এসে ভারতের এত ঐশ্বর্য,বিশালতা ,সংস্কৃতি, সম্পদ দেখে প্রায় পাগল হয়ে গেল। এবং প্রথমেই তারা ভারতের ইতিহাস কে মুছে ফেলতে শুরু করল ধ্বংসলীলার দ্বারা ।মন্দির, চর্চাকেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় , গুরুকুল,পুঁথি, নথি, মূল্যবান সম্পদ সমস্তকিছু ভেঙ্গে-চুরে নষ্ট করে শেষ করার সর্বোত্তম প্রয়াস করল।যাতে তারা নিজেদের কে শ্রেষ্ঠ বলতে পারে। এরমধ্যে কিছু পুঁথি-পত্র নিয়ে সেই সময় প্রাণ রক্ষার তাগিদে যাঁরা অন্য দেশে চলে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন তাঁদের দ্বারা রক্ষিত বিভিন্ন পুঁথি পত্রই আজ আমাদের কাছে হীরের টুকরো স্বরূপ। আর এই সমস্ত নথি-পত্র ও বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে ভারতের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিজ্ঞান মূলক এবং তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা আমাদের নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। তবে ভারতের ঐতিহ্য, বিজ্ঞান,প্রযুক্তিকে খাটো করে দেখানোর জন্য একদল পেইড ঐতিহাসিক এখনো তৎপর রয়েছেন। এবং তাঁরা নানা রকম ফন্দি-ফিকির করে চলেছেন। যেমন আমাদের ইতিহাসে বলা হয়েছে যে বাবর নাকি ভারতে যুদ্ধে প্রথম কামান, গোলা, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেন। এর পূর্বে নাকি এসব ব্যবহৃত হয়নি। যা ডাহা মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। বাবর কিংবা তাঁর মতো বাকী লুঠেরার দল যদি সত্যিকারে সত্যের সম্মুখীন হওয়ার সাহস রাখতেন, তাহলে ভারতবর্ষের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক সমস্ত পুঁথি/নথি গুলি কে বা ধর্মীয় চর্চাকেন্দ্র গুলিকে বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে সুরক্ষিত রাখতেন। কিন্তু তাঁরা তা করেননি। কারণ তাতে তাঁদের বীরত্ব যে আসলে ফাঁপা হাওয়া তা প্রকাশ পেয়ে যেত। প্রাচীন যুদ্ধ-বিজ্ঞান আজও আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায়, বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।যে সেই সময় কিভাবে এত বিজ্ঞান ভিত্তিক যুদ্ধ পদ্ধতি অবলম্বন করা সম্ভব হয়েছিল।বেদের বিভিন্ন শ্লোকে যুদ্ধের রীতি, পদ্ধতি, কামানের ব্যবহার সম্পর্কে সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। যা আজকের দিনের মিলিটারি ব্যবস্থাকে সজ্জিত করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।এবং বর্তমানে ভারতের যে মিলিটারি ব্যবস্থা তাও কিন্তু প্রাচীন বৈদিক যুদ্ধবিদ্যার সাথে মিল খায়।আগ্নেয়াস্ত্র প্রসঙ্গে বলা চলে, প্রাচীন কালের যোদ্ধারা আগ্নেয়াস্ত্রের যথেষ্ট ব্যবহার জানতেন। বেদে আমরা দেখতে পাই ইন্দ্রের অস্ত্র হলো ‘বজ্র’। এই ‘বজ্র’ হল তীব্র গতি সম্পন্ন বিদ্যুতের মতো লক্ষ্যভেদ করতে সমর্থ একটি আগ্নেয়াস্ত্র। এর আওয়াজ এত তীব্র যে, আওয়াজেই সকলে ভয়ে ভীত হয়। দেবতারাই কেবল নয়, সেই সময় অসুরা ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার জানতো। যার ফলে অসুররা দেবতাদের সাথে যুদ্ধ করার সাহস দেখাতে পারতো। সেক্ষেত্রে যুদ্ধ হতো সমানে- সমানে।ইউরোপের বিখ্যাত দুই পন্ডিত Willson এবং Callhed বজ্র সম্পর্কে বলছেন-” ‘Vajra’ was common weapon in India. Gun powder has been known in Hindustan, far beyond all periods of investigation. The word fire-arm is literally the Agni-astra that is a weapon of fire.Among several extra-ordinary properties of this weapon, one was that often it had taken its flight, it divided into several separate streams of flame ,each of which took effect and which when once kindled could not be extinguished but this kind of Agni Astra is now lost” অর্থাৎ বর্তমানে লস্ট হলেও প্রাচীন যোদ্ধারা এর ব্যবহার জানতেন এবং ব্যবহার করতেন। এটাই এঁরা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। মহাভারতের অংশ হরিবংশে এই আগ্নেয়াস্ত্রের কথা পরিষ্কার বলা হয়েছে। সেখানে আছে, তালজঙঘ এবং হৈহয় নামে দুর্ধর্ষ অসুরদের অত্যাচারে মানুষ যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে; ঋষি ভার্গব তাদের দমন করার জন্য সগর রাজাকে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কৌশল শিখিয়ে দেন—-
” আগ্নেয় অস্ত্রং লব্ধা চ ভার্গবাৎ সগরো নৃপঃ।
জিগায় পৃথিবীং হত্বা তালজঙঘান্ হৈহয়ান্।।”
সাম্রাজ্য লাভের উদ্দেশ্যে কিংবা কোন জাতিকে পদানত করে শোষণ ও শাসন করার উদ্দেশ্যে ঋষি সগররাজার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেননি। ভারতের যুদ্ধনীতি ছিল এমনই। আবার তাড়কা রাক্ষসী কিংবা রাবণাদি ত্রিভূবন লিপ্সু রাক্ষসদের দমন করার জন্য ঋষি বিশ্বামিত্র রামকে বহু আগ্নেয়াস্ত্র দান করেন। রামায়ণে সেইসব অস্ত্রের নাম ও ব্যবহার-বৈশিষ্ট্য লেখা আছে।( অমর ভারত অজেয় ভারত,ড.ইন্দ্রজিৎ সরকার,পৃষ্ঠা-135) । শুধুমাত্র রামায়ণ নয় মহাভারতেও আমরা এই রূপ যুদ্ধ দেখতে পাই। যেখানে ভীষ্ম তাঁর আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগ করছেন।বা কর্ন তাঁর অস্ত্রের দ্বারা সূর্যকে প্রকাশিত করছেন।অর্জুন এর অগ্নি গোলায় শত্রুপক্ষ পর্যুদস্ত হচ্ছে। তারা দিশাহীন হয়ে পরাজয় স্বীকার করছে।এছাড়াও মহাভারত বিখ্যাত হয়ে আছে বিভিন্ন প্রকার ব্যূহ রচনার জন্য(যা পরে আলোচিত হয়েছে)। ভারত আক্রমণ করতে এসে আলেকজান্ডার তাঁর গুরু এরিষ্টটটলকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন -“যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনারা ভয়ানক অগ্নি বর্ষণ করছে“। এবং যার ফলে তিনি কিছুটা অগ্রসর হয়েও পরে মানে মানে লেজ গুটিয়ে কেটে পড়েছিলেন। এমনই ছিল প্রাচীন ভারতের যুদ্ধ কৌশল ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার।অযোধ্যার সৈন্যবাহিনীতে ‘লিচনা’ নামে একটি অতিব বৃহৎ কামান ছিল। যার ভয়ে শত্রুরা কম্পমান ছিল। প্রাচীন ভারতে অনেক ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ছিল- নালিক শতঘ্নী, জ্বলন্তী, স্থূনা, সূর্মী, বজ্র, শিখরী প্রভৃতি। এছাড়াও একনলা,দুই নলা লোহার তৈরি বন্দুক এর ব্যাখ্যাও রয়েছে শস্ত্রনীতি তে। শুধু তাই নয়,হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংসের জন্য দায়ী সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তি হলো পারমাণবিক বিস্ফোরণ।প্রায় 5000 বছর পূর্বে গড়ে ওঠা এক সভ্যতা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেছিল যার কারণে, তার একমাত্র জোরালো যুক্তি হল পারমাণবিক বিস্ফোরণ।আর এটাই ছিল বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ। এ বিষয়ে ইংরেজি তারিখ 20/11/2019 তে www.gaia.com এর দেওয়া “Powerful Evidence of Nuclear Wars in Ancient Times“শীর্ষক প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুসারে ব্রহ্মাস্ত্রের ক্ষমতা এবং অখণ্ডভারতের হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে Radioactive site রয়েছে বলে দাবী করা হয়।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—” Among the most destructive of the Astra was the ‘Brahmastra’ created by the God Brahma, a single projectile charged with all the power in the universe. It was an unknown weapon an iron thunderbolt a gigantic massenger of death which reduced to ashes an entire race.There was neither a counter attack nor a defense that could stop it.Any target hit by the brahmastra would be utterly destroyed;land would became barren and lifeless, rain fall would cease,and infertility in humans and animals would follow for aeons of time…….The brahmastra had destroyed the entire Kauravas society and turned the region (present-day Rajasthan)to desert. এই ব্রহ্মাস্ত্র পারমাণবিক আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া আর কি হতে পারে?শুধু তাই নয়, এর প্রমান ও পাওয়া গেছে বর্তমান সময়ে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে–-” Ten miles west to Jodhpur ,a city in the Northern Rajasthan region of India, a three -square-mile radioactive zone was discovered during excavation for a housing project,under the ground surface were a layer of highly radioactive dust and ash in a circular pattern, consistent with what occurs underneath a typical air burst nuclear detonation………..in 2016,DRDO built a laboratory at Jodhpur to develop a drone- mounted radioactivity sensor. In what in now Pakistan, the ruins of two ancient cities, Harappa and Mohenjo-Daro,were discovered in the 1920s. The two sites were dated to around 2500 BCE. Archaeological excavation began,and when the dig reached the original street level,44 skeletons were found sprawled in the ancient roadways. A researcher ,David Davenport, found what would have been a blast epicenter,a 50 yard radius at the site ,where all objects were found to have been fused and glassified………After the discoveries, there was official silence on the topic!!” অর্থাৎ এত বড় একটা বিষয় আবিষ্কার হলো কিন্তু সরকার বা অন্যরা চুপ, কারণ কি? কারণ হলো তাহলে বামপন্থী ঐতিহাসিকদের বানানো ইতিহাসের হাঁড়ি হাটেই ভেঙ্গে যাবে যে। ইনারা এতটাই নির্লজ্জ যে ভারতের প্রাচীন পরম্পরা এবং ঐতিহ্য সত্য তুলে ধরতে এঁদের যেন গাত্রদাহ হয়।যেমনটি হলো সম্প্রতি রাম মন্দির নিয়ে। রাম মন্দির এর স্থলে নাকি বাবরি মসজিদ ছিল, তাই নিয়ে এক আজগুবি গল্প এঁরা মানে ইরফান হাবিব,শিরিণ মাসুভী,রোমিলা থাপাররা দলবেঁধে আদালতে ও যান।কিন্তু জর্জ সাহেবের বাঘা বাঘা প্রশ্নের মুখে পড়ে যা হয় আর কি,’ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। এঁরাই সব ভ্রান্ত ধারণা প্রচার/বিক্রি করে বেড়ান।যেমন এখনো পর্যন্ত এঁদের লেখা ইতিহাসই পড়ানো হচ্ছে।যে ভারতে নাকি প্রথম কামান ব্যবহার করেন বাবর মিঞা। জেনে শুনে যারা জেগে ঘুমায়, তাদের ঘুম ভাঙ্গানো কঠিন ব্যাপার। আবার মূল বিষয়ে ফিরে আসা যাক।ভারতীয়রা বারুদ কে বলতো ‘অগ্নিচূর্ণ’।চীনারা এবং আরবরা ভারতীয় দের কাছ থেকেই বারূদ তৈরির কৌশল শিখেছিল। সালফার, কাঠ কয়লা, আকুন্দ কুল প্রভৃতির মিশ্রণে তৈরি হতো ‘অগ্নি চূর্ণ’ বা বারুদ। আলেকজান্ডার বলছেন– “ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের সৈন্য বাহিনীর ওপর অঝোর ধারায় অগ্নি বর্ষণ করছে”।তথ্যভিত্তিক এক বৃহৎ প্রমান এটি। এবার আসা যাক রকেটের কথায়। রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র ভারতীয়দের কাছে কোন নতুন বিষয় ছিল না। শুক্রাচার্য রচিত ‘শুক্রনীতি’ গ্রন্থে এবং ‘অগ্নিপুরাণ’ এ এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগ ও নির্মাণ কৌশল সম্বন্ধে বহু কথা আমরা পাই। ভারতীয় প্রাচীন দুটি ক্ষেপণাস্ত্র এখনও লন্ডনের ‘রয়েল আর্টিলারি মিউজিয়ামে’ রাখা আছে, যা যথেষ্ট গর্বের বিষয় ভারতীয়দের কাছে।
(পরবর্তী অংশ দ্বিতীয় পর্বে)
ড. সুমন পানিগ্রাহী (Dr. Suman Panigrahi)।