তৃতীয় ও শেষ পর্ব
প্রাচীন বৈদিক যুদ্ধ বিদ্যাই পরবর্তীকালে সারা পৃথিবী কে আলোকিত করেছিল।সভ্যতার, জ্ঞানের, বিজ্ঞানের বিকাশ হয়েছিল এই দেশে,ভারতবর্ষে। বৈদিক যুগের সেই সভ্যতা ও সংস্কৃতির আলোর পরশ পেয়েছিল সারা বিশ্ব। প্রাচীন ভারতীয় যুদ্ধবিদ্যার একটি অন্যতম অত্যাশ্চর্য বিজ্ঞানসম্মত যুদ্ধ পদ্ধতি হলো ‘ব্যুহ-রচনা’। যুদ্ধের সময় যাঁরা বিভিন্ন প্রকার ব্যূহ-রচনা করতে পারতেন, তাঁদের হাতেই থাকত জেতার আসল চাবিকাঠি।
- প্রাচীন ভারতে যুদ্ধে ‘ব্যূহ-রচনা’ বিজ্ঞান*
‘ব্যুহ’ সম্পর্কে উপনিষদে বলা হয়েছে —
পুষন্নেকর্ষৈ যম সূর্য্য প্রাজ্ঞাপত্য ব্যূহ্ রশ্মিনস্যমূহ।
তেজৌ যত্তে রূপম কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি যোসাবসৌ পুরুষঃ সোহমস্মি। ।
(O Sun ,sole traveler of the Heavens,controller of all,Surya,son of Prajapati;remove thy rays and gather up the burning light.I behold thy glorious form;I am he,the Purusha within thee.)
সংস্কৃতে ‘ব্যূহ’ শব্দের অর্থ ” To arrange troops in a battle array(formation),to arrange, put or place in order ,to dispose,separate, divide,alter,transpose, disarrange,resolve. Its root is ব্যূ;which means – a ‘cover’ or ‘veil’.This word also refers to emanation and to the manifest power of Lord Vishnu.” প্রাচীন ভারতের যুদ্ধবিদ্যায় ব্যূহ রচনা অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক ছিল।এটি সৈন্যদের বিস্মিত এক বিন্যাস যা স্পিনিং হুইলের আকারে চলতে থাকে। চক্র কথার অর্থ এখানে ঘূর্ণায়মান চাকা বা স্পিনিং হুইল।আর ব্যুহ কথার অর্থ গঠন বা ফরমেশন। এটি সাধারণত গোলাকৃতি হত বলে একে চাকার সাথে তুলনা করে চক্রব্যূহ বলা হয়। চক্রব্যূহের কেন্দ্রে প্রচুর পরিমাণে সৈন্য থাকতো। মোট সাতটি স্তর যা একটি কেন্দ্রীয় স্তরে গিয়ে সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সর্পিল ভাবে সৈন্যদল দিয়ে তৈরি হতো। শত্রু যোদ্ধাকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিভিন্ন স্তরের গঠন ছিল আবশ্যক। কিন্তু প্রবেশ ও বাহিরের পথ থাকতো একটি। ফলে একবার চক্রব্যূহে ঢুকলে বার হবার বিদ্যা না জানলে মৃত্যু সুনিশ্চিত হতো। মহাভারতে অর্জুন পুত্র অভিমন্যু ও এইভাবে কৌরবদের চক্রব্যূহে এসে আটকে পড়ে ছিলেন বার হতে পারেননি। কারণ তিনি তাঁর মাতা কৃষ্ণের ভগিনী সুভদ্রার গর্ভস্থ অবস্খাতেই অর্জুন কর্তৃক চক্রব্যূহে প্রবেশ পদ্ধতি গল্পের মাধ্যমে জানলেও চক্রব্যূহ হতে বার হবার বিদ্যা জানা ছিল না।কারন বার হবার বিদ্যা যখন বলছিলেন অর্জুন,ততক্ষনে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সুভদ্রা,ফলে অর্জুন পুত্র অভিমন্যুর চক্রব্যূহ ভেদ করে বাহির হবার বিদ্যা আর শেখা হয়নি যার ফলে কৌরবদের চক্রব্যূহে ঢুকে না বার হতে পেরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মহাভারতের এই কাহিনী আমাদের সকলেরই প্রায় জানা। চক্রব্যূহের কেন্দ্রস্থল দূর হতে দেখলে একটি বিন্দু মনে হতো। পদাতিক ,অশ্বারোহী,গজ বাহিনী এবং রথ বাহিনী এই চার শ্রেণীর সৈন্য বাহিনী আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে সাতটি স্তরে ইন্টার লিভিং পজিশনে থাকত। এই বাহিনী আবার শক্তিশালী যোদ্ধাদের একটি গ্রুপ দ্বারা সুরক্ষিত থাকতো অর্থাৎ ডবল্ প্রোটেকশন। প্রতিটি স্তরে সেনাবাহিনীর একজন করে সক্ষম যোদ্ধা অগ্রে থাকতেন, চক্রব্যূহের আকার অনুসারে সৈন্য বাহিনীর সংখ্যা নির্ধারিত হতো। সুতোর মধ্যে গোলাকার ফাঁস তৈরি করে দুটিকে টানলে ঠিক যেভাবে মধ্যবর্তী অংশ আটকে যায়,ঠিক একই রকম পদ্ধতি ছিল এই ব্যূহে।শত্রুদের কোন অংশকে ক্যাপচার করা হবে সেটি নির্ণয় করে দুদিকের সৈন্য নিয়ে এগিয়ে গিয়ে শত্রুকে ক্যাপচার করাই ছিল পদ্ধতি। মহাভারতের যুদ্ধে দ্রোণাচার্য নানা ধরনের ব্যূহ রচনা করেছিলেন। এরমধ্যে যুদ্ধের 13 তম দিনে তিনি যুধিষ্ঠির কে বন্দী করার জন্য এক শক্তিশালী ব্যূহ রচনা করেছিলেন। চক্রব্যূহ হল বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমত্তা পূর্ণ সামরিক গঠনের প্রতীক। মহাভারতের যুদ্ধে তাই বারবার চক্রব্যূহ রচিত হয়েছিল। এটি একটি স্পিনিং ডেথ মেশিন এর মত যা সমস্ত কিছুকে গ্রাস করতে পারে।টাইফুনের মতো সব কিছু কে ধ্বংস করতে পারে।মহাভারতে এই মরণ ফাঁদ থেকে বার হবার বিদ্যা জানা ছিল কেবলমাত্র কৃষ্ণ, অর্জুন, দ্রোণ, ভীষ্ম ও প্রদ্যুম্ন এর।আসলে এরমধ্যে প্রবেশ করলে যোদ্ধা, শারীরিক এবং মানসিকভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মারা যেত।বিভিন্ন প্রকার ব্যূহ রচনা করা হত।যেমন-Krauncha vyuha( চক্রবাক),Makara vyuha(কুমিরাকৃতি),Kurma vyuha(কচ্ছপাকৃতি),Trishula vyuha(ত্রিশূলাকৃতি),Kamala vyuha(পদ্মাকৃতি),Garud vyuha(গরুড়াকৃতি),Oormi vyuha(সমুদ্রাকৃতি),Mandala vyuha(নক্ষত্রাকৃতি),Vajra vyuha(হীরাকৃতি),Shakata vyuha (অক্ষাকৃতি),Asura vyuha(অসুরাকৃতি),Deva vyuha(ঐশ্বরিক আকৃতি),Chandra kala vyuha(বক্রাকৃতি)Mala vyuha(মালাকৃতি) প্রভৃতি। এরমধ্যে পদ্মব্যূহ ছিল অন্যতম। যার মাধ্যমে অভিমুন্য বীরগতি প্রাপ্ত হয়।উইকিপিডিয়া মতে- ” The padmavyuha is a multi- tiered defensive formation that looks like a blooming lotus(पद्म)or disc(चक्र)when viewed from above.The warriors at each interleaving position would be in an increasingly tough position to fight against. The formation was used in the battle of Kurukshetra by Dronacharya,who became commander-in-chief of the Kaurava army after the fall of Bhishma Pitamaha………..The formation begins with two soldiers standing back-to-back,with other such set of soldiers standing at a distance of three hands,drawing up seven circles and culminating in the end which is the place where the captured person or object is to be kept.In order to form the Chakravyuha,the commander has to identify soldiers who will form this formation. The number of soldiers to be deployed and the size of the Chakravyuha is calculated as per the resistance estimated. Once drawn ,the foremost soldiers come on either side of the opponent to be captured, engage briefly and then advance. Their place is taken up by the next soldiers on either side,who again engage the opponent briefly and then advance.In this fashion, a number of soldiers pass the enemy and proceed in a circular pattern. By the time the rear of the formation arrives.,the oblivious enemy is surrounded on all sides by seven tiers of soldiers. The last soldiers of the formation give the signal of having completed the Chakravyuha.On the signal,every soldier who so far has been facing outward turns inwards to face the opponent. It is only then that the captured enemy realizes his captivity. The army can continue to maintain the circular formation while leading the captive away. “
সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত , ক্ষুরধার ও তীক্ষ্ম বুদ্ধির ব্যবহার দেখা যায় ব্যূহ রচনা শৈলীতে।নানা রকম যুদ্ধের ধ্বনির সৃষ্টি করে ব্যূহ রচনা কারীরা এক ভয়ানক আলোড়ন তৈরি করতেন।যার ফলে শত্রু পক্ষ ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত।তবে প্রাচীন ভারতের মানুষেরা শত্রুর দক্ষতা ও কর্মের গুণকে সম্মান করতেন। তাই তাঁরা যুদ্ধের নীতি কে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। ভারতবর্ষ কোন দেশকে জয় করার জন্য যুদ্ধ বিজ্ঞানকে অভ্যাস করেনি।কেবলমাত্র আত্মরক্ষার জন্যই এই বিশাল বিদ্যা তাঁরা রপ্ত করেছিলেন। ভারতবর্ষের দশ হাজার বছরের ইতিহাস অন্তত তাই বলে।
ড.সুমন পানিগ্রাহী (Dr.Suman Panigrahi)।
চিত্র :গুগুল ইমেজ।