‘এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত’ এই শব্দবন্ধের মধ্যে প্রত্যেকটি শব্দ তাৎপর্যপূর্ণ এবং এই তাৎপর্যের আলোচনা করা এবং সেই আলোচনাকে কিভাবে শিক্ষাক্ষেত্রের মাধ্যমে সর্বব্যাপী করা যায় সেই নিয়েই এই নিবন্ধ।
‘এক’ বলতে এই সুবৃহৎ ভারতবর্ষের অখন্ডতা এবং একাত্মতাকেই বোঝানো হয়েছে। ভারতবর্ষের মানচিত্র প্রাকৃতিকভাবে এমনভাবেই তৈরি হয়েছে যে সেটিকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।
উত্তরং যৎ সমুদ্রস্য হিমাদ্রেশ্চৈব দক্ষিণম্।
বর্ষং তৎ ভারতং ভারতী যত্র সন্ততিঃ।।
এই শ্লোক এবং বেদ-পুরাণের এইরকম আরো অনেক শ্লোক সন্দেহাতীতভাবে ভারতবর্ষের সীমারেখা প্রমাণ করে।এই অখন্ড ভারতবর্ষের শুধু সীমা নয় , এর মধ্যেকার বিভিন্ন নদী যেনো শরীরের রক্তজালিকার মতো সারা দেশে প্রাণ সঞ্চার করছে।এই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি ভারতবর্ষ সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করে যা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে বিরল।
কিন্তু সমগ্ৰ ভারতবর্ষ কে আমরা কোন আঙ্গিকে ‘এক’ করে দেখি বা দেখতে বাধ্য হই ? ভারতবর্ষের একাত্মতা তাঁর সংস্কৃতির মধ্যে। সংস্কৃতি কি ? ব্যক্তি , সমাজ ও রাষ্ট্রের মঙ্গলসাধনের জন্য ব্যবহারিক জ্ঞানের অভ্যাসে রূপান্তরিত হওয়ার নাম সংস্কৃতি। বিজ্ঞান এখন আমাদের সামনে নিত্যনতুন তথ্য তুলে ধরছে ভারতবর্ষের জ্ঞানের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে।আমরা জানি , শরীরে পুষ্টি রসের যোগান পরিপূর্ণ থাকলে তবেই মস্তিষ্কে চিন্তাশক্তি জাগ্ৰত হতে পারে। নদীমাতৃক দেশের উর্বরা ভূমির ফসল ; ভারতবর্ষকে চিন্তাশক্তির যোগান দিয়েছে , অভাবের তাড়নায় হিংস্রতা জন্ম নেয় নি এখানে।
ভাষা-পরিধানের বিভিন্নতা সত্ত্বেও ভারতীয় উৎসবের ভাব আসমুদ্রহিমাচল আলোড়িত করে।মকর সংক্রান্তি , নববর্ষ , দোল উৎসব প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে একসূত্রে বেঁধেছে।
বিশ্বের প্রাচীনতম সাহিত্য বেদকে নির্ভর করে সংস্কৃতি মাঝেমধ্যে শাখানদীর মতো অন্য খাতে প্রবাহিত হলেও বেদ-উপনিষদের দর্শন ও তত্ত্বের আলোচনার মাধ্যমেই তা সমাজে স্থান পেয়েছে। ভারতবর্ষের এই সাংস্কৃতিক ঐক্য লোকশিক্ষার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কখনো গৌতম বুদ্ধ , কখনো আদি শঙ্করাচার্য , স্বামী রামতীর্থ আবার কখনো শ্রী চৈতন্যদেব এর মাধ্যমে। আধুনিক যুগে ঔপ্যনিবেশিকতা কে হাতিয়ার করে যখন ভারতীয় সংস্কৃতি তে আঘাত হানার চেষ্টা হলো তখন পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক আগ্ৰাসনকে রুখতে এবং সনাতন সংস্কৃতি কে নবজীবন দিয়ে ভারতবর্ষের ‘একতা ও শ্রেষ্ঠতা’র পুনরুত্থানের উপায় বললেন স্বামী বিবেকানন্দ।
‘শ্রেষ্ঠ’ — এই রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠতা ত্যাগব্রতী মুনী-ঋষীদের জ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সেই জ্ঞান তপস্যার কোনো প্রতিযোগী ভারতবর্ষ সেইসময় দেখে নি।মানব মন জ্ঞান সমুদ্রের সম্ভাব্য যত ক্ষেত্রে বিচরণ করতে পারে , তার কোনোটাই ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে অধরা ছিল না।
ইউরোপের বৈজ্ঞানিক অগ্ৰগতি ভারতবর্ষ থেকে পাওয়া জ্ঞান ও প্রাচীন পুঁথি গুলির অনুবাদ ছাড়া যে সম্ভব ছিল না সে সত্য এখন প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘ বৈদেশিক শাসনে ভারতীয়দের মধ্যে যে অন্ধ অনুকরণ ও হীনমন্যতা প্রবেশ করেছে তা দূর করতে বিজ্ঞান , শিল্প , সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে ভারতীয় অবদান কে ভারতীয়দের সামনে তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তুলে ধরতে হবে। আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় স্তরে ব্যাপকভাবে এই সত্যের প্রসার হচ্ছে , শুধু প্রয়োজন আঞ্চলিক স্তরে শ্রেণীকক্ষ পর্যন্ত এই সত্য কে নিয়ে যাওয়া। স্বাধীনতার পর থেকে ইংরেজদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সর্বক্ষেত্রে ভারতীয় সব কিছু কে অবজ্ঞা করার যে শিক্ষা শিশুমনে প্রবেশ করিয়ে যাচ্ছে তা থেকে বেরোতে হলে শিক্ষার সর্বক্ষেত্রে ভারতীয় অবদান সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের অবগত করানোর গুরুদায়িত্ব শিক্ষকদের। ভারতবর্ষের মহানতা শিশুমনে চিত্রিত করার এক সুনিপুণ চিত্রকর হতে হবে প্রত্যেক শিক্ষক কে ।
‘ভারত’- এই নামের মধ্যেই এই রাষ্ট্রের আত্মা কে খুঁজে পাওয়া যায় ।সেই নামের উৎস ভারতবর্ষের নিজস্ব ইতিহাসে পাওয়া যায়। কোনো ব্যক্তির নামের যেমন অন্য কোনো ভাষায় অনুবাদ সম্ভব নয় , ঠিক তেমনি কোনো রাষ্ট্রের নামের অন্য ভাষায় অনূদিত নাম ব্যবহার করা বা বিদেশীয়দের বিকৃত উচ্চারণকে স্বীকৃতি দেওয়া আপন সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে দাসত্বের নামান্তর। প্রত্যেক দেশীয় শব্দের সঙ্গে সেই দেশের সংস্কৃতি জড়িয়ে থাকে।তাই ভাষার অনুবাদের সঙ্গে সঠিক অর্থ ও ভাবের প্রকাশ খুব কঠিন কাজ।তাই ‘ভারত’ রাষ্ট্রের যেমন বিকল্প নেই ঠিক তেমন এই বিশেষ্যের সঙ্গে জড়িত বিশেষণগুলোর বিকল্প নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘জাতি’ , ‘রাষ্ট্র’ গঠন একভাবে হয় নি।ইউরোপীয় চশমা দিয়ে প্রাচীন ভারতবর্ষের সমাজনীতি , রাষ্ট্রনীতি কে বিচার করলে ভারতীয়রা ভারতবর্ষ কে কখনোই বুঝতে পারবে না।আর এই বোঝার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় ভাষা।যেমন ‘রিলিজিয়ন’ শব্দ দিয়ে সম্পূর্ণ ভারতীয় ধারণা ‘ধর্ম’ কে বোঝা যাবে না।এই সমস্যার সমাধান তখনই হবে যখন আমরা ভারতীয় অবধারণাগুলোকে ভারতীয় ভাষায় বুঝতে ও বোঝাতে সমর্থ হবো। এছাড়াও ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান-বিজ্ঞান কে বুঝতেও ভারতীয় পুথিগুলির বিদেশীয় অনুবাদ পড়লে , আবার বিদেশীয় দৃষ্টি দিয়ে দেশ কে দেখার ভুল করবো।ভারতীয় জ্ঞানের যুগানুকূল প্রয়োগ ও সঠিক মর্মার্থ বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে সংস্কৃত ভাষার পুনরুত্থান প্রয়োজন।আর এই কাজ শিক্ষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কিভাবে সম্ভব ?
এখন দেখা যাক এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত এর বিপক্ষে ক্রিয়াশীল তত্ত্বগুলিকে। সেই তত্ত্বগুলিকে চিহ্নিতকরণের মাধ্যমেই আমরা ভারতবর্ষের অখন্ডতা ও শ্রেষ্ঠতার পথে যে সমস্যা সেগুলোর সমাধান করতে পারবো।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় শতকে দীর্ঘ বৈদেশিক শাসনের কুফলে এবং খুব তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা লাভের আশায় ভারতবর্ষের আপন সংস্কৃতি বিরুদ্ধ দুটি পথে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অগ্ৰসর হয় যেগুলোর কুফল ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পরেও দীর্ঘ প্রায় ৭৫ বছরেও আমাদের পিছু ছাড়ে নি।এর মধ্যে একটি হলো বামপন্থা এবং একটি ভারতবর্ষ কে একটি মিশ্র সংস্কৃতির একটি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে দেখানোর চক্রান্ত ।আর এই দুই পথের কুচক্রীদের চক্ষুশূল ভারতবর্ষের কয়েক হাজার বছরের সনাতন সংস্কৃতি।তাই ভারতীয় সংস্কৃতি কে আঘাত করার জন্য এরা বিভিন্নভাবে কাজ করেছে।যেমন বিভাজনকারী আর্য-অনার্য তত্ত্বের প্রসার , ভারতবর্ষের বুকে ঘটে চলা আরবীয় নৃশংসতা কে ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা , ভারতবর্ষের গৌরবময় ইতিহাস কে পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে দেওয়া , সংস্কৃত ভাষার পুনরুত্থানের পথে বাধা সৃষ্টি করা ইত্যাদি।
বর্তমানে ভারতে রাষ্ট্রবাদের জাগরণের ফলে ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ আমরা পেয়েছি। কিন্তু ‘এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত’ গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষানীতির মাধ্যমে একদম নীচুস্তর পর্যন্ত সমস্ত ভুল শুধরে তার ফল পেতে অন্তঃতপক্ষে ৩০ বছর অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু এই কাজটিই ত্বরান্বিত হতে পারে যদি ‘এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত’ এর লক্ষ্যে ভারতবর্ষে এমন শিক্ষককূল তৈরি করতে পারি যারা ভারতবর্ষের গৌরবময় ইতিহাস থেকে শুরু করে সংস্কৃত ভাষার পুনরুদ্ধারে ক্লাসরুম পর্যন্ত কাজ করতে পারবে। কারণ , পাঠ্যপুস্তক যেরকম হোক না কেনো , পাঠ্যক্রমের বিষয় যাই হোক না কেনো শিক্ষার্থীদের কাছে জ্ঞানের প্রধান এবং প্রত্যক্ষ উৎস শিক্ষকের মুখ নিঃসৃত বাক্য।
এইখানেই ভারতবর্ষের ইতিহাসে পৃথিবীর সব থেকে বড় শিক্ষা বিষয়ক সংগঠন ‘অখিল ভারতীয় শৈক্ষিক মহাসঙ্ঘ'(ABRSM) এর গুরুদায়িত্ব।
ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার আগে থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতি কে , ভারতীয়ত্ব কে ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা স্বাধীনতার পরেও অব্যাহত থেকেছে। বৈদেশিক শত্রুরা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস স্তুপে পরিণত করে সারা বিশ্বে সমাদৃত এক শিক্ষাব্যবস্থা কে ধ্বংস করেছিল । আর ইংরেজ আমলেও আইন করে ভারতীয় সংস্কৃতি তে আঘাত দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ‘শিক্ষা’ কে।
পাঠ্যক্রমে দেশপ্রেম , ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি গর্ববোধ করানোর মতো বিষয় কে প্রাধান্য দেওয়া হয় নি। ফলস্বরূপ জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে ‘ , জামিয়া মিলিয়া তে ‘জিন্নাহ ওয়ালী আজাদি’র স্লোগান শোনা যায়।
ভারতীয় সংস্কৃতির রসে সিক্ত শিক্ষা শুধুই জীবিকা অর্জনের জন্য হতে পারে না।
‘শিক্ষা’য় জাতীয়তাবাদ , ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আস্থা ফিরিয়ে এক দেশপ্রেমী , সেবাব্রতী নাগরিক সমাজ তৈরির দায়িত্ব অবশ্যই শিক্ষকদের ।
পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর এক বিদেশীয় মতবাদে বিশ্বাসী দলের সরকার থাকায় , স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমশই ভারতীয়ত্ব থেকে দূরে সরে গেছে। কলেজগুলোকে দলের ভবিষ্যৎ-ক্যাডার তৈরির কাজে লাগানো হয়েছে।বিগত দশ বছরেও শিক্ষার হাল রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে, দীশাহীনতার অভাবে তথৈবচ।
তাই , রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে শিক্ষাব্যবস্থা কে বাঁচাতে এবং সমাজ ও দেশের কল্যাণকর শিক্ষাব্যবস্থা রূপায়ণে শিক্ষকদের সঙ্ঘবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
একজন শিক্ষক ভারতবর্ষের এই পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র তাঁর নিজস্ব ‘বিষয়’ শিক্ষা দিবেন আর তাতে রাষ্ট্রের পুনরুত্থান হবে—- এ এক অলীক কল্পনা।
জীবিকা-নির্বাহের শিক্ষার পাশাপাশি এখন প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় চরিত্র নির্মাণের।
রাষ্ট্রের উত্থানের জন্যই শিক্ষা। শিক্ষার মধ্যে নৈতিকতা , রাষ্ট্রের জন্য সমর্পণের ভাবনা সবার আগে আসা উচিত।
রাষ্ট্রীয় চরিত্র ব্যতীত একজন বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ দেশীয় সংস্কৃতির বিপক্ষে এবং ভারতীয় সংস্কৃতি বিরোধী মতবাদের পক্ষেই কথা বলবে।একজন উচ্চমেধার বৈজ্ঞানিক অর্থের জন্য ভারত-বিরোধী দেশের গবেষণাগারে উন্নতমানের অস্ত্র তৈরি করবেন।জ্ঞান , শিক্ষার এক সামান্য অংশমাত্র।
নৈতিকতা আর রাষ্ট্রের প্রতি নিষ্ঠা ছাড়া জ্ঞানের কি মূল্য আছে ?
প্রাচীনকালে শিক্ষার্থীরা গুরুগৃহে থেকে পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়াও জীবনচর্যার মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজে শিক্ষার প্রয়োগ করতো কিন্তু আধুনিক কালের শিক্ষাব্যবস্থায় সে সুযোগ নেই। একসাথে থাকা-খাওয়ার মাধ্যমে যে সামাজিকতা , সমষ্টির জন্য ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য কে ত্যাগের যে অভ্যাস হয় তা থেকে বর্তমান প্রজন্ম বঞ্চিত হচ্ছে। পরিবার গুলো দিনের পর দিন একটিমাত্র সন্তান ধারণের পরিকল্পনা গ্ৰহণ করাতে পরিবারেও সামাজিকতা ও ত্যাগের শিক্ষাগ্ৰহণ সম্ভব হচ্ছে না।
যে ব্যক্তি পরিবারে , বিদ্যালয়ে জীবনের মূল্যবোধ শিখতে পারছে না সে নিজের দৃষ্টি প্রসারিত করে কিভাবে দেশের জন্য আত্মত্যাগের কথা ভাবতে পারবে ? তাই এ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে বিদ্যালয়গুলি কে।
শুধুমাত্র শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করে আমরা হয়তো একটি বিশেষ বিষয়ে দক্ষ নাগরিক তৈরি করতে পারি কিন্তু দেশের জন্য স্বার্থত্যাগী , সমাজদেহের অঙ্গীভূত একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ তৈরি করবো কেমন করে ?
তাই পাঠদানের পাশাপাশি প্রয়োজন শিক্ষক-ছাত্র মিলিতভাবে দিনযাপন , একসাথে আহার-বিহার।আর তখনই একজন শিক্ষক কে একজন ছাত্র টেবিল,চেয়ার, পাঠ্যপুস্তক , চক , ডাস্টার ইত্যাদি উপকরণের থেকে স্বতন্ত্র তারই মতো এক মানুষ হিসেবে পাবে । এইভাবেই সহপাঠীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ , সহমর্মিতা বিকশিত হতে পারে ; ছাত্র-শিক্ষক এর মধ্যে একাত্মতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় এইরকম কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও বছরে অন্তঃত কয়েকটি দিন এই ব্যবস্থা করা যেতেই পারে। শিক্ষক হিসেবে বলতে পারি , শ্রেণীকক্ষের এই একাত্মতা সমাজ ও দেশের একাত্মতার গঙ্গোত্রী হিসেবে দেখা দিবে।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন ‘ত্যাগ ও সেবাই হইল ভারতবর্ষের জাতীয় আদর্শ।এই দুই আদর্শের পথে ভারতের সকল কর্মপ্রচেষ্টাকে কেন্দ্রীভূত করিতে হইবে আর অবশিষ্ট কাজ আপনা হইতেই সম্ভব হইয়া
উঠিবে।’ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেবার আদর্শ প্রচারিত করতে বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী এলাকায় বিভিন্ন সেবাকাজে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এর কার্যক্রম করতে হবে।তবেই পারিপার্শ্বিক সমাজের সঙ্গে তারা একাত্ম হতে পারবে । একটি দেশ কয়েক লক্ষ শ্রেণীকক্ষের সমাহার। প্রত্যেক শ্রেণীকক্ষের শিক্ষার্থী নিজের সমাজের সঙ্গে এইরকম আত্মিক যোগ প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই ‘এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত’ এর লক্ষ্যপ্রাপ্তি হবে।
শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদান করাই একজন শিক্ষকের একমাত্র কর্তব্য নয়।সমাজের বঞ্চিত , দুঃস্থ ও বিপর্যস্ত দের পাশে দাঁড়িয়ে সমস্ত সমাজকে সেবাকাজে পরস্পরের পাশে দাঁড়ানো ও ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বানের দায়িত্ব শিক্ষকদের নিতে হবে।যেমন সেবাব্রতী , আত্মত্যাগী চাণক্যের জন্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য , স্বামী রামদাসের জন্য শিবাজী , শ্রী রামকৃষ্ণের জন্য স্বামী বিবেকানন্দের মতো শিষ্য কে সমাজ আশীর্বাদ রূপে পেয়েছিল।তাই “সর্বে ভবন্তু সুখিনাঃ , সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ ,সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু, মা কশ্চেৎ দুঃখভাগ্ভবেৎ” এর মন্ত্র নিয়ে সেবাকাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এইভাবে শিক্ষকসমাজ শুধুমাত্র বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না হয়ে এক রাষ্ট্রীয় শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারলেই ‘এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত’ এর স্বপ্ন সাকার হবে।
পিন্টু সান্যাল