[৯ ই জুলাই, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের স্থাপনা দিবসকে স্মরণে রেখে আলোচনাটি করা হয়েছে]
আলোচনার বিষয়ঃ রাষ্ট্র পুর্নগঠনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রশক্তির প্রাসঙ্গিকতা। কোন রাষ্ট্র? ভারতবর্ষ। কোন ভারতবর্ষ? এক ঐশী, সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের দেশ। গৃহে যেমন একটি ঠাকুরঘর থাকে। বিশ্বরূপ গৃহেও একটি ঠাকুরঘর আছে। সেই উপাসনা কক্ষটি হচ্ছে পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ। কেন পুণ্যভূমি? সাধুসন্তের দেশ বলে পুণ্যভূমি, মহন্ত-মনীষীর দেশ বলে এই সৌকর্যভূমি। ভারতবর্ষ দর্শনের দেশ, প্রজ্ঞা এবং বোধাতীতানন্দের দেশ। এই ঠাকুরঘরের দেশ বাঁচলে বিশ্ব বাঁচবে। তাই অবিলম্বে এর পুনর্গঠন দরকার।
পুনর্গঠন দরকার তার কারণ সিস্টার নিবেদিতার মতে, ভারতবর্ষ না বাঁচলে বিশ্ব এক অমূল্য রতন হারাবে। ভারতবর্ষের মঙ্গলই বিশ্বের মঙ্গল। কারা পুনর্গঠন করবেন? ছাত্রসমাজ। কেন ছাত্রসমাজ? কারণ তারা সবুজ, তারা কাঁচা। তারা আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচায়। কোন ছাত্রসমাজ? জাতীয়তাবাদী গৈরিক ছাত্র সমাজ। কারণ ভারতবর্ষ মোক্ষের দেশ, তার স্বরূপ হচ্ছে গেরুয়া। তার পতাকা, তার মাস্তুল গৈরিক বর্ণ। জাতীয়তাবাদ এ কারণেই, তার হেডকোয়ার্টার থাকতে হবে ভারতবর্ষের মস্তিষ্কের মধ্যেই, ভারতবর্ষের মেরুদণ্ডের মধ্যেই। রাশিয়ায় নয়, চীনে নয়, কোরিয়ায় নয়, কিউবায় নয়। ভারতবর্ষের প্রাণভোমরা ভারতের মধ্যেই আছে, ভারতবর্ষের মধ্যেই থাকতে হবে। আন্তর্জাতিকবাদ দিয়ে একাজ হবে না। কেন হবে না? একটি মেঠো কথা হল, “আগে দিয়ে বেড়া/তবে ধরো গাছের গোড়া।” আগে দেশের চারপাশে বেড়া দিয়ে দেশ সুরক্ষিত করতে হবে, দেশের সংস্কৃতি রক্ষা করতে হবে, তারপর ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ করতে হবে। ভারতবর্ষ নিজে আগে বাঁচবে, তবে না বাঁচাবে!
অর্থাৎ দাঁড়ালো এই, ভারতরাষ্ট্রের পুর্নগঠনের জন্য জাতীয়তাবাদী গৈরিক ছাত্রশক্তির প্রাসঙ্গিকতা আছে। সেটা কোন পথে কোন উদ্যোগে হবে তারই সুলুকসন্ধানের জন্য এই আলোচনা।
যে প্রেক্ষিতে এই আলোচনা করতে এসেছি তার মূল বিন্দু হচ্ছে এবিভিপি-র প্রতিষ্ঠা দিবসের উপলক্ষ, ৯ ই জুলাই। এবিভিপি বা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ একটি সর্বভারতীয় ছাত্র সংগঠন। ১৯৪৯ সালে এর প্রতিষ্ঠা। এই সংগঠনের ঐতিহ্য কী? এরা ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের পুনর্গঠনের দিকে, একটি সমৃদ্ধশালী আদর্শের দিকে এগিয়ে যেতে চেয়েছে। বর্তমান প্রজন্মকে কুসংস্কারমুক্ত আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছে। শ্রেষ্ঠ ভারত গড়ার সংকল্পে এগিয়ে যেতে চেয়েছে। ছাত্রাবস্থা থেকে একটি হিতবাদী দৃষ্টান্ত স্থাপন তাদের উদ্দেশ্য। এই চাইবার পথ ধরে বিদ্যার্থী পরিষদ কেবল ভারতবর্ষের মধ্যে নয়, পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ ছাত্রসংগঠনের শিরোপা লাভ করেছে। তারা বন্দেমাতরম ধ্বনিকে কাজে পরিণত করতে চেয়েছে, বলতে চেয়েছে Bandemataram in Action. কোন বন্দেমাতরম? সুজলাং সুফলাং শস্যশ্যামলাং ভারতমাতার বন্দনা। হাজার হাজার বিদ্যার্থী নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ‘ভারতমাতা‘-র জয়ধ্বনি করে ভারতমাতার কাজে সামিল হচ্ছে। কেরল থেকে কাশ্মীর, অরুণাচল প্রদেশ থেকে গুজারাট। সমগ্র ভারত জুড়ে তাদের ভূমিকা এবং সার্থকতা। শুভঙ্করী পথে যেতে কোন বাঁধা না মানার ঐতিহ্য, আন্দোলন না থামার পারম্পর্য। নানান সময়ে সংবাদপত্রে, সোশ্যাল মিডিয়াতে তার উজ্জ্বল ভূমিকা জানতে পেরে প্রীত হয়েছি বলেই এই সংগঠনের জন্মদিন উপলক্ষে দু’টি কথা বলতে এসেছি।
“Work that she may prosper. Suffer that she may rejoice.” কার ঐশ্বর্যশালিনী হবার কথা বলা হচ্ছে? দেশমাতার। কার আনন্দ লাভের কথা হচ্ছে? ভারতমাতার। কে বলছেন?
শ্রী অরবিন্দ ঘোষ (Shri Arvind Ghosh)।
তখন তিনি জাতীয় মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, ১৯০৬ সাল। বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনে উত্তাল ভারতবর্ষ। বহু টাকার বেতন ছেড়ে জাতীয় মহাবিদ্যালয়ে যোগদান করতে এলেন। বিলেত থেকে পড়াশোনা করা তরতাজা এক যুবক।
তিনি ছাত্রদের বলছেন, পড়াশোনা করবে দেশের জন্য। If you will study, study for her sake. শরীর, মন, অন্তরাত্মাকে উপযুক্ত করবে দেশসেবার জন্য। train yourselves body and mind and soul for her service. You will earn your living that you may live for her sake. দেশের জন্য বেঁচে থাকতে আয় করবে। বিদেশে যাবে যাতে সেখান থেকে জ্ঞান নিয়ে এসে দেশের সেবায় লাগাতে পার। You will go abroad to foreign lands that you may bring back knowledge with which you may do service to her.
দু বছর বাদে ১৯০৮ সালে শ্রী অরবিন্দ বলছেন, “Service of our motherland is our highest duty at this moment.” মাতৃভূমির সেবাই এই সময়ে আমাদের সর্বোচ্চ কর্তব্য। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রেরও একই মত ছিল, “বিজ্ঞান অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু স্বরাজ নয়।”
কে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের বিখ্যাত অধ্যাপক, হিন্দু কেমিস্ট্রি গ্রন্থ প্রণেতা। যিনি স্বামী প্রণবানন্দকে সঙ্গী করে পূর্ববঙ্গে গিয়ে ছাত্রদের নিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণকার্য সংগঠিত করেছেন। ১৯২৫ সাল, যে বছর রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রতিষ্ঠা, সে বছর ফরিদপুর জেলা ব্যবসায়ী সমিতির এক অধিবেশনে বলছেন, “আমি বরাবরই বলে থাকি দেশের ছাত্রদের এবং যুবকদের ওপরই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে — তাঁরা যদি সঙ্গবদ্ধ হয়ে প্রতিজ্ঞা করেন যে দেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি করবেন তা হলে সহজে তা করতে পারেন।…. যেটুকু শিখেছেন তা দেশের লোকের মধ্যে বিলিয়ে দেবেন। তাঁরাই আমাদের দেশের বহুকালের প্রচলিত বাক্য ” বিদ্যা মহাধন কেহ নাহি নিতে পারে কেড়ে/যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে।”
জাতীয়তাবাদী ছাত্রশক্তির কাজ কখনও রাজনৈতিক সত্তা, বাহুবল, মিথ্যাপ্রচার, স্লোগান, পরনির্ভরতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে না। তা পরিশ্রম, নিষ্ঠা, কর্তব্য সম্পাদনের মাধ্যমে তিল তিল করে গড়ে তুলতে হয়। ভারতীয় সংস্কৃতিতে মুছে ফেলতে যেখানে নানান বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অশুভ শক্তি, দেশদ্রোহী শক্তি, বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তার বিরুদ্ধে সচেতন থাকতে হয়। তাদের হিংসামূলক কাজের সম্ভাবনা জরিপ করতে হয়। বাহুবল নয়, ভালোবাসা দিয়ে জাতীয়তাবাদের আদর্শে সদস্যতা করতে হয়। তাদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনন্দধারায় বাঁধতে হয়। এ বাঁধন বিহীন বন্ধন। দেশমাতৃকা তার জপমন্ত্র।
ভারতবাসীকে, বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিতে হবে ছাত্রশক্তি কোনো অসভ্যতামির পৃষ্ঠপোষক নয়, Student Power Nuisance power নয়। বোঝানোর দরকার আছে অনেকানেক রাজনৈতিক দলের নেতাদের দ্বারা পোষা গুণ্ডার দল নয়। নিকট অতীতের আমরা সাক্ষী যে ছাত্রদের অসীম জীবনীশক্তিকে কাজে লাগিয়ে তাদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে শাসক দল তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে, সেই রাজনৈতিক দলের লেজুড় হয়ে থাকে, পদলেহন করে। বিদেশি শক্তি ও সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ করে যারা বিদ্যার্থীদের বিভ্রান্ত করে, তারা ছাত্রদের জন্য সম্পদ নয়। দেশের ক্ষতি করে যে সমস্ত রাজনৈতিক দলে বিদেশি হেডকোয়ার্টারের সমৃদ্ধি চায় এবং ছাত্রদের লেলিয়ে দেয়, তাদের চিহ্নিত করতে পারা, ছাত্রশক্তির প্রাথমিক কাজ হওয়া উচিত। সজাগ থাকতে হবে কোন দল, কোন আদর্শ ছাত্রদের বিপথগামী করে তুলছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশবিরোধী, সমাজবিরোধী মানুষের মদত দেওয়ার নামই হল অনৈতিকতা। ছাত্রদের সঠিক আদর্শ, সঠিক দিশার প্রতি নাড়া বাঁধতে হয়। ইতিবাচক কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, গঠনমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা, ভারতমায়ের গৌরববর্ধনের জন্য সদাসক্রিয় হওয়ার নামই জাতীয়তাবাদ।
একসময় ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল ছাত্রশক্তি। আজ সেই স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখা, ভারতবর্ষের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার নামই হল জাতীয়তাবাদ। ছাত্রদের উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে লেলিয়ে দিয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে দেওয়া সহজ। তিল তিল করে গড়ে তুলতে হয় যে ল্যাবরেটরী, গবেষণা খামার, ক্লাসরুম ; তা হঠকারী আন্দোলনের নামে ভেঙ্গে যেতে দেখেছে পশ্চিমবঙ্গবাসী। তারা ভেঙে, গুঁড়িতে দেওয়ার ইজমে বিশ্বাসী। হ্যাঁ, ভাঙ্গনের জয়গান গাইতে চেয়েছিলেন কবি, সেটা কোন ভাঙ্গন? সেটা অশুভ মানসিকতার ভাঙ্গন, সেটা ধ্বংসাত্মক শক্তির ভাঙ্গন, সেটা দেশবিরোধিতার ভাঙ্গন, সেটা বিকৃত সংস্কৃতির ভাঙ্গন। ছাত্রশক্তিকে যাবতীয় গড়ার কাজ করতে হবে। শুভঙ্করী মূল্যবোধ গড়ার কাজ, জনসম্পর্ক গড়ে তোলার কাজ, জ্ঞান-মানস গড়ে তোলার কাজ, চরিত্র-গঠনের কাজ, একতা গড়ে তোলার কাজ। বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে জ্ঞান-চরিত্র-একতার গঠনপথ ভীষণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে স্বাধীনতা পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে। গঠন সর্বস্তরে চাই, এবং গঠনের পর তা যাতে কোনো শক্তি ভাঙ্গতে না সাহস পায়, তার জন্যও শক্তি-সংহতির কাজ করবে রাষ্ট্রবাদী ছাত্রশক্তি।
নতুন ভারত গঠনে যেমন ছাত্রদের ভূমিকা থাকবে, তেমন শিক্ষকদেরও যথাযথ ভূমিকা ও দায়িত্ব থাকবে। ছাত্রদের ভাবজগতে গঠনমূলক পরিবর্তন আনার উসকো কাঠি হবেন শিক্ষকেরা। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে অন্তরে-বাহিরে জাতীয়তাবাদী শিক্ষককে খোঁজার পথ জানতে হবে ছাত্রদের। জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠন তার সুলুকসন্ধান দিতে পারে। বিদ্যায়তনে শিক্ষকেরা পাঠদান করেন, এটা সত্য, কিন্তু সেটাই শেষ নয়, অনুপ্রেরণা দান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রদের কেবল ডিগ্রি লাভ নয়, ‘বিকশিত’ হয়ে ওঠার শিক্ষা ছাত্রজীবনের বড় পাওনা, বড় সার্টিফিকেট। কোন বিকাশ? বিকাশ মানে হল প্রসারণ, বিকাশ মানে হল বিস্তৃতি। মনের প্রসারণ। বড় মনের মানুষ হতে হবে। একসাথে বাঁচা আর একসাথে লড়ার সামর্থ্য জন্মাতে হবে। ব্যক্তিত্ব অর্জন করতে হবে।ব্যক্তিত্বের উত্তরণে শিক্ষক যোগ্য সহায়তা করবেন।
আমাদের ছাত্রছাত্রীদের রাষ্ট্রভক্তিতে পরিপূর্ণ হতে হবে। ভারত ভূখণ্ডের প্রতি ভালোবাসা। সমান সুখদুঃখের ভাবনায় গঠিত সমাজ। এক জীবনদর্শন, এক গ্রহণযোগ্য সংস্কৃতি, প্রাচীন অাধ্যাত্মিক পরাম্পরা৷ ছাত্র ছাত্রীদের শারীরিক ক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে হবে। প্রাণশক্তির এক উচ্ছল ধারা তার মধ্যে থাকবে। আমাদের প্রার্থনা হতে পারে কবি কুসুম কুমারী দাশের ভাষায়, ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতার মতো —
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন
‘মানুষ হইতে হবে’ – এই যার পণ৷
বিপদ আসিলে কাছে হও আগুয়ান
নাই কি শরীরে তব রক্ত, মাংস, প্রাণ?
হাত পা সবারই আছে, মিছে কেন ভয়?
চেতনা রয়েছে যার, সে কি পড়ে রয়?
সে ছেলে কে চায় বল, কথায় কথায়
আসে যার চোখেজল, মাথা ঘুরে যায়?
মনে প্রাণে খাট সবে, শক্তি কর দান,
তোমরা ‘মানুষ’ হলে দেশের কল্যাণ৷
কেমন মানুষ হবে তারা? আর কীভাবে দেশের কল্যাণ হবে? জাতীয় আদর্শে প্রতিপালনের মাধ্যমে কল্যাণ হবে। ত্যাগ আর সেবা হল ভারতবর্ষের জাতীয় আদর্শ। ‘ত্যাগ’ কাকে বলে? ত্যাগ মানে হচ্ছে ‘কাঁচা আমি‘ থেকে ‘পাকা আমি‘-তে চলে যাওয়া। ছোটো আমি থেকে বড় আমিতে রূপান্তরিত হওয়া।
মানুষের দ্বারা মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস তো অনেক দিন হল। ওই পথে ভারতের মুক্তি নেই, মুক্তি হতেও পারে না। বলা হয়, “একান্ত মে সাধনা/লোকান্ত মে পরোপকার“। পরোপকারের জন্যই সেবা। মানুষের কাজ। দেশের মানুষের জন্য কাজ। সেবা কাকে বলে? সেবা হল পীড়িত মানুষকে ভালো রাখার সুযোগ পাওয়া। কেউ সেবা করার সুযোগ দিচ্ছেন বলেই সেবা করতে পারছি, এই বোধটা থাকা দরকার। নইলে সেবা হবে না। সেবাপ্রাপ্ত মানুষের কাছ থেকেই সেবার কাজ চেয়ে নিতে হয়। যতক্ষণ মনে হবে, আমি কাজ করছি বলেই তিনি পরিষেবা পাচ্ছেন, ততক্ষণ সেবার কাজ হবে না। নিজের মোক্ষের জন্যই যে হিতসাধন তা ছাত্রাবস্থা থেকে বুঝতে পারার নামই সেবাধর্ম। করোণা পরিস্থিতিতে নানান সেবাব্রতীদের সঙ্গে অতুল সামর্থ্যে সেবাকাজ পরিচালনা করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্র সমাজ। এবিভিপির কাজ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু এটা নিয়ম মেনে, নিজেকে রক্ষা করেই করতে হবে। স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। পরিচ্ছন্নতার মধ্যে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান। জীবনের সকল কাজে পরিচ্ছন্নতা। জৈবিক ক্ষেতি করে সেখানেও কীটনাশক ব্যবহার না করার স্বচ্ছতা। জাতীয়তাবাদী কাজ এটাও — ন্যাচারাল ফার্মিং-এ ছাত্রসমাজের অংশগ্রহণ। কারণ বহুছাত্রের নিবাস গ্রামে। সামগ্রিক গ্রাম বিকাশের হাত লাগানোর মধ্যে রাষ্ট্রচেতনা থরে বিথরে ছড়িয়ে আছে। গ্রামে চলো ধ্বনি উঠুক ছাত্র সমাজ থেকে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রেরা দাবী তুলুক প্রাথমিক শিক্ষা থেকে কৃষি, পশুপালন ও পরিবেশ শিক্ষা দেওয়া হোক। কলা বা বিজ্ঞান অনুষদের একজন পিএইচডি স্কলার যখন টবে একটি গাছ লাগাতে অসমর্থ হয়, ফুল ফোটাতে পারেন না, তখন তার শিক্ষা অসম্পূর্ণ বলে ধরে নিতে হবে। প্রকৃতি ও বাস্তব মুখী শিক্ষা জোর করে ছিনিয়ে নিক ছাত্রসমাজ। নীতিশিক্ষা, শারীরশিক্ষা দাবী জোরদার হোক। তবেই বুঝবো ছাত্র বটে!
বিশ্ব এখন গভীর সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষেরও গভীর সংকট। ভারতের বাজারে চীনের দখলদারি, সীমান্তে তাদের নানান অনৈতিক কাজ। ভারতবর্ষের মধ্যে নানান সংগঠন ও ব্যক্তির মধ্যে চীন-মানসিকতা গেঁড়ে বসে আছে। আমাদের উচিত হবে চীনা জিনিস নয়, দেশীয় জিনিসে সাধ্যমতো কাজ চালিয়ে যাওয়া। ছাত্রসমাজ এই স্বদেশী জাগরণের কাজটি করতে পারে। মানুষকে বোঝাতে পারে। কোন কোন জিনিস বিদেশী, চীন দেশে তৈরি, কোনটি দেশীয় পণ্য, তা সহজভাবে মানুষের কাছে পরিবেশন করতে হবে। চীনের পণ্য ও চীন-মানসিকতা বয়কট করার কাজেও একটি রাষ্ট্রবাদী কাজ হবে। স্বদেশী জাগরণ ও আত্মনির্ভরশীল ভারত নির্মাণের কারিগর হতে পারে জাতীয়তাবাদী ছাত্রসমাজ। এ প্রসঙ্গে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে স্বদেশী আন্দোলনের কথা মনে পড়বে।
১৯০৮ সালের ২৬ শে জানুয়ারি একটি সভায় শ্রীঅরবিন্দ বলেছিলেন, “ There are four subjects which usually form the subject matter of a Nationalist’s speech. They are, first Swadeshi, second, boycott, third, Swaraj, and fourth, national education.” বহরমপুরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনের ভাষণে তিনি বললেন, “Swadeshi, Boycott, National Education — these are the three planks upon which all can take their stand.” আমরা ভারতবর্ষে দ্বিতীয় বার স্বদেশী আন্দোলনে দেশজুড়ে সামিল হয়েছি। এই আন্দোলন আর্থিক স্বনির্ভরতার আন্দোলন। এ লড়াই গ্রাম-ভারত নির্মাণের লড়াই। এ মহারণ দেশের পণ্যে ভারতভূমিতে ছড়ানোর যুদ্ধ। ছাত্র সমাজকে তাতে সামিল হতেই হবে।
যদি পড়াশোনা করে মূল্যবোধ তৈরি না হয়; যদি নির্ভীক, স্বাভিমানী, স্বাবলম্বী হতে না পারে; সেবাপরায়ণ, দেশভক্ত ভারতীয় নাগরিক হয়ে না উঠতে পারে, তবে সে শিক্ষা বৃথা। রাষ্ট্রবাদী ছাত্রসমাজ এমন শিক্ষা অর্জনের জন্য তদ্বির করবে যা জীবনের সমস্যাকে সাফল্যের সঙ্গে সমাধান করতে সক্ষম হয়। কোনো ছাত্র কেবল নিজে শিখবে না, অধীতজ্ঞান গৃহে, গ্রামে, গঞ্জে সফলভাবে যথাসাধ্য প্রয়োগ করবে। নীতিনিষ্ঠ সমাজ তৈরি করতে এগিয়ে আসবে। রাষ্ট্র-জীবনকে গৌরবশালী করবে। স্বধর্ম রক্ষা করবে। স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবে। স্বদেশ অভিমান জাগ্রত করবে। এই কাজে শিক্ষক ছাত্রকে সমভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে।
“ ওঁ সহনাববতু সহনোভুনক্তু সহবীর্যং করবাবহৈ/ তেজস্বীনাবোধিতমস্তু মা বিদ্বিষাবহৈ। / ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি।”
আমরা শিক্ষক-ছাত্র সমভাবে বিদ্যার্জন করব; সমভাবে বিদ্যার ফল লাভ করব; সকলে সুস্থ-সবল নীরোগ জীবনযাপন করব; কেউ কারো প্রতি বিদ্বেষী হব না; আমাদের মধ্যে সকল শান্তি-সুখ বিরাজিত হোক।
বিদ্যাগার থেকে পূর্ণ মানুষ হয়ে বেরোতে হবে — নিজেকে অবিরত চিনে, নিজেকে জেনে, নিজের চিন্তা চেতনাকে উপলব্ধি করে। তবেই কিন্তু বৈজ্ঞানিক ঘটনাবলীকে নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারব।কারো ধার করা চিন্তা নয়, চিন্তা চুরি করে নয়। স্বাধীন চিন্তাধারা না এলে জ্ঞান-বিজ্ঞান পরিপুষ্ট হবে না। জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে যা মণি-মাণিক্য খুঁজে পেলাম তাকে জীবনের প্রয়োজনে আনতে হবে; জীবনের সমস্যা সমাধানের কাজে লাগাতে হবে।
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি।
( লেখক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক )
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborti)