শাহজাহানের রাজত্বকাল মোগল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ ছিল না

স্কুল পাঠ‍্য পুস্তকে এতদিন আমরা জেনে এসেছি, সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল ছিল মোগল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ। কিন্তু বর্তমান গবেষণায় গল্পের সে ফানুস ফেটে বেরিয়ে পড়েছে তার কংকাল। আজকের আলোচনায় শাহজাহানের বিতর্কিত স্বর্ণযুগের কথা। শুরুর আগে আমরা জেনে নিই শাহজাহান সম্পর্কে তাঁর পিতার দু:খ-কথা। জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী “তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী”-তে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পুত্র শাহজাহানকে তিনি নিজের সন্তান বলতেও যেন লজ্জা পাচ্ছেন ।

জাহাঙ্গীরের মর্মবেদনা তাঁর নিজের কথাতেই স্পষ্ট। তিনি জানাচ্ছেন,
“আমি নির্দেশ দিলাম, এখন থেকে সে (শাহজাহান) আমার অধম ব‍্যক্তি।… ওর জন্য আমি কত কিছু করেছি, কত দু:খ পেয়েছি, তা লিখে বোঝানো যাবে না। ওই বিদ্রোহী সন্তানের জন্য যখন আমাকে দীর্ঘযাত্রা করতে হচ্ছে, তখন দুর্বলতা আর হতাশা গ্রাস করেছে আমাকে। এখন থেকে শাহজাহান আর আমার সন্তান নয়।”

এবার শাহজাহানের রাজত্বকালের বর্ণনা আম‍রা পাচ্ছি তাঁর দরবারের সভাসদ্ মোল্লা আব্দুল হামিদের লেখায়। তাঁর লেখায় উঠে আসছে দুর্দশাপীড়িত মানুষের কথা। মোল্লা আব্দুল হামিদ লিখছেন,
” এ বছরও সীমান্তবর্তী এলাকায় কিছুটা এবং দক্ষিণ ও গুজরাটে দেখা দিয়েছে অভাব। শেষের দুটি জায়গার মানুষেরা এক টুকরো রুটির জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত, কিন্তু খরিদ্দার নেই। একটি রুটির জন্য ইজ্জত বেচতে চাইছে মানুষ, খরিদ্দার নেই। অভিজাত পরিবারের মানুষেরাও রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত পাতছে ।

দীর্ঘদিন ধরে কুকুরের মাংস বিক্রি হয়েছে ছাগলের মাংস বলে।
মরা মানুষের হাড় গুঁড়ো করে ময়দার সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি হয়েছে।
….মানুষ একে অপরকে খাদ্য হিসেবে দেখছে।
সন্তানের ভালোবাসার চাইতে বেশি উপাদেয় হয়ে উঠেছে তার মাংস।
অসংখ্য মুমুর্ষ মানুষের ভিড়ে রাস্তা অবরুদ্ধ ।

এরপরেও যাদের কিছুমাত্র হাঁটার শক্তি ছিল, তারা কেউ চলে গেছে অন্য গ্রামে, কিংবা শহরে। …”
এই হলো সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালের স্বর্ণযুগের নমুনা।
আর যে তাজমহল সম্পর্কে শাহজাহানের নামকে জুড়ে স্বর্ণযুগের কথা বলা হয়, সেখানেও দেখা যাচ্ছে শ্রমিকদের করুণ দশা। বিষয়টি সম্পর্কে জানাচ্ছেন ঐতিহাসিক কীন্ (Keene)। তিনি লিখছেন,
“তাজমহলের শ্রমিকদের জোর করে বেগার খাটানো হতো। খাটুনির তুলনায় খুবই কম পয়সা দেওয়া হতো তাদের। তারপর সেটুকুতেও ভাগ বসাতো লোভী কর্মচারির দল। এ অবস্থায় তারা নিশ্চয়ই মমতাজকে অভিশাপ দিতো।…
শ্রমিকদের মৃত্যুহার এতটাই বেশি ছিল, যার জন্য কিছুদিন পর পর নতুন একদল শ্রমিক খুঁজে আনতে হতো।…

বছরের প্রায় প্রতিদিনই উপযুক্ত শ্রমিক ধরে আনার জন্য সৈন্য পাঠাতে হতো। তারপর খোলা তরবারি, চাবুকের আস্ফালন দেখিয়ে সামান্য মজুরিতে তাদের কাজে লাগানো হতো। শ্রমিকরা এজন্য কাঁদতো, বিদ্রোহ করতো, মারা যেতো বা পালিয়ে যেতো। “…
আর তাই বিভিন্ন মতানুসারে ১০ থেকে ২২ বছর ধরে লেগেছিল তাজমহলের কাজে এবং লেগেছিল ২০ হাজার শ্রমিক।
এরপরেও কি বলা যায়, সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল ছিল মোগল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.