ভারতমাতা হচ্ছেন অখন্ড ভারতবর্ষের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, মাতৃকা সাধনার এক সনাতনী ভৌমরূপ। ভারতবর্ষ নামক এক অতুল্য দেশকে জননী জ্ঞানে শ্রদ্ধা ভক্তির নামই ভারতমাতা-পূজন। যে দেশে আমার জন্ম, যে দেশের সম্পদ গ্রহণ করে আমার এই শরীর, যে দেশের গৌরবে আমার অন্তঃকরণ আনন্দ লাভ করে, যে দেশ আমাকে অন্তরাত্মার সন্ধান দিয়েছে — তারই মাতৃরূপা ভারতমাতা। কবি দ্বিজেন্দ্র লাল রায় ‘আর্যবীণা’ পর্যায়ে ‘ভারতমাতা’ নামে দুটি কবিতা রচনা করেছিলেন (৯ এবং ২৩ সংখ্যক)। ‘আর্যবীণা’ কাব্য-পর্যায়ে এছাড়াও ‘বিষণ্ণাভারতী’, ‘আয় ভারতসন্তান’ প্রভৃতি কবিতায় ভারতমাতার আভাস দিয়েছেন তিনি। তাঁর ‘রাণা প্রতাপ সিংহ’ নাটকের (১৯০৫) চতুর্থ অঙ্কের সপ্তম দৃশ্যে দেখা যায় পৃথ্বীরাজ গাইছেন যুদ্ধে আহ্বানের গান; যেন ভারতমাতা ডাক দিয়েছেন — মোঘলদের বিপ্রতীপে দেশের পীড়িত ধর্মকে রক্ষা করতে হবে, হিন্দুস্থানের বিপন্না জননী-জায়াকে রক্ষা করতে হবে, রক্ষা করতে হবে নিলাঞ্ছিত ভারত নারীকে। আর সেজন্যই রণসাজে যেতে হবে সমরে।
“ধাও ধাও সমরক্ষেত্রে
গাও উচ্চে রণজয় গাথা!
রক্ষা করিতে পীড়িত ধর্মে
শুন ঐ ডাকে ভারতমাতা ।
কে বল করিবে প্রাণের মায়া,–
যখন বিপন্না জননী-জায়া?
সাজ সাজ সকলে রণসাজে
শুন ঘন ঘন রণভেরী বাজে!
চল সমরে দিব জীবন ঢালি —
জয় মা ভারত, জয় মা কালী!”
এখানে ভারতমাতার স্বরূপ হচ্ছেন মহাকালী। আর ভারতমাতার সন্তানেরা কোষ নিবদ্ধ তরবারি নিয়ে লড়াই করবেন। আমরা দেখতে পাই বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮১) উপন্যাসে দেশভক্তির যে ক্ষীরধারার উদ্ভব হল, দ্বিজেন্দ্রলালের ‘রাণা প্রতাপ সিংহ’ নাটকে সেই ক্ষীর প্রবাহিত হয়ে পরিপুষ্ট লাভ করল। স্বামীজি বলেছিলেন আগামী পঞ্চাশ বছর ভারতমাতাই ভারতবাসীর একমাত্র উপাস্য দেবতা। সিস্টার নিবেদিতার ‘Kali the Mother’ কবিতার আদর্শে ভারতমাতার ছবি আঁকলেন অবনীন্দ্রনাথ। সেই অখণ্ড ভারতবর্ষের সাধনায় ব্রতী হলেন অরবিন্দ।
ভারতমাতার সামনে সঙ্কল্প মন্ত্র উচ্চারণ করে দেশমাতাকে রক্ষা করার পুণ্য শপথ নিই আমরা। দেবীকে অর্ঘ্য সমর্পণ করে ধ্যান করা হয় অখণ্ড ভারতবর্ষের, স্মরণ করা হয় তাঁর চিন্ময়ী রূপ, সে আরাধ্য মূর্তি যেন দশভূজা দেবী দুর্গা। ভারতমাতার পুজো মানে রাষ্ট্রীয় বেড়া বাধার ব্রত, দেশকে ভেতর থেকে শক্তিশালী করে তোলার ব্যায়াম, ভারতবাসীর মধ্যে পারস্পরিক মৈত্রী গড়ে তোলার রাখীবন্ধন, সঙ্গবদ্ধ হয়ে কাজ করার শপথ গ্রহণ। যে মাটি আমাদের খাদ্যের ভাণ্ডার, যে মাটিতে আমাদের পদচারণা, যে মাটির বুকে আমাদের বসতি, তাকে ধন্যবাদ দেবার চিরন্তন-চিন্তনই যেন ভারতমাতার পুজো। মাটি-ই মা, মাতৃকা আরাধনার চরম দার্শনিকতা হল ভারতমাতার পুজো। ভারতবর্ষ পুণ্য ভূমি; এই দেশ কেবল আমাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানই দেয় নি, দিয়েছে এক অচিন্ত্য বিস্ময় — “Each soul is potentially divine.” ভারতবাসী অমৃতের সন্তান, পুণ্য – পবিত্র।
৩০ শে আগষ্ট, ১৯০৫ -এ অরবিন্দ তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে (২৪ শে আগষ্টে লেখা পত্রের উত্তরে) একটি পত্রে লিখছেন, “আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভগবান যে গুণ, যে প্রতিভা, যে উচ্চশিক্ষা ও বিদ্যা, যে ধন দিয়াছেন সবই ভগবানের, যাহা পরিবারের ভরণ-পোষণে লাগে আর যাহা নিতান্ত আবশ্যকীয় তাহাই নিজের জন্য খরচ করিবার অধিকার, যাহা বাকি রহিল তাহা ভগবানকে ফেরৎ দেওয়া উচিত। আমি যদি সবই নিজের জন্য, সুখের জন্য, বিলাসের জন্য খরচ করি, তাহা হইলে আমি চোর। হিন্দুশাস্ত্রে বলে, যে ভগবানের নিকট ধন লইয়া ভগবানকে দেয় না, সে চোর। আমি এতদিন পশুবৃত্তি ও চৌর্যবৃত্তি করিয়া আসিতেছি, ইহা বুঝিতে পারিলাম। বুঝিয়া বড় অনুতাপ ও নিজের উপর ঘৃণা হইয়াছে, আর নয়, সে পাপ জন্মের মত ছাড়িয়া দিলাম।….আমার ত্রিশ কোটী ভাই-বোন এই দেশে আছে, তাহাদের মধ্যে অনেকে অনাহারে মরিতেছে, অধিকাংশই কষ্টে ও দুঃখে জর্জরিত হইয়া কোন মতে বাঁচিয়া থাকে। তাহাদেরও হিত করিতে হয়।……অন্য লোকে স্বদেশকে একটা জড় পদার্থ, কতগুলা মাঠ ক্ষেত্র বন পর্বত নদী বলিয়া জানে। আমি স্বদেশকে মা বলিয়া জানি, ভক্তি করি, পূজা করি। মা’র বুকের উপর বসিয়া যদি একটা রাক্ষস রক্তপানে উদ্যত হয়, তাহা হইলে ছেলে কি করে? নিশ্চিন্তভাবে আহার করিতে বসে, স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে আমোদ করিতে বসে, না মাকে উদ্ধার করিতে দৌড়াইয়া যায়? আমি জানি এই পতিত জাতিকে উদ্ধার করিবার বল আমার গায়ে আছে, শারীরিক বল নয়, তরবারি বা বন্দুক নিয়া আমি যুদ্ধ করিতে যাইতেছি না, জ্ঞানের বল।… কার্যসিদ্ধি আমি থাকিতেই হইবে তাহা আমি বলিতেছি না, কিন্তু হইবে নিশ্চয়ই।…”
শ্রীঅরবিন্দ বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। অরবিন্দ বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ গানের ইংরেজি অনুবাদও করেছিলেন। দেশমাতাকে দেবী দুর্গাজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন বঙ্কিম। বন্দেমাতরম মন্ত্রে যে দেশমাতা, তিনি যেন দেবী দুর্গারই অন্যতর রূপ। “বাহুতে তুমি মা শক্তি/হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি/তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে।।/ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী/ কমলা কমল দল-বিহারিণী”। শ্রীঅরবিন্দের দুর্গাস্তোত্রেও দেখতে পাই ভারতবর্ষ নামক দেশের সার্বিক মঙ্গলের জন্য তিনি দেবীকে ভারতবর্ষের মাটিতে প্রকট হতে প্রার্থনা জানিয়েছেন। “Mother Durga! Rider on the lion, giver of all strength, Mother, beloved of Siva! We, born from thy parts of Power, we the youth of India, are seated here in thy temple. Listen, O Mother, descend upon earth, make thyself manifest in this land of India.”
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী এবং ডা. সন্দীপন নন্দন ঘোষ