ধর্ষণের শাস্তি কেমন হওয়া উচিত?
গোটা দেশের এই প্রশ্নের উত্তরেই যেন সোমবার সংসদে ক্ষোভে ফেটে পড়েন জয়া বচ্চন, বলেন, ‘ধর্ষকদের রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে মারা উচিত’। হায়দরাবাদ, দিল্লি, মুম্বাই কী কলকাতার পথে নেমে যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়াতে সরব; সকলেরই বক্তব্য, সাধারণ শাস্তিতে কাজ হচ্ছে না। হলে এত ঘটনা ঘটে না। তাছাড়া আইনের মারপ্যাঁচে, পুলিশ-কোর্টকাচারির ফাইল ঠেলাঠেলির সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়ায় কাজের কাজ হচ্ছে না। এর ফলেই ভয় পাচ্ছে না ধর্ষক। যাঁরা অর্থবান অর্থাৎ সামাজিকভাবে ক্ষমতাবান তারা তো এককাঠি উপরে, আজ ধর্ষণ করে কাল কলার তুলে এলাকা দাপাচ্ছেন। প্রসঙ্গত, সমাজতাত্ত্বিকদের মতে এ দেশের অধিকাংশ ধর্ষণ নিরবে ঘটে। পাশের বাড়ির লোকও জানতে পারে না। পরিবারের সম্মান, সমাজ কী বলবে ইত্যাদি অস্বস্তিতে গোপন করা হয় ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষক ও ধর্ষিতার পরিবারের মধ্যে দেনা-পাওনার রফা হয়। গরিব বাপ-মা এককালীন টাকা পেয়ে অন্যায় গিলে ফেলে। অবশ্য অসহায়ের পক্ষে এছাড়া আর উপায়ই বা কী! তাঁরা ভাবেন, তবু তো মেয়েটা বেঁচে। এরপর টাকায় রফা না করতে চাইলে মেয়ে খুন হয়ে যাবে! অথবা এক গভীর রাতে গোটা পরিবার সমেত জতুগৃহ হল বাড়িটা! যে বাড়ি জ্বালাল সে-ই আগবাড়িয়ে পুলিশ ডেকে রিপোর্ট লেখালো। অগ্নিকাণ্ডের একটা ‘কারণ’ও বেরোলো। এবং সমাপ্ত সিনেমা। এইসব চেপে যাওয়া, চুপ থাকা ঘটনার পরেও যা প্রকাশ্য হয় মিডিয়ার কল্যাণে তা নিয়েই আজ উত্তাল দেশ। হওয়াটাই স্বাভাবিক।
আসলে গত কয়েকদিনে মেয়েদের জন্যে রীতিমতো আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে দেশে। হায়দরাবাদের পশুচিকিৎসকের নৃশংস ধর্ষণ ও পুড়িয়ে মারার ঘটনার পর অন্য শহর থেকেও খবর মিলেছে একইরকম ঘটনার। এমনকী পশুচিকিৎসকের উপরে যেখানে পাশবিক অত্যাচার হয়েছিল তার এক কিলোমিটারের মধ্যে আরও এক অর্ধনগ্ন দগ্ধ নারীদেহ উদ্ধার করে তেলেঙ্গানা পুলিশ। এরপর দিল্লিতে ঘটেছে, কলকাতাতেও, ফের হায়দরাবাদে! এমনকী আজ সামনে এসেছে ওড়িশার একটি গণধর্ষণের ঘটনা। হচ্ছেটা কী? কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না সাধারণ নাগরিক। রাগ, ক্ষোভ, হতাশায় হয়তো পথে নামছেন তারা, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের বেদনা দীর্ণ মতামতও রাখছেন। প্রশ্নও তুলছেন দেশের পুলিশ-প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে। এই তো, গতকাল শহর কলকাতাতে প্রতিবাদে মিছিলে হাঁটল একদল ছাত্রছাত্রী। ওঁদের হাতে ধরা ছিল পোস্টার—‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
প্রশ্ন হল, এই জাস্টিস কেমন হবে? কী হতে পারে ধর্ষণের শাস্তি? এদেশে তো আইন আদালত রয়েছে। আছে পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিরাও আছেন বলেই জানা যায়। যে কোনও সভ্য গণতন্ত্রে যা যা থাকা উচিত আর কী। কিন্তু এতসবের পরেও নিজের কন্যা সন্তানটি যখন পুরুষ পশুর হাতে ধর্ষিত হয়, এমনকী ভোগ করার পরে তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়, তখনই হয়তো জয় বচ্চনের কণ্ঠে উঠে আসে এক ক্ষিপ্ত অন্তর্দগ্ধ অসহায় মায়ের ভাষা—ধর্ষকদের রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে মারা উচিত। শুধু জয়া বচ্চন না, একথা অনেকেই বলছেন। অন্য ক্ষেত্রেও। যখন পাড়ায় চোর, ডাকাত বা ছিনতাইবাজ ধরা পড়ে। ফুঁসে ওঠা ভিড় সাফ জানায়, পুলিশ ওদের ঘুষ খেয়ে ছেড়ে দেবে। এবং ঘটে যায় গণপিটুনি। যা কখনই দায়িত্বশীল নাগরিকের পরিচয় না। সাধারণ নিয়মে একজন ধর্ষকের বিরুদ্ধেও প্রথমে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার একটা ব্যাপার রয়েছে। এরপর বিচারক বিধান দেন। অপরাধের মানের উপর নির্ভর করে জেল হবে না মৃত্যুদণ্ড। ধনঞ্জয়ের যেমন ফাঁসি হয়েছিল, চলতি বছরেই শাস্তি পেল নির্ভয়া কান্ডের দোষীরা। মনে রাখা ভালো, এই শাস্তি শুধু সেই অপরাধীটিকেই দেওয়া নয়, বরং একটা উদাহরণ রাখা সমাজে, যা দেখে ভবিষ্যত-অপরাধী ভয় পাবে, অপরাধ করার আগে দশবার ভাববে। তা কি হচ্ছে? এদেশের একের পর এক ধর্ষণকান্ড কিন্তু সেকথা বলছে না। তাহলে?
তাহলে বোধ হয় শাস্তির রকমফের দরকার। অন্তর্জালের দেওয়ালে, প্রতিবাদ মিছিলে, পাড়ার মোড়ে, চায়ের দোকানে এটাই আলোচনা। মোদ্দা বক্তব্য—আতঙ্ক উদ্রেক করার মতো শাস্তি চাই! দুঃস্বপ্নের মতো শাস্তি! যেমন, যৌনাঙ্গ কেটে বাদ দেওয়া হোক। অনেকে বলছেন, যেভাবে কষ্ট দেওয়া হয়েছে ধর্ষিতাকে সম পরিমাণ কষ্ট দিয়ে মারা হোক ধর্ষককে, কেড়ে নেওয়া হোক যাবতীয় সামাজিক পরিচয়। এক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় শাস্তিপন্থাই সঠিক বলে মনে করছেন কেউ কেউ। যেমন ‘গঙ্গাজল’ স্টাইলে অন্ধ করে দাও, হাত পা কেটে নাও। মৃত্যুদণ্ড হলে ফাঁসিঠাসি নয়, মধ্যপ্রাচের পুরনো শাস্তির মতো হোক। লোকটাকে একটা গর্ত খুঁড়ে পুতে ফেলে হোক গলা অবধি, মাথাটা শুধু বাইরে। তারপর সমবেত জনতা ইট-পাথর ছুঁড়ে মারতে মারতে নারকীয় কষ্ট দিয়ে নিধন করুক ‘জন্তু’টাকে। এমনকী কেবল মারলেই হবে না, মেরে প্রকাশ্য জনপথে ঝুলিয়ে দিতে হবে। যাতে করে ধর্ষকের বীজ রয়েছে যে পুরুষ পশুর মস্তিষ্কে সে তার ভবিষ্যৎ পরিণতি দেখে শিউরে ওঠে। আচ্ছা, এতে কি সমস্যার সমাধান হবে?
মনে হয় না। কারণ যে সব দেশে এমন ভয়ঙ্করতম শাস্তির নিদান রয়েছে সেখানে এরপরেও ধর্ষণের মতো নারকীয় অপরাধ ঘটছে। তাহলে? হয়তো অপরাধ নির্মূলের পন্থা কঠিন শাস্তি নয়! হয়তো একটি অপরাধের পেছনে রয়েছে হাজারো আর্থসামাজিক জটিলতা, থাকতে পারে সাংস্কৃতিক বিপর্যয়, আরও আরও কারণ। তবে সম্প্রতি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রদেশ ধর্ষণের অভিনব শাস্তি প্রণয়ণ করে সংবাদে এসেছে।
সেখানকার নতুন আইনে ধর্ষণ প্রমাণিত হলে ধর্ষককে দুটি পছন্দ বেছে নিতে বলা হয়। এক, সারা জীবন জেলে কাটাতে হবে। ‘যাবজ্জীবন’ না, মৃত্যু অবধি বন্দি থাকতে হবে কারাগারে। অথবা বছর কয়েক জেল, এবং মুক্তির ঠিক আগে বাধ্যতামূলক একটি ইঞ্জেকশন দেওয়া হবে অপরাধীকে। যে দুর্দান্ত ইঞ্জেকশন পুরুষের স্বাভাবিক সম্ভোগশক্তি কেড়ে নেয় চিরকালের মতো।
ভেবে দেখা যেতে পারে!
কিশোর ঘোষ