আজ প্রজাতন্ত্র দিবস। ১৯৫০ সালের এই দিনে স্বাধীন সার্বভৌম গনতান্ত্রিক ভারতবর্ষ নিজের সংবিধান গ্রহন করেছিল। স্বাধীনতাও পায়ে পায়ে ৭৫তম বছরে পৌছোবে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন থেকেই প্রধানমন্ত্রী কলকাতায় স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষপূর্তির সূচনা করলেন। সেদিন ঐতিহাসিক ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক আলো আর ধ্বনিতে সরকারিভাবে উপস্থাপন করলেন ভারতের স্বাধীনতায় সুভাষের অবদান। স্বাধীনতার পর থেকে যা অনুচ্চারিত ছিল এতকাল।পরাক্রম দিবসে শুরু হল পরাক্রমী সার্বভৌম ভারতের যাত্রা।
রাজশেখর বসুর ‘চলন্তিকা’ অভিধানে ‘পরাক্রম’ শব্দের সমার্থক শব্দ বিক্রম, বল বা বীরত্ব। সংসদ বাংলা অভিধানও এই বিশেষ্যের অর্থ বিক্রম, বীরত্ব, দাপট। এই বিশুদ্ধ বাংলা তৎসম শব্দটিকেই ভারত সরকার গ্রহণ করেছেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন এখন থেকে সারা ভারতবর্ষের জন্য পরাক্রম দিবস। গত ২৩ জানুয়ারী ন্যাশেনাল লাইব্রেরীতে ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রী প্রহ্লাদ সিং প্যাটেল বললেন ‘মুখার্জী কমিশনের’ কথা। মুখার্জী কমিশন রিপোর্টে পরিষ্কার করে বলা হয়েছিল যে নেতাজী সুভাষের মৃত্যু ১৯৪৫ সালে বিমান দুর্ঘটনাতে হয়নি। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রথম কেউ মুখার্জী কমিশনের কথা বললেন।মন্ত্রী সেদিন বলেছিলেন নেতাজীকে নিয়ে ভাবনা, গবেষণা আর ব্যপক অনুসন্ধান স্বাধীন ভারতের আত্মশক্তির জাগরণের সূচনা ঘটাবে।
নেতাজী গবেষনার বিষয়ে যার নাম সবার আগে মনে আসে তিনি অধ্যাপিকা পূরবী রায়। যিনি রাশিয়ার মহাফেজখানা থাকে প্রথম খুঁজে পেয়েছিলেন, ১৯৪৭ সালের পরেও নেতাজীর জীবিত থাকার প্রমান। ওই দিন তিনি এক মর্মন্তুদ কথা বললেন। উপস্থিত সকলের চোখ ছলছল করে উঠেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অখন্ড ভারতবর্ষের তিনটি বন্দরে আজাদ হিন্দ বাহিনীর যুদ্ধবন্ধীদের নিয়ে আশা হয়েছিল। কলকাতা, চট্টগ্রাম আর মাদ্রাজ বন্দরে। কলকাতা বন্দর থেকে আই.এন.এ. বন্দীদের ব্যারাকপুরের নীলগঞ্জে নিয়ে আসা হয়েছিল। সেখানে তাঁদের উপর অবর্ননীয় অত্যাচার চলে।
তারপর ১৯৪৬ সালের ২, ৪ আর ৬ জানুয়ারী ব্যারাকপুর থেকে ট্রেনে করে সেই তথাকথিত যুদ্ধবন্দীদের লাহোর হয়ে মুলতানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই ট্রেনগুলিকে কোন বড় স্টেশনে দাঁড় করানো হয়নি। কিন্তু মুলতানের জেলের থেকে তাঁরা কোথায় গেলেন তার কোন হিসেব নেই। আনুমানিক ২৫ হাজার পরাক্রমী দেশভক্ত বীর মুলতান জেলের মধ্যে নিখোঁজ হয়ে গেলেন। তাই ব্যাপক ও সর্বাত্মক অনুসন্ধানের শুরু হওয়া প্রয়োজন। নীলগঞ্জ থেকে মুওলতান, তাইওয়ান থেকে লন্ডনের সরকারী মহাফেজখানা, সর্বত্র।
নেতাজী জীবনে দুটি দূর্লভ জিনিস নিজ ক্ষমতায় অনায়াসে পেয়েছিলেন আর হেলায় পরিত্যাগ করেছিলেন। একটি আই.সি.এস.এর চাকরী আর অন্যটি কংগ্রেসের সভাপতির পদ। তিনি হয়ত বুঝেছিলেন যে এতে তার ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠা হবে কিন্তু দেশের ক্ষতিই হবে। কারণ নেতাজী সুভাষ কেবল ভারতবর্ষের জন্য ভাবতেন। সেই লক্ষপূরনের জন্য তিনি যে কোন শক্তির সাহায্য নিতে প্রস্তুত ছিলেন। তাই যারা সেদিন তাকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজোর কুকুর বলেছিলেন বা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘পিপললস ওয়ার’ পত্রিকায় তার কুৎসিত ব্যাঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন তাঁরা দেশের মানুষের অপূরনীয় ক্ষতি করেছিলেন।
বিশ্বযুদ্ধের পরে নেতাজী ফিরে আসুন সেটা কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি বা মুসলীম লীগ কেউওই চায়নি। কারণ নেতাজী ভাবনার দিক থেকে এঁদের সকলের থেকে ভিন্ন ছিলেন। নেতাজী ফিরে এলে হিন্দু মুসলমান সকলে বিনা দ্বিধায় তাঁর নেতৃত্ব মেনে নেবে। দেশভাগ আর হবে না। মুসলিম লীগ আর কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব তখন একযোগে পাকিস্তানের দাবী করছিলেন। কংগ্রেসের একশ্রেনীর নেতৃত্ব যত দ্রুত সম্ভব ক্ষমতা পেতে চাইছিলেন। সেই কারনেই সুভাষ যাতে না ফিরতে পারে তার জন্য আপ্রান চেষ্টা হয়েছিল সব পক্ষ থেকে।
মতিলাল নেহেরু ছেলেকে ছোট থেকে লন্ডনের হ্যারো স্কুলে পড়িয়েছিলেন। কৈশোর থেকে যৌবন বিলেতে থেকে পড়াশুনা করেছিলেন, বিলিতি আদব কায়দা শিখেছিলেন পন্ডিত জওহরলাল নেহরু। জিন্নাভাই পুঞ্জেও ছেলেকে লন্ডনে পাঠানোর সময় হাত ভরে অর্থ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের বাবা-ই-কাউম মহম্মদ আলি জিন্না আদব কায়দায় একেবারে সাহেব ছিলেন। যৌবনের বেড়ে ওঠায় ভারতবর্ষের ছোঁয়া সামান্যই ছিল।
নেতাজী সুভাষের জীবন রচনা একেবারে ভিন্ন ছিল। কটকের রভিনশ কলেজেটেড স্কুলে থাকার সময় থেকেই সুভাষ ভারতীয় পোষাক পড়তেন। তারপর কলকাতার প্রসিডেন্সি কলেজ। সুভাষের মনপ্রান জুড়ে তখন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর ভাষায়, ‘বিবেকানন্দের কথা বলতে গেলে হারিয়ে ফেলি নিজেকে’। একদিন সব কিছু ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে বের হয়ে গেলেন গুরুর সন্ধানে। গুরু হয়তো পাননি কিন্তু দেশের ডাক পেয়েছিলেন। যে বয়সে অন্যরা স্যুট বুট পরে ইংরাজী আদব কায়দা শিখছিলেন, সুভাষ চিনছিলেন ভারতবর্ষকে। আবার এই দেশের মাটিতে বড় হওয়া সুভাষ যখন আই.সি.এস. দিলেন তখন প্রথম চেষ্টাতেই অসাধারন সাফল্য!
সেই মহাপ্রানের মৃত্যু কোথায় হল, তা দেশবাসী জানবে না? নীলগঞ্জেই কেবল নয় সর্বত্রই নেতাজীর সহযোগীদের অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। কেবলমাত্র মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন ছাড়া। শাহ নাওয়াজ খান বলেছিলেন, তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নেতাজী সুভাষের শেষকৃত্য করেছেন। দিল্লীর আই.এন.এ. ট্রায়ালের পরে যিনি ঘোষনা করেছিলেন যে, তিনি আর হিংসার পথ গ্রহণ করবেন না। ১৯৫২ সালে কংগ্রেসের টিকিটে ভোটে জিতে স্বাধীন ভারতের প্রথম লোকসভায় সাংসদ হয়েছিলেন। স্বাধীনতাঁর পরে প্রচন্ড গনদাবীতে সুভাষের মৃত্যুর তদন্ত করতে কমিটি গঠন করতে হয়েছিল। ১৯৫৬ সালে সেই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন শাহনাওয়াজ খান। তিনি ১৯৪৬ সালে মিত্রশক্তির তৈরী করা ‘ফিগেস রিপোর্টের’ বিমান দুর্ঘটনার তত্বে শিলমোহর লাগান। সুভাষের দাদা সুরেশচন্দ্র বসু সেই কমিটির সদশ্য ছিলেন। কিন্তু কমিটির রিপোর্টে ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি সই করেননি।
শাহনাওয়াজ খান ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় রেল ও পরিবহন দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রী হয়েছিলেন ১৯৬৬ সালে। সেই বছরই শ্রম, নিয়োগ ও পুনর্বাসন দপ্তরের মন্ত্রী হন। ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ইস্পাত ও খনি দপ্তর, পেট্রোলিয়াম ও রাসায়নিক শিল্প দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন। কৃষি ও সেচ মন্ত্রী ছিলেন ১৯৭৪-৭৫ সালে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত তিনি আবার একই দপ্তর পান। তিনি ন্যাশেনাল সীড করপোরেশন এবং ফুড করপরেশন অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন।
২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদি সরকার নেতাজী বিষয় বহু গোপন ফাইল সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত করেছে। তাতে উঠে আসছে সাংঘাতিক তথ্য। জাপান থেকে আনুমানিক ৭ লক্ষ মার্কিন ডলার মূল্যের নেতাজীর কষ্টার্জিত ধনরাশি কোনরকম কাসটমস ক্লিয়ারেন্স ছাড়া ট্রাঙ্কে ভরে যারা এনেছিলেন তাঁরা সকলেই পুরস্কৃত হয়েছিলেন। প্রকাশিত ফাইলে দেখা গেল ১৯৫১ সালের ২১ মে টকিও মিশনের প্রথান কে. কে. চতুর তৎকালীন কমনওয়েলথ সেক্রেটারী বি. এন. চক্রবর্তীকে অভিযোগ জানিয়েছেন মুঙ্গা রামমূর্তি আর এস. এ. আইয়ারের বিরূদ্ধে। এরাই নেতাজীর ধনরত্ন লুন্ঠনের নেপথ্যে ছিলেন। এই আইয়ার পরবর্তি সময়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রচার সচিব হয়েছিলেন। আর একটি নাম কে. আর. ডামলে, একজন আই.সি.এস। ডামলেই জাপান থেকে আই.এন.এ. ধনরত্ন নিয়ে দিল্লিতে আসেন।পুরস্কার স্বরূপ তিনি বহু লোভনীয় উচ্চপদ আর সেইসঙ্গে গোয়ার রাজ্যপালও হয়েছিলেন।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের সঙ্গে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর একান্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার পরে নেতাজি নিজে দুবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীকে পাঠিয়েছিলেন। ১৯৪০ সালের ২১ জুন শেষবার নাগপুরে দেখা করতে যাওয়ার সময় সঙ্গে ছিলেন রামভাউ রুইকর। ডাক্তারজী তখন মৃত্যুশয্যায়। ১৯৪১ সালের মার্চ মাসের ‘মর্ডান রিভিউ’ পত্রিকায় এই সাক্ষাৎকারের খবর প্রকাশিতও হয়েছিল।
তাই স্বয়ংসেবকরা যখন দায়িত্বে এলেন তখন থেকেই নেতাজীর প্রতি ভারত সরকারের ‘ভাবনার’ পরিবর্তন হল। ১৯৯৯ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মনোজ কুমার মুখার্জীর নেতৃত্বে ‘মুখার্জী কমিশন’ গঠন করে। এই প্রথম কোন তদন্ত কমিটির রিপোর্টে স্বীকার করা হল, নেতাজী সুভাষ ১৯৪৫ সালে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান নি।
সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ বাহিনী প্রথম স্বাধীন ভারতের পতাকা তুলেছিল। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর এই অসামান্য অবদানকে স্মরণ করেছিল ভারত সরকার। ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর এই গৌরবময় ঘটনার ৭৫ বছর পূর্তিতে প্রথা ভেঙ্গে লালকেল্লা থেকে মাথায় আই.এন.এ. টুপি পরে ভাষন দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১৫ অগষ্ট ছাড়া কোন দিন দেশের কোন প্রথানমন্ত্রী লালকেল্লা থেকে জাতীর উদ্দেশ্যে ভাষন দেন নি। একপ্রকার স্বাধীনতা দিবসের মর্যাদা পেল সেটি।
১৯৪৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্দামানের পোর্টব্লেয়ারে নেতাজী সুভাষ বসুকে গার্ড অফ অনার দেওয়া হয়েছিল। সেই ঘটনার স্মরনে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আন্দামানে জাতীয় পতাকা উওত্তোলন করেন। নেতাজীর নামে দ্বীপের নামকরণ করেন। ১৯৪৪ সালের ১৪ এপ্রিল ভারতের মাটিতে প্রবেশ করেছিল আজাদ হিন্দ বাহিনী। মনিপুরের ইম্ফলের থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দূরে মইরাঙে ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা তুলেছিলেন আই.এন.এ.র কর্নেল সওকত মালিক। ২০১৯ সালে ওই দিনে মইরাঙ জয়ের ৭৫বর্ষ পূর্তি উৎযাপন করেছে ভারত সরকার।
১৯৫৬ সালে অ্যাটলি ভারতে এসে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল পি.সি. চক্রবর্তীকে বলেছিলেন ইংরেজের ভারতবর্ষ ছেড়ে যাবার রহস্য। পূর্বতম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সেদিন জানিয়েছিলেন নেতাজীর জন্যই ভারত ছেড়েছে ইংরেজ।আজাদ হিন্দ বাহিনীর সাফল্য আর তাতে অনুপ্রানিত হয়ে সংঘটিত নৌবিদ্রোহ ব্রিটিশরাজের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
ঔপনিবেশিক শাসনের কালিমা আজ মুছে যাচ্ছে। উঠে দাড়াচ্ছে পরাক্রমী ভারতবর্ষ। আজ প্রজাতন্ত্র দিবসে কে যেন ডাক দিচ্ছে, ‘আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে” ।