হেমচন্দ্র কানুনগো ( ১২ জুন,১৮৭১ – ৮ এপ্রিল, ১৯৫১) ছিলেন একজন গোপন রাজনৈতিক সংগঠনের অগ্রদূত নেতা, এবং আলিপুর বোমা মামলায় (১৯০৮-৯) অরবিন্দ ঘোষের সহ-অভিযোগী। তাকে আন্দামানে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দেয়া হয়, কিন্তু ১৯২১ সালে মুক্তি পান। সম্ভবত তিনি প্রথম বিপ্লবী ছিলেন যিনি ভারত থেকে সামরিক এবং রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। তিনি রুশ সাম্রাজ্যের প্যারিস থেকে প্রশিক্ষণ নেন। তিনি ১৯০৮ সালের জানুয়ারিতে দেশে ফিরে আসেন। তিনি কলকাতার নিকটে মুরারিপুকুরে অনুশীলন সমিতির এক বোমা বানানোর কারখানা তৈরি করেন। সেই সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন হেমচন্দ্র কানুনগো, অরবিন্দ ঘোষ এবং তার ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ। মুরারিপুকুরে তার তৈরি তিনটি বোমার প্রথমটি ফরাসি চন্দননগরের মেয়রকে হত্যার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় কিন্তু মেয়র অল্পের জন্য বেঁচে যান। দ্বিতীয়টি বইয়ের আকারের এবং তাতে স্প্রিং লাগানো ছিলো। যথা সময়ে বই না খোলাতে কিংসফোর্ড বেঁচে যান। তৃতীয় বোমাটি ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকী মুজাফফরপুরে ব্যবহার করেছিলেন।
হেমচন্দ্র কানুনগোর জন্ম তৎকালীন মেদিনীপুর জেলার রাধানগর গ্রামে। পিতার নাম ক্ষেত্রমোহন কানুনগো। এঁদের পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল ওড়িশা জাজপুরে এবং পদবি ছিল ‘দাস’। জমি জরিপের কাজে মূলতঃ এখানে আসেন আর সেকারণে এঁদের পদবি পরবর্তীকালে হয় ‘কানুনগো’। হেমচন্দ্র মেদিনীপুর টাউন স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। সেখানে মেদিনীপুর কলেজে এফ.এ ক্লাসে পড়বার সময় অভিভাবকদের আপত্তি সত্ত্বেও ক্যাম্বেল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু শৈশব থেকেই ছবি আঁকার অভ্যাস ছিল। শেষে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে এবং বউবাজার আর্ট গ্যালারিতে চিত্রবিদ্যা শিক্ষা লাভ করেন। পরে তিনি মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ড্রয়িং শিক্ষক এবং কলেজে রসায়নে ডেমনস্ট্রটরের চাকরি নেন। কিন্তু তাতে গ্রাসাচ্ছাদনের সুবিধা না হওয়ায় মেদিনীপুর জেলা বোর্ডে চাকরি নেন। জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসুর প্রেরণায় বিপ্লবী গুপ্ত সংগঠনে প্রবেশ করেন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে পরিচিত হন। এই সময় থেকেই তার মেদিনীপুরের দল কলকাতার দলের সঙ্গে যুক্ত হয়। তিনি মেদিনীপুরে মাতুলালয়ের প্রাসাদ সংলগ্ন বাগানে নির্বাচিত তরুণদের অস্ত্র ব্যবহারের শিক্ষা দিতেন। এভাবে হেমচন্দ্র কানুনগো হয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অস্ত্রগুরু। অগ্নিযুগের সৈনিকদের বোমা তৈরি করতে তিনিই শিখিয়েছিলেন।
হেমচন্দ্র কানুনগো নিজে বোমা তৈরি শিখতে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৩ আগস্ট ইউরোপ যাত্রা করেন। তবে শুধু বিস্ফোরক তৈরি করা শেখেননি, ইউরোপীয় ধারায় গুপ্ত সমিতি গঠন ও পরিচালনার পদ্ধতি বিষয়ে শিক্ষা নেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে বিশ্ব সোশালিস্ট কংগ্রেসের যে অধিবেশন হয় তাতে মাদাম ভিকাজি কামার সাথে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। হেমচন্দ্র চিত্রশিল্পী ছিলেন বলে, কথিত আছে মাদাম কামার অনুরোধে লাল,গেরুয়া ও সবুজ রঙের তেরঙ্গা পতাকা তৈরি করেন এবং ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ আগস্ট প্রবাসী ভারতীয়দের সম্মেলনে মাদাম কামা সেই পতাকা উত্তোলন করে সারা বিশ্বে নজর কাড়েন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে আসেন। যুগান্তর দলে যোগ দিয়ে তিনটি বোমা তৈরি করেন। দ্বিতীয় পুস্তক বোমাটি কলকাতার মানিকতলায় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রোডে অবস্থিত কলকাতা পুলিশের মিউজিয়ামে রাখা আছে। তৃতীয় বোমা ৩০ শে এপ্রিল ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ক্ষুদিরাম বসু দ্বারা ছোঁড়ার হেতু ২রা মে কলকাতার মুরারিপুকুর বাগানে দলের সবাইয়ের সাথে ধরা পড়েন। মামলা চলাকালে দলের নরেন গোঁসাই রাজসাক্ষী হয়। তাকে ১লা সেপ্টেম্বর হত্যার কারণে ধরা পড়েন সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও কানাইলাল বসু। মুরারিপুকুর ষড়যন্ত্র মামলায় সকলেই স্বীকারোক্তি দিলেও হেমচন্দ্র কোন স্বীকারোক্তি দেন নি। মামলায় অন্যান্যদের সাথে হেমচন্দ্রেরও আন্দামানের সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এগারো বৎসর পরে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে মুক্তি পান।
কারাবাস শেষে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মেদিনীপুর ফিরে আসেন। কিছুদিন ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করেন। পরবর্তী জীবনে ভীষণ ‘সিনিক’ হয়ে উঠেন। পরবর্তী জীবনে কিছুকাল মানবেন্দ্রনাথ রায়ের দলের সংগে কাজ করার চেষ্টা করেন। জীবনের শেষভাগে রাধানগরে বাংলো বাড়িতে নির্বিঘ্ন শান্তিতে কাটান। এসময় ছবি আঁকা ও ফটোগ্রাফি নিয়ে থাকতেন। তিনিই আলিপুর বোমা মামলার একমাত্র আসামি যিনি বারীন ঘোষ ইত্যাদির প্ররোচনা সত্ত্বেও পুলিশের কাছে কোনো বিবৃতি দেননি। মৃত্যুকালে তিনি রাজনীতি থেকে বিস্মৃত ছিলেন।
১৯৫১ সালের ৮ এপ্রিল হেমচন্দ্র কানুনগো পরলোকগমন করেন।