অরণ্যের মাঝে পাতাঝরা বৃক্ষ,
করম গাছের সারি; তাতে অধিষ্ঠান করে আছেন আমজনতার অতিপ্রিয় করমদেবতা। তাঁরই সামীপ্যে সান্নিধ্যে পৌঁছে গিয়ে প্রকৃতি মায়ের আঁচলে বাঁধা থেকে একদল মানুষ আয়োজন করেছেন এক পার্বণের। এদিন ভাদ্রের শুক্লা একাদশী, মাঝ-শরতের মানানসই দিন; অরণ্যের উপান্তে আউশধান কাটা হয়ে গেছে। তখনই অরণ্য-সংস্কৃতির মাঝে হলদু-বৃক্ষের তলায় বর্ষার মেঘমেদুরতায় দেবতার থানে শিকড়ের সন্ধানে ছুটে এসেছে বনবাসী মানুষের বোধ। মনে হয় যেন দেবতার কাব্য করমপাতার সবুজের অরণ্যে এভাবেই বুঝি চিরকাল লেখা হয়ে থাকে, সেই আদি অনন্ত যুগ ধরেই তার কাব্য-সুষমা। লেখা হয় লোককবির কলমেও —
“ভাদর মাসে করমপরব
মুদের ঘরে ঘরে
বাঁজা মাটি গাভিন হবেক
বীজের ফোড়্যেফোড়্যে
দাঁতন কাঠি বাঁশের টুপা
বালি ভরা ডালা
ডালা ঘিরে বিটিছিল্যার
জাওয়া গানের পালা।”
যখন ভাদ্ররাতের শুক্লা একাদশীর ভিজে চাঁদ আকাশের মেঘ অনবধানে ফাঁক হয়ে বিরল হয়ে দেখা দেবে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল, ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড় জুড়ে লোকবাদ্যের তালে তালে সাঁওতাল, মুন্ডা, ওরাওঁ সমাজের আনন্দ-উৎসবে, তখন অনাবিল আনন্দ, আনন্দ জোলো মেঘের কোণেও, যেন অংশ নিতে চায় প্রকৃতি পূজায়। তাতে কুড়মি, ভূমিজ, লোহার, বাউড়ি, বীরহোড়, খেরওয়ার, হো, খেড়িয়া, শবর, মাহালি, পাহাড়িয়া জনজাতিরও অংশগ্রহণ। প্রকৃতি মাতার কোলে ফিরে ফিরে আসে সমাজের নিবিড় নাড়ির টান। আনন্দ যৌবনের দেবতা করম, তাঁর আহ্বানে অরণ্যচারী মানুষ কৃষিকাজের মাঝে আনন্দে মেতে ওঠার ফুরসৎ পায়। করম ঠাকুরের অমল আশীর্বাদে প্রকৃতির মাঝে অফুরন্ত ফসল ফলে উঠবে যেন! বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার আহার্য সংগ্রহের শক্তি যোগানের ব্যবস্থা করবেন তিনি — এ যেন তারই ভরসা-পার্বণ। কুড়মি সমাজ আনন্দে গেয়ে উঠবে —
“আমরা যে কুড়মি জাতি
করম লাগি সারা রাতি
আমরা গো করমপূজা করি এক মনে
ভাদর মাসের একাদশীর দিনে।
যে গাছকে কেন্দ্র করে করমপূজা এবার তার পরিচয়ে যাই। জনজাতি সমাজে গাছটির পরিচিতি ‘করম’ নামে; বাংলায় এর নাম কেলী-কদম। সংস্কৃত সাহিত্যে নাম পাওয়া যাচ্ছে ‘গিরিকদম্ব’, অর্থাৎ ভারতের মালভূমির অনুচ্চ পাহাড়ে পাহাড়ে ফুটে ওঠা কদমেরই দূরবর্তী জাতভাই। অসমিয়া ভাষায় গাছের পরিচয় ‘তারকচাঁপা’,
ফুলের হলুদ রঙের জন্য কেউ আদর করে ডাকেন ‘হলদু’। ইংরেজি নাম Yellow Teak বা হলুদ সেগুন; কিংবা Saffron Teak ব গেরুয়া সেগুন। রুবিয়েসী গোত্রের (কফিগাছ যে গোত্রের গাছ) গাছটির বিজ্ঞানসম্মত নাম Adina cordifolia (Roxb.) Hook. f. Ex Brandis. গাছটি Haldina cordifolia (Roxb.) Ridsdale নামেও লিপিবদ্ধ আছে বোটানির পাঠ্যপুস্তকে৷ প্রায় ২০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এই বৃক্ষ জাতীয় গাছ, জুন থেকে আগষ্ট – ফুটতে থাকে সুন্দর ফুল। এই গাছটি ভারতের পর্ণমোচী অরণ্যের একটি অনন্য সম্পদ; দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সম্ভবত এই গাছটির আদিনিবাস। ভারত ছাড়াও মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ চীন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়াতে এই গাছের বিস্তারণ চোখে পড়ার মতো। গাছের ছালের রঙ হাল্কা বাদামী, ছালে অগভীর এবড়োখেবড়ো, অসমান জমিন। ১০০০ থেকে ২০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত এবং ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এই গাছের বাড়বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়; সামান্য অম্লত্ব মাটিতে থাকা পছন্দ করে এই গাছ। গাছটির নানান ভেষজগুণ জনজাতি সমাজে তা আদরণীয় করে তুলেছে।
করমপূজায় এই করম গাছের তলায় পূজা ও আনন্দগীতি সুসম্পন্ন হবে। যদি গাছ না থাকে তবে তার ডাল পবিত্রমনে তুলে আনতে হবে, সাত্ত্বিকভাবে সংগ্রহ করে লাগিয়ে দিতে হবে মাটিতে, তাকে কেন্দ্র করেই করমপূজা সম্পন্ন হবে। করমগাছের সতেজ নরম-কাণ্ডের কাটা কলমে (Softwood cutting) ৪০০০-৬০০০ পিপিএম IBA হর্মোন পাউডার ব্যবহার করে শিকড় উৎপাদন সম্ভব বলে জানা গেছে। করমপূজায় ডাল কেটে বসানোর মধ্যে হয়তো হাজার হাজার বছরের কলম করার ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে। গাছের অঙ্গজ কলম করার কৌশল হয়তো বনবাসী জনজাতি সমাজে প্রচলিত ছিলই। উৎসবের আচারের মধ্যে তার মিসিং লিঙ্ক আজ ধরা পড়ছে। করমপূজার সঙ্গে অপরিহার্য কৃত্য হল ‘জাওয়া পরব’। এই অনুষ্ঠানে বিবিধ ফসলের বীজ অঙ্কুরিত করে নেওয়া হয় বাঁশের বা মাটির ডালার মধ্যে; তাকে ঘিরে নাচগান সম্পন্ন হবে। এই অনুষ্ঠানের মধ্যে Seed Germination বা বীজের অঙ্কুরোদগমের পরীক্ষার ধারণাটি লুকিয়ে আছে। যদি উত্তম মানের অঙ্কুরিত চারা ডালায় ডালায় ভরা থাকে, তবে অনুমান করা যায়, মাঠে সেই বীজ বুনলে বেশি সংখ্যক চারাই বেরোবে এবং ফলনও হবে বেশি। অতএব করমপূজা কেবল প্রকৃতি কেন্দ্রিক উৎসব নয়, তা সমৃদ্ধ কৃষি সংস্কৃতির চেনা লুপ্ত ইতিহাস। চেনার মাঝে অচিনকে আবিষ্কার করার চিহ্ন সংকেত রয়েছে করমপূজার আনন্দ-পার্বণের পরতে পরতে।
ডঃকল্যাণ চক্রবর্তী এবং শ্রী মিলন খামারিয়া