হরিদ্বারে BMS-এর প্রথম ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং হচ্ছে। সেখানে দু’টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। প্রথম, কোনো নেতার নামে জয়জয়কার করা হবে না। দ্বিতীয়, BMS-এর কোনো সদস্য বা নেতার জন্মদিন পালন হবে না। এরপর উদয়পুরে BMS-এর এক অধিবেশনে গেলেন ঠেংড়ীজী। সেখানকার কার্যকর্তা তাঁকে অত্যন্ত যত্ন করলেন। স্টেজে সেই কার্যকর্তার সঙ্গে উপস্থিত হলেন, তখন হাজার দুয়েক সদস্য তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিলেন। ঠেংড়ীজী বক্তব্য রাখার সময় বললেন, আপনারা আমার জয়জয়কার করেছেন, এতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। কোথাও আমার ব্যক্তি চেতনা খুশী হয়েছে। কিন্তু আমি এটা ভেবে অত্যন্ত দুঃখ পাচ্ছি যে, হরিদ্বার অধিবেশনে কোনো নেতার জয়ধ্বনি হবে না, এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা সত্ত্বেও আপনারা এখানে এটা করলেন।
এরপর সভা শেষ হলে ঠেংড়ীজীকে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে একজন সদস্য তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা সত্যি সত্যিই কি এমন সিদ্ধান্ত হয়েছিল? না-কি আপনি মজা করে এমন কথা বলেছেন! দত্তপন্থজী উত্তর দিলেন, সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেই একথা বলেছি। সেটা নোটিশ আকারে সমস্ত শাখাতেই গেছে। অন্য কোনো শ্রমিক সংগঠনে এমন প্রচলন থাকলেও BMS কখনই ব্যক্তিগত জয়জয়াকারের জায়গা নয়। এরপর তিনি বললেন, অন্য সংগঠনের সঙ্গে ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ বা BMS -এর পার্থক্য কোথায়। বললেন, BMS-এর কার্যকর্তারা প্রত্যক্ষভাবে BMS-এর কার্যকর্তা, অপ্রত্যক্ষভাবে ইউনিয়নের কার্যকর্তা। অন্যান্য মজদুর সংগঠনের কাজটা ঠিক এর বিপরীত। অন্যান্য মজদুর সংগঠনের কার্যকর্তারা প্রত্যক্ষভাবে ইউনিয়নের কর্মী এবং অপ্রত্যক্ষভাবে তার নিজস্ব সংগঠনের কর্মী। BMS-এর ক্ষেত্রে এটা একেবারেই উল্টো।
যারা অন্য মজদুর সংগঠন থেকে BMS-এ যোগদান করেছেন, তাদের সম্পর্কে ঠেংড়ীজী বলেছেন, তারা শারীরিকভাবে BMS-এর জন্য কাজ করলেও, যতদিন না তারা BMS-এর কর্মসূচী বা কর্মপদ্ধতির সঙ্গে সঠিকভাবে পরিচিত না হবেন এবং মানসিকভাবে মেনে নিতে না পারবেন, ততদিন তাদের সম্পূর্ণ সদস্য বলে ধরে নেওয়া যাবে না। পূর্ববর্তী সংগঠনের মতাদর্শকে বর্জন করে BMS-এর মতাদর্শকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে কাজ করতে হবে, তবেই তারা যথার্থ সদস্য হতে পারবেন। রাষ্ট্রঋষির বক্তব্যের মূল কথাটি সব সংগঠনের জন্যই শাশ্বত সত্য। নানান কারণে দলে দলে উপস্থিত হওয়া মানুষজন কোনো বিশেষ সংগঠনের প্রকৃত শক্তি হতে পারেন না। তাদের আশু-নেতৃত্বও সংগঠনের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়। সংগঠন বিকাশের ক্ষেত্রে এবং প্রকৃত সদস্য বিচারে আলোচ্য সংগঠনে কোনো এক ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক ও দার্শনিকতার সম্পূর্ণ ও অমোচ্য মেলবন্ধন জরুরি। তাছাড়া সংগঠন কখনই শক্তিশালী হয় না।
সংগঠনের ভিত নির্ভর করে কার্যকর্তার নেতৃত্বদানের উপর; যেখানে ব্যক্তিপূজা নেই; প্রতিভা যেখানে ধারাবাহিক অধ্যাবসায়কে খাটো করে রাখে নি; কার্যকর্তা যেখানে সদাসক্রিয়, প্রত্যুৎপন্নমতি এবং জিজ্ঞাসু; সমস্ত রকম দীর্ঘসূত্রতা যেখানে সদা পরিত্যজ্য এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে নিরলস ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সেখানেই সংগঠনের জয়জয়কার। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রঋষি দত্তপন্থ ঠেংড়ী ‘Beware of Charisma’ শীর্ষক একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা থেকেই প্রস্তুত আলোচনা।
নেতৃত্ব কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবেন? এ কথা বলতে গিয়ে তিনি আমেরিকান সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক স্টিফেন কোভে (Stephen Covey)-র প্রসঙ্গ আনলেন। কোভে দেখালেন ইংরেজি সাহিত্যের দু’শো বছরের ইতিহাসের প্রথম ১৩০ বছর হল সাহিত্যে ব্যক্তিচরিত্র নির্মাণ বিষয়ে আলোচনা এবং কাহিনীর বিস্তার; যাকে বলা হয় Character Ethic. How to become great? সাহিত্যের পরতে পরতে দেখানো হয়েছে সারাজীবন ধরে চেষ্টা করে কী করে চরিত্রগুলি নিজেরা মহৎ হয়ে উঠেছে তার আনুপূর্বিক বর্ণনা। কিন্তু পরবর্তী ৭০ বছরে সাহিত্যে দেখা গেলো চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠছে Personality Ethic. How to appear great? এই দ্বিতীয় রকমের চরিত্রগুলিতে ইমেজ বিল্ডিংয়ের ব্যাপার ছিলো, যাকে বলা যায় Image Breeding. তারা গ্রেট কিনা বড় ব্যাপার নয়, কিন্তু গ্রেট দেখাতে হবে। এর প্রভাব ভারতবর্ষেও পড়লো। কারণ সাধারণ ভারতীয় শিক্ষিতেরা পাশ্চাত্যকে অনুসরণ করে। ফলে ভারতীয় সাহিত্যেও এই How to become great বদলে গিয়ে How to appear great — এই চর্চা ও তার প্রতিমা নির্মাণ চললো। ভারতবর্ষে স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে ও পরে ভারতীয় নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য কী? ৪৭-এর আগে হল How to become great – এই পর্ব; ৪৭-এর পর হল How to appear great. ৪৭-এর পরে মানুষের মধ্যে ইমেজ বিল্ডিংয়ের ব্যাপার চলে এলো।
এ প্রসঙ্গে আলোচনা করার সময় দত্তপন্থজী ফিলিপস্ ডোনাল্ড (Phillips Donald) নামে এক মার্কিন প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচকের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন। ডোনাল্ড সাহেব বলছেন, তদানীন্তন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের ক্যারিশ্মা নিষ্প্রভ হয়েছে, কিন্তু কিছুদিন আগেও তো দেখেছি তার বিরাট ক্যারিশ্মা! তার পর্যালোচনা করতে গিয়ে ডোনাল্ড গবেষণাধর্মী কাজ করলেন। খুঁজতে লাগলেন, একজন নেতার কী কী সদর্থক গুণ থাকা উচিত এবং কী কী নঞর্থক গুণ থাকা উচিত নয়। তিনি ক্রিটিকাল অ্যানালিসিস করতে উদ্যত হলেন। সেখানেও বাধা পেলেন। কারণ ওদেশে যে নেতাদের নিয়ে সবচাইতে বেশি সাহিত্যে আলোচনা হয়েছে, তিনি হলেন আব্রাহাম লিঙ্কন (Abhraham Lincoln)। তিনি যা কিছু বই পেলেন পড়ে ফেললেন। দেখলেন তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে কোনো সাহিত্যিক কাজ সেখানে নেই। তখন তিনি দেশের সমস্ত সাহিত্য সমালোচক ও পত্রকারদের কাছে চিঠি লিখলেন, জানতে চাইলেন লিঙ্কনের লিডারশিপ কোয়ালিটির উপর কী কী লেখা আছে? কেউ-ই পথ দেখাতে পারলেন না। এইবার তিনি লিঙ্কনের নিজস্ব লেখায় লিডারশিপ নিয়ে কী বলেছেন, কী কী কাজ কীভাবে করেছেন — সেসব নিয়ে পড়াশোনা ও আলোচনা করতে লাগলেন। তিনি একটি বই লিখলেন ‘Lincoln on Leadership’. সেখানে উল্লেখ রইলো একজন নেতার কী কাজ করা উচিত, কী করা উচিত নয়। সে বইয়ে যা লেখা হল, তাকে বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে একজন অস্ট্রিয়ান-আমেরিকান ম্যানেজমেন্ট বিশারদ পিটার ড্রাকার (Peter F. Drucker), Science of Management এবং Practice of Management -এর উপর একটি বই লিখলেন। নাম দিলেন ‘Beware of Charisma’. ড্রাকার সাহেব রিয়ালিটিতে প্রতিষ্ঠা করে গেলেন, একজন নেতা কেমন হওয়া উচিত।
দত্তপন্থজী বলছেন, নেতাকে সবসময় হতে হবে, How to become great. কখনোই তিনি ইমেজ ব্রিডিং করবেন না। বাস্তব থেকে দৃষ্টান্ত নিলেন কয়েকজন নেতার, ইমেজ ব্রিডিং আছে এমন তিন বিশ্বনেতার নাম করলেন, যারা বিগত শতকে বহুশ্রুত, অথচ হারিয়ে গেছেন; তারা হলেন হিটলার, মুসোলিনি এবং স্ট্যালিন। এরা স্ফূলিঙ্গের মতন ক্যারিশ্মাতে প্রচণ্ড জ্বলে উঠলেও বেশিদিন স্থায়ী থাকতে পারলেন না। ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে অপর দিক থেকে তিনি আরও দুই বিশ্বনেতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেন। প্রথম, জার্মানীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশচালানোর নেতার অভাব হয়ে পড়লো। তখন কার হাতে দেশের দায়িত্ব দেওয়া হবে? একজন আর্মি অফিসার অ্যাডেনআওয়ার (Konrad Hermann Joseph Adenauer)-এর হাতে পশ্চিম জার্মানীর দায়িত্ব (As Chancellor from 15 September 1949 –11 Oct, 1963) দেওয়া হল। তিনি সেনা অফিসার হিসাবে যথেষ্ট সৎ, দায়িত্ববান ও নিয়মানুবর্তী ছিলেন। কিন্তু রাজনীতিবিদের ক্যারিশ্মা ছিল না, সামাজিক পরিচিতিও ছিল না। অথচ তিনিই সাড়ে তিন বছরের মধ্যে নতুন জার্মানীর ভিত তৈরি করলেন। দ্বিতীয়, আমেরিকার দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেন। বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন রুজভেল্ট (Franklin D. Roosevelt, 4 March 1933 — 12 April 1945)। তিনি ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিলেন ট্রুম্যান (Harry S. Truman)-কে। দেখা যায়, সবসময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট একজন অদক্ষ মানুষকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট বাছেন, যাতে গ্ল্যামারে, ক্যারিশ্মায় প্রেসিডেন্টকে ছাপিয়ে যেতে না পারেন। ফলে রুজভেল্টের যেমন ক্যারিশ্মা ছিল, ট্রুম্যান তার ধারেকাছেও ছিলেন না। রুজভেল্ট প্রবল জনপ্রিয় থাকা অবস্থাতেই মারা গেলেন, ভাইস-প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান হয়ে উঠলেন প্রেসিডেন্ট (12 April, 1945 — 20 January, 1953)। আমেরিকার মানুষের দুঃখের শেষ রইলো না। সবাই ঠাট্টা-তামাশা করতেন তাঁকে। আমেরিকা জুড়ে চলতি কথা ছিল, “ভুল কাজ মহিলারা করে, আর ভুলকাজ করেন ট্রুম্যান”। এই ট্রুম্যানের হাতেই আধুনিক আমেরিকা তৈরি হল। তিনি কতটা জানেন আর কতটা জানেন না বুঝে নিয়ে, যেটা জানেন না জেনে নিয়ে, পড়াশোনা করে, শিখে সেদেশ চালাতে লাগলেন। তাঁর ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মা ছিল না, কিন্তু How to become great-এর এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠলেন। এইভাবে একজন দলনেতার ব্যক্তিগত স্তাবকতা যে কতটা বর্জনীয়, তা বুঝিয়ে দিলেন দত্তপন্থজী৷ এই প্রসঙ্গের অবতারণা করে ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘে ব্যক্তিপুজো বন্ধের ব্যাপারে সরাসরি নিজস্ব মতামত দিয়েছেন তিনি।
১৯৫৫ সালে আজকের দিনে নিউ দিল্লীতে প্রতিষ্ঠা হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠনের। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এক অসামান্য সংগঠক শ্রী দত্তপন্থ ঠেংড়ী। এই দিনে তাঁর কিছু প্রাসঙ্গিক বক্তব্যের উজ্জ্বল উদ্ধার করা হল।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী