দিনের পর দিন শহরের রাস্তায় বসে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন স্কুল সার্ভিস কমিশনের চাকরি প্রার্থীরা। পরীক্ষায় পাশ করেও চাকরি পাননি অনেকে। যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও অনেকেই নিয়োগ পত্র পেয়েছেন। এমন অভিযোগ বারবার সামনে এসেছে। গত কয়েক বছরে মামলাও হয়েছে অনেক। তবে দুর্নীতির শিকড় যে কতটা গভীরে, তারই কিছু নমুনা এবার সামনে আসতে শুরু করেছে। সম্প্রতি এসএসসি-র নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় কলকাতা হাইকোর্টে রিপোর্ট পেশ করেছে বিচারপতি আর কে বাগের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি। আর ৬৯ পাতার সেই রিপোর্টে উঠে এসেছে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। সোমবার কমিটির আইনজীবী অরুণাভ বন্দ্যোপাধ্যায় উচ্চ আদালতে রিপোর্ট জমা দেন।
নষ্ট করে দেওয়া হয় চাকরি প্রার্থীদের ওএমআর শিট (OMR Sheet)
নিয়োগ পদ্ধতি স্বচ্ছ করতেই নাকি এই ওএমআর শিটের ব্যবহার শুরু করেছিল স্কুল সার্ভিস কমিশন। কারণ ওই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিলে কম্পিউটারের মাধ্যমে তাতে নম্বর দেওয়া হয়। যতবার দেওয়া হবে, ততবার একই ফল আসবে। এর ফলে, প্রশ্নপত্রে কারসাজির কোনও সম্ভাবনাই থাকে না। কিন্তু রিপোর্ট বলছে, এমন অনেকের নিয়োগ হয়েছে, যাঁদের নাম প্যানেলে থাকার কথা নয়। তাই ভবিষ্যতে যদি ওএমআর শিট থেকে আসল তথ্য সামনে এসে যায়, তাই ওই সব শিট নাকি নষ্ট করে দেন এসএসসি-র কর্তারা।
প্যানেলে নাম নেই, অথচ নিয়োগ পত্র দেওয়া হয়েছে, এমনটা তো হতে পারে না। আসল প্যানেল সরিয়ে রেখে একটি নকল প্যানেল তৈরি করেছিল স্কুল সার্ভিস কমিশন। বিচারপতি আর কে বাগের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বলছে, আসল প্যানেলে ছিল যোগ্য প্রার্থীদের নাম। আর এসএসসি-র তৈরি করা নকল প্যানেলে ছিল যাঁদের নিয়োগ করা হবে, তাঁদের নাম। সেখানে অনেক বহিরাগত চাকরিপ্রার্থী ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। তবে আসল প্যানেল স্কুল সার্ভিস কমিশনের কাছেই সংরক্ষিত ছিল। তারা তা নষ্ট করেনি।
নিয়োগে অস্বচ্ছতা রয়েছে এই অভিযোগ তুলে সে সময় মামলা হওয়ায় হাই কোর্টের নির্দেশে প্যানেল প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল কমিশন। অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে ভুয়ো একটি প্যানেল তৈরি করে প্রকাশ করা হয় বলেই দাবি রিপোর্টে। আর সেই অনুযায়ী নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। অন্যদিকে, আসল প্যানেল অবিকৃত থেকে যায়। গণ্ডগোল তৈরি হয় আরটিআই-এর মাধ্যমে। চাকরি না পেয়ে কোনও প্রার্থী যখন আরটিআই করেন, তখন তাঁকে আসল প্যানেলটা দেখানো হয়েছিল। তাতেই সন্দেহের সূত্রপাত। এটা কোনও কাঁচা মাথার কাজ ছিল বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। আর এই ভুলটা করার পরই শুরু হয় মামলা-মোকদ্দমা।
রিপোর্টে যা উঠে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে দুর্নীতি ছিল পরতে পরতে। রাজ্য জুড়ে এসএসসি-র কয়েকটি জোন রয়েছে। ওই জোনের চেয়ারম্যানরা সুপারিশপত্রে স্বাক্ষর করে এসএসসি-র মূল অফিসে পাঠায়। এটাই নিয়ম। আর তার ভিত্তিতেই নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক অফিস থেকে সঠিক নাম এলেও মূল অফিসে এসে তা বদলে গিয়েছে, এমনটাই জানতে পেরেছেন কমিটির সদস্যরা। অর্থাৎ তথ্য বরলছে, যোগ্য প্রার্থীর নাম সুপারিশ করা হত, কিন্তু মূল অফিসে বদলে যেত সেই নাম। কিন্তু জোনাল অফিসের চেয়ারম্যানদের স্বাক্ষর? সেটার কী হবে? রিপোর্ট বলছে, আঞ্চলিক অফিসারদের স্বাক্ষর ডিজিটালি জাল করে ব্যবহার করা হত।
হাই কোর্টের গঠিত কমিটি সূত্রে আরও জানা যায়, নিয়োগ সংক্রান্ত প্রচুর নথি নষ্ট করা হয়েছে। তার মধ্যে কম্পিউটার থাকা তথ্যও মুছে দেওয়া হয়েছে। আইনজীবী অরুণাভ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, নিয়োগ কমিটি যে ওই দুর্নীতিতে যুক্ত ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। উল্লেখ্য, এ দিন যে রিপোর্ট জমা পড়েছে, তাতে নাম জড়িয়েছে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়েরও।